গতকাল বিকেলে দুজন অগ্রজপ্রতিম দক্ষিণ কলকাতার একটি ক্যাফেতে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে বেশ একটা মজার অভিজ্ঞতা হলো। অন্য একজন গ্রাহক আগে থেকেই বসে ছিলেন, ধীরে ধীরে আরো কিছু মানুষ যোগদান করলেন, বেশ একটা গ্রূপ তৈরি হয়ে গেল। যা বুঝলাম এঁদের মধ্যে একটি কাপেল আর বাকিরা সব বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী মিলিয়ে সিঙ্গেল যুবক এবং যুবতী। বোঝা গেল যে ওঁরা আগামী শুক্রবার দল বেঁধে দার্জিলিং বেড়াতে যেতে চান, সেই বিষয়েই আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার উদ্দেশ্যেই এই একত্রিত হওয়া। বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ আবহাওয়ায় আলোচনা শুরু হলো, সবাই উচ্চকিত, ঝপাঝপ খাওয়ার এবং পানীয়র অর্ডার দেওয়া শুরু হলো, হাসি ঠাট্টায় একেবারে যাকে বলে উৎসবের পরিবেশ। আমি ফিস ফ্রাই খাচ্ছি আর চুপচাপ দেখছি, শুনছি। তারপর যত সময় এগোতে থাকলো তত পরিবেশ বদলাতে থাকলো এবং প্রথম মতভেদ শুরু হলো mode of transport নিয়ে - কেউ প্লেনে যেতে চান তো কেউ ট্রেনে, কেউ এসিতে যেতে চান তো কেউ স্লিপার ক্লাসে, প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে। তারপর বিরোধ লাগলো বাসস্থান নিয়ে - কারো ইচ্ছে হোম স্টে, কেউ বা লোকাল কালচারে আগ্রহী নন, তাঁরা চান হোটেলের আরাম। যত পারা চড়ছে তত বিভিন্ন সাব-গ্রূপে ভাগ হয়ে সমমনোভাবাপন্নরা বাইরে গিয়ে ঘন ঘন সিগারেট ফুঁকে আসছেন আর ফিরে এসেই দ্বিগুন উৎসাহে নিজেদের মতের সপক্ষে নতুন যুক্তিজাল ছড়াচ্ছেন। আমি দেখছি, মিটিমিটি হাসছি আর ততক্ষনে ফ্রাই শেষ করে চিকেন কাটলেটে হাত দিয়েছি। এরমধ্যে হটাৎ করে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে প্রবল মতানৈক্য দেখা দিল, বন্ধুগোষ্ঠীর একদিকে স্বামী, তো স্ত্রী আর একদিকে। স্বামীটি অবাঙ্গালী এবং স্ত্রীটি খাঁটি মেড ইন বঙ্গ ক্যালকেসিয়ান। উচ্চৈঃস্বরের মধ্যে একবার হিমশীতলগলায় 'ঔকাত' শব্দটি কানে এলো এবং তৎক্ষণাৎ স্বামী ভদ্রলোক নিজের পিঠের বোঁচকা তুলে সটান বাইরে হাঁটা দিলেন, তাঁর পেছনে পেছনে কয়েকজন 'আরে শুন শুন' বলতে বলতে দৌড়ালেন। গোটা জায়গাটা জুড়ে যেন অকস্মাৎ শ্মশানের শান্তি নেমে এলো, টেবিল প্রায় ফাঁকা, দুটো থমথমে ঘন কালো মেঘে ঢাকা মুখ, আর এরই মধ্যে একগাদা খাবার নিয়ে কয়েকজন ওয়েটার হাসিহাসিমুখে সশব্দে থরে থরে প্লেট গ্লাস কাঁটা চামচ ইত্যাদি সব টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখতে লাগলেন, কাঁচের বাইরে ফুটপাথে তখন চরম উত্তেজনা, ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ওঁদেরই মধ্যে যিনি সবার আগে এসে বসেছিলেন, তিনি বাইরে বেরোনোর আগে বিব্রতকণ্ঠে আমাদের দিকে ফিরে বলে গেলেন, "আমি কিন্তু যাবো না, এমনিই এসেছি"; এটা বলার কোনো প্রয়োজন ভদ্রমহিলার ছিলনা কিন্তু কেন বললেন সেটা হয়তো আন্দাজ করা কঠিন নয়। সম্পুর্ন নির্লিপ্ত হয়ে চোখের সামনে সামান্য কালখণ্ডের মধ্যে যেন গোটা জীবনের অসারত্বের একটা চলছবি দেখলাম, যার প্রয়োজনীয়তা আদপেই আছে কিনা ভাবা দরকার, খুবই দরকার। মানুষ নাকি কথা না বললে বাঁচে না। সে কি বাঁচার গুণাত্মক আর পরিমাণাত্মক দিকের পার্থক্য বোঝে আর যদি বোঝে তাহলে কথার প্রয়োজনীয়তা এবং প্রভাবকে কি সে স্বেচ্ছায় গ্রহণ বা বর্জন করার ক্ষমতা ধরে? নিজের মন বুদ্ধি আর অহংকার থেকে উৎপন্ন বাসনা - সেটা প্রকাশের ভাষা, আর অন্যের মন বুদ্ধি আর অহংকারের ওপর সেই বাহ্যিক ভাষার প্রভাব - সব মিলিয়ে বড় গোলমেলে সব ব্যাপার স্যাপার। হয়তো যত বাক্যহীন থাকা যায়, নিজেকে আত্মস্থ রাখা যায়, ততই যাপন অর্থবহ হয়।
No comments:
Post a Comment