আমার গুরুবাড়িতে একটি অপূর্ব মাতৃসংগীত গাওয়া হয়, যার কয়েকটা লাইন এমন:
'অহেতুক তব এই ভালোবাসা পারি কিগো মোরা বুঝিতে,
শত জনমের যত পাপ হায়
দিয়াছি ঢালিয়া ওই রাঙা পায়ে,
সকলই তো তুমি সহিলে হেলায় কোল দিতে কত তাপিতে।'
সত্যি সত্যিই মায়ের শ্রীচরণে দেওয়ার মতন প্রারব্ধ আর কর্মফল ছাড়া কিই বা আছে আমাদের? বাকি কিছুই তো থাকে না - এই শরীর, সম্পত্তি, নাম-যশ সবই তো চলে যায়, একমাত্র কর্মফলটাই বয়ে বেড়াতে হয় জন্ম থেকে জন্মান্তরে। তা, ব্রহ্মময়ীর কাছে ওই কর্মফলটুকু ছাড়া নিবেদন করার মতন আমাদের আর কিই বা আছে? একমাত্র তিনিই তো পারেন প্রারব্ধ নাশ করে মুক্তি দিতে, ফলে ঐটি যদি ঠিকঠিক তাঁর পায়ে সঁপে দেওয়া যায়, কাজ হয়ে যায়।
বলে নাকি ঈশ্বর যখন অবতার বেশে আসেন, তখন নিজের অসীম ক্ষমতা ভুলে সাধারণ মানুষের মতোই থাকেন, তাঁদের স্বরূপের কথা মনে করিয়ে দিতে হয়। হনুমানজীর ক্ষেত্রে বা শ্রীরামচন্দ্রের ক্ষেত্রে, এমনকি ঠাকুরের ক্ষেত্রেও আমরা বারবার তা দেখেছি। সেই অবতারত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল অবস্থাতেও আমরা দেখেছি ঠাকুর মায়ের পায়ে তাঁর সারা জীবনের সাধনার ফল, মায় জপের মালা পর্য্যন্ত অর্পণ করে দায়মুক্ত হচ্ছেন! তবে মা কিন্তু চিরকাল জানতেন তিনি কে, তবুও নিজের রূপ খুব যত্ন করে লুকিয়ে রাখতেন যাতে আমরা সহজেই তাঁর কাছে পৌঁছতে পারি, আবদার করতে পারি, তাঁকে দেবীরূপে নয়, মাতৃরূপে আপনার জন ভাবতে পারি। মা ধরা দেবেন বলেই তো এসেছিলেন, নইলে তাঁকে ধরে এমন সাধ্য কার?
শিহড়ে সারদা মঠে এখনো সেই বেলগাছটি আছে যার তলায় দিদিমা শ্যামাসুন্দরী দেবী বসেছিলেন আর তখনই লাল চেলি পরা একটি ফুটফুটে পাঁচ-ছ বছরের মেয়ে গাছ থেকে নেমে এসে পিঠের দিক থেকে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে, 'আমি তোমার ঘরে এলাম মা' বলে তাঁর উদরে প্রবেশ করে আর তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েন। মা তো তাঁর জন্মবৃত্তান্ত জানতেন, নিজের মুখেই পরে বলেছেন। মায়ের সেবক স্বামী সারদেশানন্দজী লিখেছেন, 'মায়ের করতল ছিল রক্তাভ, অনেকেই তা দেখার সুযোগ পেয়েছেন। পদতলও ছিল লাল - ঠিক স্থলপদ্মের আভা।... দৃষ্টি প্রশান্ত, স্থির, কৃপা মাখানো - যা সকলের অন্তরে সর্বদা করুণা বর্ষণ করতো। প্রশস্ত উজ্জ্বল কপাল, প্রসন্ন মুখ - দেখলেই চিত্ত শান্ত হয়ে যায়'। মায়ের স্বরূপ সম্পর্কে তাঁর নিকটজনদের কোনো বিভ্রান্তি ছিল না, কিন্তু তাও তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ভাব গোপন করে রাখতেন। এই জন্যই তিনি কেবল মা, সকলের মা, তাঁর ঘরের আগল তিনি নিজেই খুলে দিয়েছেন। মায়ের অবারিত দ্বার, যা আর কোনো অবতারে আমরা পাইনা। ঠাকুরের কাছেও কিন্তু অত সহজে যাওয়া যায় না।
আমি আজ ভোরবেলায় ভাবছিলাম মাকে কিভাবে সবচেয়ে বেশি আপন করে পাওয়া যায় - ভক্তি দিয়ে, মনন দিয়ে, তাঁর মনের মতন কাজ দিয়ে, নাকি ভালোবাসা দিয়ে। তারপর মনে হলো মা তো দুহাত বাড়িয়েই রয়েছেন, নিজের মায়ের সাথে কি কেউ লৌকিকতা করে? মা মানেই মাঠ থেকে ধুলো কাদা সব মেখে এসে সন্তানের অধিকারবোধ থেকে নির্বিকারে 'মা খেতে দাও' বলে হাঁক পারা। তারপর মা ঘটি ঘটি জল ঢেলে চান করিয়ে গামছা দিয়ে গা মুছিয়ে পরিষ্কার জামাটামা পরিয়ে ভাত বেড়ে দেবেন, ওটাই মাতৃত্ব। মুখে হয়তো বকাবকি করবেন, কিন্তু ওই একটা জায়গায় কোনো শাস্তির বিধান নেই। ওই কাদা মাখা অবস্থায় বাবার ঘরে ঢুকলে হয়তো সোজা তাড়িয়ে দেবেন, মা কিন্তু কাদা ধোয়ার জন্যই উন্মুখ কারণ রান্না তিনি করেই রেখেছেন আর সন্তান পেটভরে তৃপ্তি করে খেলে, তবেই তাঁর সুখ। তাই মাকে কাছে পেতে গেলে অধিকারবোধ চাই। আমার মা, আমার উদ্ভব যাঁর থেকে, তিনি কোলে টেনে নেবেন না তো কি অন্য পাড়ার খগেন নেবে? আমি যতই কালিঝুলি মেখে আসি না কেন, মা ঠিক পরিষ্কার করে দেবেন, কারণ তিনি আমার মা, আমার নিজের মা। ব্যাস এটুকুই।
No comments:
Post a Comment