Sunday, October 31, 2021

হিন্দুর কেন শত্রুবোধ থাকবে?

আজকাল প্রযুক্তির যুগে যা শুনতে চাইনা, তাও কিভাবে যেন ঠিক কানে চুঁইয়ে পড়ে। এরই মধ্যে কবে যেন শোনা গেল একজন বিদগ্ধজন একটি চমৎকার বক্তৃতার শেষে বলছেন যে আজকে হিন্দুদের 'শত্রুবোধ' থাকা উচিত। ভদ্রলোক কি অর্থে এই কথাটি বলেছেন আমি তার মধ্যে ঢুকছি না কিন্তু কাকে আমরা শত্রু বলছি, সবার আগে বোধহয় সেই বোধটা থাকা দরকার - তারপর প্রয়োজনীয়তা বা অপ্রয়োজনীয়তার প্রশ্ন আসে। ইংরেজিতে কয়েকটি উৎকৃষ্ট শব্দ আছে, যার মধ্যে কোনটা যে ঠিক ঠিক শত্রুত্বকে ব্যাখ্যা করে, স্পষ্ট করে বুঝতে পারলে বড় সুবিধা হতো। Enemy, Opponent, Adversary, Foe না Antagonist - কে আসল শত্রু কারণ সবই তো কেবল ভিন্ন ভিন্ন স্তরের অ-মিত্রতা? 

বাংলা অভিধানেও শত্রুর অর্থ হিসেবে দুটি আলাদা পর্যায়ের অ-মিত্রতার ব্যাখ্যা আছে - ১. মনে মনে বা প্রকাশ্যে ঘৃণা করে কিংবা ক্ষতিসাধন করে এমন ব্যক্তি; অরি, বৈরী; ২. প্রতিপক্ষ, বিপক্ষ। আবার আমাদের প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে একটু অন্যরকম শত্রু দেখছি - তার কয়েকটি negative, আবার কয়েকটি positive ও বটে। ওতে যেমন বাতশত্রু, পিত্তশত্রু, কাফশত্রু ইত্যাদি আছে, তেমনিই ঘৃতশত্রু, দুগ্ধশত্রুও আছে আবার বুদ্ধিশত্রু, জ্ঞানশত্রু আর আত্মশত্রুও আছে। বিষয়টা তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায় যে শত্রুতা একটি দৈহিক বা মানসিক অবস্থান বিশেষ, যাকে opportunityতে বদলে দেওয়ার উপায় খোঁজাই হলো সঠিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি।

আবার অন্যদিকে ঋগ্বেদে প্রথম যেখানে শত্রুতার উল্লেখ পাচ্ছি তা বৈরী মানসিকতা সংক্রান্ত, সরাসরি বৈরীতা সংক্রান্ত নয়। ঋষি প্রশ্ন করেছেন,

ज्योक्चि॒दत्र॑ तस्थि॒वांसो॑ अक्रञ्छत्रूय॒तामध॑रा॒ वेद॑नाकः ॥ ১.৩৩.১৫

jyok cid atra tasthivāṃso akrañ chatrūyatām adharā vedanākaḥ ||

ইংরেজিতে: “do you inflict sharp pains on those of hostile minds, who have long stood against us.”

এক্ষেত্রে এমন একজনকে আঘাত করার কথা বলা হচ্ছে যিনি বৈরী মানসিকতার বশবর্তী হয়ে দীর্ঘদিন বিরুদ্ধতা করে আসছেন। অর্থাৎ যিনি একত্রে মানসিকরূপে ও সামাজিকরূপে আমার বিরোধী এবং যাঁর কর্মকান্ডের ফলে আমি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষতিগ্রস্ত - তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়, প্রয়োজনে প্রত্যাঘাতও করা যায়, কিন্তু সবটাই অনেকদিন সহ্য করার পর এবং ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে। উল্লেখ্য যে এখানে গোটা প্রতিক্রিয়াটাই কিন্তু retrospective ও reciprocal - পূর্বনির্ধারিত বা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়, অর্থাৎ শত্রুবোধজাত নয় - কর্তব্যজাত, প্রতিকারগত, deterrent।

প্রাচীন ভারতে মর্য্যাদা-আধারিত সামাজিক সীমারেখার বিশেষ সন্মান ছিল এবং এই মর্য্যাদা নির্ধারিত হতো ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত ধর্মবোধের দ্বারা। সমস্ত সম্পর্কের ভিত্তি ছিল এই স্বতন্ত্রতার সীমারেখা আর তা লঙ্ঘন করা পাপ বলেই বিবেচিত হতো। শ্রীরামচন্দ্রের বা শ্রীকৃষ্ণের জীবন দেখলেই আমরা বুঝতে পারি যে কিভাবে ধর্মভিত্তিক দায়িত্ববোধ তাঁদের সমস্ত নির্ণয়কে আলোকিত করতো। সাথে সাথে এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বিরোধিতা কখনোই শক্তির প্রমাণ নয়। শক্তিমান তিনি, যিনি সহনশীল, সহ্য করতে পারেন। সাধারণত অপরে সীমারেখা অতিক্রম করলে ক্রোধ উৎপন্ন হয় আর ক্রোধ থেকেই শত্রুবোধের জন্ম হয়। ক্রোধ বুদ্ধিকে বিচলিত করে তোলে। আর বুদ্ধিবিভ্রাট মানেই পতন। যখন হৃদয় থেকে ক্রোধ দূর হয়ে যায়, তখনই সহনশক্তি ধর্মের শক্তিতে পরিণত হয়। ক্রোধ থেকে প্রতিশোধের জন্ম হয় আর ধর্ম থেকে ন্যায়ের। এই দুই অবতারের জীবনে শুধুই ন্যায়, মর্য্যাদারক্ষা আর কর্তব্যবোধ, কোথাও কোনো ক্রোধও নেই, শত্রুবোধও নেই। এটা শিক্ষণীয়।

আসলে মানুষের সত্যিকারের শত্রুকে চিহ্নিত করার উপায় শ্রীকৃষ্ণ গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে স্পষ্টভাবে বলেছেন:

উদ্ধরেদাত্মনাত্মনং নাত্মনমবসাদয়েৎ। 

আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ।।৫।।

অনুবাদঃ মানুষের কর্তব্য তার মনের দ্বারা নিজেকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করা, মনের দ্বারা আত্মাকে  অধঃপতিত করা কখনই উচিত নয়। মনই জীবের অবস্থা ভেদে বন্ধু ও শত্রু হয়ে থাকে। 

বন্ধুরাত্মনস্তস্য যেনাত্মৈবাত্মনা জিতঃ। 

অনাত্মনস্তু শত্রুত্বে বর্তেতাত্মৈব শত্রুবৎ।।৬।।

অনুবাদঃ যিনি তাঁর মনকে জয় করেছেন, তাঁর মন তাঁর পরম বন্ধু কিন্তু ‍যিনি তা করতে অক্ষম, তাঁর মনই তাঁর পরম শত্রু। 


আসল জীবনটা তো সরলরেখায় চলে না, ফলে সামাজিক শত্রুতারও বিভিন্নতা আছে, সময় বিশেষে যার স্তরান্তরণও ঘটে, বাস্তবিকই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। মতান্তর থেকে মনান্তর, মনান্তর থেকে ক্রোধ, ক্রোধ থেকে বিদ্বেষ, বিদ্বেষ থেকে শত্রুভাবাপন্নতা, এবং শত্রুভাব থেকে অনাত্মীয়তা, অসামাজিকতা, অসহিষ্ণুতা এবং দৌরাত্ম - এটাই যেন ইদানিং অহিন্দুসুলভ অসামাজিক যাপনের অঙ্গ হয়ে পড়েছে। বস্তুতঃ, মতান্তর যদি শত্রুতার ভিত্তি হয় তাহলে সামাজিক ভিন্নতা এবং বহুমাত্রিকতা মূল্যহীন হয়ে পড়ে এবং সমাজে মানুষের স্বাধীন চিন্তার কোনো স্থান থাকে না, যা হিন্দুদের সনাতন ধর্ম-সংস্কৃতির একেবারে বিপরীত। আমাদের প্রত্যেকের ভেবে দেখা উচিত ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য শত্রুবোধের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে নাকি ধর্মবোধ আর নিজের সমাজ-সংস্কৃতিকে রক্ষা করার প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা ও উপলব্ধিসঞ্জাত কর্তব্যবোধই যথেষ্ট।


আমাদের ভেবে দেখা দরকার যে ভবিষ্যতে আমরা আদৌ প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতির প্রকৃত ধারক এবং বাহকরূপে এক স্থিতপ্রজ্ঞ বহুমাত্রিক modern achiever race হিসেবে চিহ্নিত হতে চাই নাকি পন্থতান্ত্রিকদের মতন ভিন্নতাবিরোধী কুপমণ্ডূক জঙ্গি মানসিকতাসম্পন্ন এক ঘৃণ্য জনগোষ্ঠী হিসেবে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করতে চাই। চিরায়ত ভারত এই অনিত্য শত্রুবোধ-মিত্রবোধের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে জীবনের আসল মানে খুঁজে পেয়েছিল। সেটাই শাশ্বত, বাকিটা কেবল দুপয়সার সস্তা রাজনীতি।

No comments:

Post a Comment