যদিও প্রতিদিনই জপ-ধ্যানের সময় পূজ্যপাদ গুরুদেবের শ্রীমুর্তিটি স্মরণ করা হয়, তবুও গুরুপূর্ণিমার দিনে বিশেষভাবে নিজের গুরুর কথা মনে পড়বে না, এ কেমন করে হতে পারে? গুরুদেব শরীরে থাকলে আজকের দিনে তাঁকে বেলুড়ে গিয়ে প্রণাম করাটাই স্বাভাবিক হতো কিন্তু যেহেতু তিনি এখন ধ্যানলোকের বাসিন্দা, তাই ঠাকুরের মধ্যেই তাঁর প্রকাশ জেনে তাঁকে মানসপটে প্রণাম করাটাই কেবল সম্ভবপর হয়। তবে যতদিন শিষ্যরা শরীরে থাকেন ততদিন গুরুদের ছুটি নেই কারণ মন্ত্রদীক্ষা দানের মাধ্যমে যে আধ্যাত্মিক পথনির্দেশের ভার উনি নিয়েছেন, তা আর কারো পক্ষে বইবার যে যো নেই। শরীরে থাকুন আর নাই থাকুন, গুরু আজীবন শিষ্যের হাত ধরে থাকেন আর যেই সে আধ্যাত্মপথে এক পা এগোতে চায়, তিনি অমনি তাকে কোলে তুলে পাঁচ পা এগিয়ে দেন। শিষ্য যতই ভুল করুক, গুরুর চেয়ে ধৈর্যবান, গুরুর চেয়ে ক্ষমাশীল আর গুরুর চেয়ে দয়াময় আর কেউ হননা। শিষ্য যখন গুরুকে ভুলে থাকে, গুরু তখনো শিষ্যের কর্তব্যটি নীরবে নিজে করে যান আর যখন তার সম্বিৎ ফেরে, সে একফোঁটা কৃপা চাইলে গুরু তাকে একঘটি দিয়ে দেন। আমি নিজের জীবনে গুরুকৃপার এমনসব পরিচয় পেয়েছি যে এ আর শোনা কথা নয়, একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিষয়।
আমাদের শ্রীরামকৃষ্ণ পরম্পরায় গুরুরা অধ্যাত্মিকভাবে দারুন অভিব্যক্ত ও ক্ষমতাবান হন কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই ব্রহ্মস্বরূপ ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন্তরূপ, তাঁর প্রতিনিধি। যে শক্তি তাঁরা বিচ্ছুরণ করেন, সেটি আসলে স্বয়ং ঠাকুর ও শ্রীশ্রীময়ের দৈবীশক্তি। যে মন্ত্র তাঁরা প্রদান করেন সেটি ঠাকুর, মা, স্বামীজী বা ঠাকুরের পার্ষদদের দেওয়া সিদ্ধমন্ত্রগুলির মধ্যে একটি। আর যে সংস্কার তাঁরা বপন করেন সেটি সেই বৈদিকযুগ থেকে অবিচ্ছিন্নভাবে বহতী ঋষিলব্ধ সনাতন ধর্মের মূল সংস্কার। ফলে আমাদের গুরুকে ইষ্টের প্রতিরূপ বলে ভাবতে মোটেও অসুবিধা হয়না এবং ধ্যানে তিনি খুব সহজেই ইষ্টের মধ্যে বিলীন হয়ে যান। এই কারণে আমার গুরুদেব সঙ্ঘাধক্ষ থাকা কালে শ্রীশ্রীঠাকুর, মা, স্বামীজী ও ঠাকুরের পার্ষদ ছাড়া রামকৃষ্ণসঙ্ঘের বাকি সমস্ত গুরুদের জন্মতিথি পালনের প্রথা বন্ধ করে দিয়েছিলেন কারণ শ্রীশ্রীঠাকুর ব্যতিরেকে তাঁদের কারোরই আলাদা করে কোনো অস্তিত্ব নেই। সেই পরম্পরা আজও চলছে। তবু যাঁকে চোখের সামনে স্বয়ং ঠাকুরের প্রতিমূর্তি বলে দুচোখভরে দেখেছি, যাঁকে প্রণাম করে স্বয়ং ঠাকুরকে প্রণাম করার প্রসাদ লাভ করেছি, মাথার ওপর যাঁর আশীর্বাদী স্পর্শ স্বয়ং ঠাকুরের স্পর্শ বলে জেনেছি, যাঁর উপদেশ ঠাকুরের উপদেশ বলে মনে করে যথাসম্ভব পালন করার চেষ্টা করেছি আর আজও যাঁর মূর্তিকে হৃদয়ে ধারণ করে উপাসনা শুরু করি, সেই গুরুকে ভুলি কি করে?
আমার শ্রীগুরুদেব পূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী মহারাজের নামের মধ্যেই বীরেশ্বর শিব ছিলেন। ওঁর পূর্বাশ্রমের নাম ছিল পাণ্ডুরঙ্গ প্রভু, সেটির ভেতরেও শ্রীবিষ্ণু ছিলেন। আর ওঁর আচার আচরণের মধ্যে দিয়ে তিনি ব্রহ্মার মতোই সৃষ্টিশীল ও জ্ঞানের আকর হিসেবে সুবিদিত ছিলেন। খুব ছোটবেলায় গুরুদেব স্বয়ং স্বামীজীর স্নেহাশীর্বাদ পেয়েছিলেন, শ্রীশ্রীমা তাঁকে জয়রামবাটিতে মন্ত্রদীক্ষা দিয়ে কৃপা করেছিলেন আর তাঁর সন্ন্যাসজীবন সযত্নে গড়ে তুলেছিলেন ঠাকুরের নিজস্ব পার্ষদরা। ফলে, আমি তাঁর কাছ থেকে একেবারে নির্ভেজাল সারবস্তুটুকুই পেয়েছিলাম, নিজে তখন তার মূল্য বুঝিনি, সে অন্য কথা। তাঁর দানে কোনো কার্পণ্য ছিল না, আমিই গ্রহণের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারিনি।
গুরুদেব যেমন সুরসিক ছিলেন তেমনই বাস্তববাদী ছিলেন, সেটি তাঁর জীবনীগ্রন্থ পড়লেই বোঝা যায়। শ্রীমৎ স্বামী চেতনানন্দজী মহারাজ তাঁর 'প্রাচীন সাধুদের কথা' গ্রন্থে একজায়গায় গুরুদেবের রসবোধ সম্পর্কে লিখেছেন, '১৯৭৭ সালে জুলাই মাসে হলিউড থেকে প্রথম মঠে এলাম। প্রভু মহারাজকে প্রণাম করতেই তিনি হেসে সেবককে বললেন, “ওর মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে দে। একটা চেয়ার দে।” আমি মেঝেতে তাঁর পায়ের কাছে বসে বললাম, “মহারাজ, আপনার সামনে চেয়ারে বসতে লজ্জা করে।” তখন তিনি হেসে বললেন, “তাহলে ওকে একটা টেবিল দে।” তারপর তাঁর সঙ্গে পাশ্চাত্যের কাজকর্ম সম্বন্ধে অনেক কথা হয়।' গুরুদেবের উচ্চ-নিচ বাছবিচার ছিলনা। যাঁরা ওঁকে চিনতেন তাঁরা জানতেন যে ঐ কঠোর অবয়বের মধ্যে একটা অতিকোমল মাতৃহৃদয় বাস করে, ওঁর কাছে নিঃসংকোচ হওয়া যায়। স্বামী চেতনানন্দজী লিখেছেন, 'বেলুড় মঠে থাকাকালের কতকগুলি ঘটনা মনে পড়ছে। মহারাজ তখন জেনারেল সেক্রেটারি। পুরানাে মিশন অফিসের ওপরের ঘরে আমি মহারাজের সঙ্গে কথা বলছি। এমনসময় মঠের নাপিত রামমুরত ঘরে ঢুকে মহারাজের পায়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে বলল, “প্রভু, মেরে অবগুণ চিত না ধরাে।” মহারাজ হাে-হাে করে হেসে ফেললেন। মহারাজের মাথা কামানাের দিন ছিল, কিন্তু রামমুরত তা ভুলে যায়। তাই সন্ধ্যার সময় ঐ কথা বলে ক্ষমা চাইল।'
আর, একদিকে যিনি ব্রহ্মসূত্রের শঙ্করভাষ্যের ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, তিনিই আবার এক বক্তৃতায় বলেন, "সাধারণত ত্যাগের আদর্শ এখন নেই। আমরা সন্ন্যাসীরা স্বর্গ থেকে আসিনি, এসেছি সমাজ থেকে। নৈতিক স্বাস্থ্যবান দৃঢ় চরিত্রবলসম্পন্ন সমাজই মাত্র পারে আদর্শ সন্ন্যাসী সৃষ্টি করতে। যদি আমরা সাধারণের সঙ্গে না মিশি এবং তাদের মধ্যে কাজ না করে এড়িয়ে চলি, তাহলে তারা কেমন করে নিজেদের সংশোধন করবে এবং ঠিক পথে চলবে? যদি তাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি না হয়, তাহলে আমরাও বা কেমন করে সে সমাজ থেকে তেজস্বী-ত্যাগী ছেলেদের পাব? আর যদি এইরকম দুর্বল সমাজ থেকে ছেলেরা আসে সাধু হবার জন্য, তারা হবে যেমন
— শ্রীধর স্বামী তাঁর গীতার টীকায় বলেছেন,
‘পিশুনাঃ কলহোৎসুকাঃ’
— সবসময় পরের দোষান্বেষী এবং ঝগড়াটে! সুতরাং আমাদের নিজেদের স্বার্থে আমাদের কর্তব্য জনসাধারণের কাছে গিয়ে তাদের নৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য চেষ্টা করা। অধিকন্তু সাধু হিসাবে সমাজের কাছে আমাদের ঋণও রয়েছে। কেননা এতদিন আমরা সমাজের কাছে সেবা পেয়েছি। তাই জনসাধারণের অবস্থার উন্নতির চেষ্টা করে এবং উন্নততর ভিত্তির ওপর সমাজ-পুনর্গঠনে তাদের সাহায্য করে আমাদের সেই ঋণ অবশ্যই পরিশোধ করা উচিত।" (গ্রন্থসূত্র: স্বামী বীরেশ্বরানন্দ - এক দিব্য জীবন)
গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বর
গুরুরেব পরমব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ
No comments:
Post a Comment