বরফঘেরা পাহাড়ের ছবি দেখছিলাম, দেখতে দেখতে মনে হলো পাহাড়ের চূড়ায় যেখানে বরফ লেগে থাকে, সেটা ধাক্কাধাক্কির সময় সবচেয়ে প্রথম বেসামাল হয়েছিল আর ঠেলা সামলাতে না পেরে ধীরে ধীরে অতটা ওপরে উঠে গিয়েছিল। বাকি গোটা পাহাড় এইভাবেই তৈরি - গোটাটাই বিভিন্ন পর্যায়ে নিচের ধাক্কার চোট সামলাতে না পেরে উর্ধতনস্তরের ভার ঠেলতে ঠেলতে নিজেরাও হাজার হাজার ফুট উঁচু হয়ে গেছে। মধ্যাকর্ষণ প্রতিনিয়ত চূড়াকে টানে, কিন্তু পাহাড়ের নিম্নদেশ এমনই বলবান, সেটা মাটিকে এমনভাবে সবলে আঁকড়ে ধরে রয়েছে যে চুড়োর আর নিচে নামবার উপায় নেই। মাঝেমাঝে হয়তো পাহাড়ের গা থেকে ভূস করে খানিকটা মাটি পাথর গড়িয়ে নেমে আসে, হয়তো কখনো পাহাড়ের খানিকটা অংশ ভেঙে পড়ে, মাথার বরফ গলে গলে জীবনদায়ী নদী হয়েও নেমে আসে ধরাতলে, কিন্তু পাহাড় নামে না। আসলে ওই উচ্চতায় একবার উঠে গেলে আর নামবার যো থাকে না। আমাদের মনের মধ্যে বরফঢাকা পাহাড়চূড়া দেখলে যে অদ্ভুত এক শান্তির অনুভূতি হয়, সেটা আসলে মনে মনে তার উচ্চতার এবং নির্লিপ্ততার স্বীকৃতি - সে মাটির সব কলুষতা, সব ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমরা তো জানি যে একেবারে পাদদেশে যে পাথর, চূড়াতেও তাই, তবু কেন শ্রদ্ধা হয়? কারণ আমরাও আর টাল সামলাতে পারছি না, আমাদেরও নানাবিধ অশান্তি চতুর্দিক থেকে ঘিরে নিয়ে ভয়ানক ঠেলছে, আমাদেরও আর এই রোজকার চিঁড়েচেপ্টা হওয়া ভালো লাগছেনা, আমরাও চাইছি অশান্তির উৎসের কাঁধে ভর দিয়েই ওগুলোর উর্ধে উঠে যেতে। আসলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেই তো কত পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে দেখা যায় - কই তাদের তো ডেডলাইন মিট না করার গালাগাল খেয়ে, নিজের মনকে ছোট করে পেটের রসদ জোগাড় করতে হয়না, তাদের তো দেখনদারী করার জন্য ক্রেডিটকার্ডের বোঝার তলায় ডুবে যেতে হয়না, তাহলে আমাদের কেন হয়? তারা যদি অতটুকু বুদ্ধি নিয়ে প্রকৃতি থেকেই নিজেদের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু অক্লেশে মিটিয়ে নিতে পারে, আমরা এত বুদ্ধি নিয়েও কেন তা পারিনা? নিজেদের চারপাশে নিজেদেরই গড়ে তোলা এই যে একটা কৃত্তিম বাসনার ইঁট আর বাসনাপূর্তির সিমেন্ট দিয়ে তৈরি দেওয়াল, ওই দেওয়াল চাপা পড়ে মরাই যেন আমাদের ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা সবাই পাহাড়চূড়ার শীতলতা চাই, অবিচ্ছিন্ন নীরবতা চাই, অবিক্ষুব্ধ যাপন চাই, অথচ কতজন এই অপ্রয়োজনীয় ধাক্কাধাক্কি থেকে আসলে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারি? আমাদের চতুরাশ্রম কিন্তু সেই কথাই বলে। বলে যে একটা বয়সের পর আর আহারের দিকে নয়, পাহাড়ের দিকে তাকাও। বহুদিন ধরে চাপ সহ্য করতে করতে একসময় টাল হারিয়ে ফেলাটা কোনো অন্যায় নয়, আমাদের সংস্কৃতিতে ওটাই প্রত্যাশিত। যিনি পারেন তিনি শান্তির পথে এগিয়ে যান। যিনি পারেননা, তাঁর চোখদুটি সামনের দিকে হলেও, আপাতত দৃষ্টি পশ্চাদগামী। তবে তিনিও জন্মের পর জন্ম ধরে বিতৃষ্ণা অর্জন করার জন্য সময় পান, কেউই আসলে বাদ নন।
No comments:
Post a Comment