Wednesday, February 14, 2024

নিজধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ

 একজন অতি সজ্জন বন্ধুকে দেখলাম বসন্ত পঞ্চমীর দিন একটি কবরে হলুদ গাঁদার চাদর চড়ানো হচ্ছে দেখে 'এটাই আমার ভারত' বলে আপ্লুত হয়ে পড়েছেন। আমি তাঁর ভাবনাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু যাঁর কবর, তৎকালীন ভারতের আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর নাস্তিবাচক ভূমিকা কি ছিল বা বহুত্ববাদ সম্পর্কেই বা তাঁর অবস্থান কি ছিল, সেটা জানলে বোধহয় ওঁর উচ্ছাসটি কিছু কম হতো। যাঁরা ছোটবেলা থেকে 'আল্লা কে বন্দে' বা 'Son of God' শুনে শুনে বড় হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে 'अहम् ब्रह्मास्मि' - আমিই ব্রহ্ম - এই মহাবাক্যের প্রকৃত দ্যোতনা উপলব্ধি করাটা খুবই কঠিন, আমি তাঁদের দোষ দিই না। 


There is a huge difference between faith and seeking - a Faithful does not seek logic and a Seeker seeks nothing but logic - দুটো সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি পথ। আমি আমার নিজের যাপনের প্রত্যক্ষ অনুভূতিগুলিকে বিশ্লেষণ করতে করতে যখন বুঝতে পারব যে এই শরীর, মন, ইচ্ছা, সুখ, সমৃদ্ধি ইত্যাদি সবই ক্ষনস্থায়ী এবং একমাত্র আত্মাই চিরন্তন আর সেই আত্মা আমার এই ক্ষণস্থায়ী শরীরের মধ্যেই বাস করছেন, এর পরের শরীরেও তিনিই থাকবেন এবং তার পরেরটিতেও, তিনিই প্রকৃতপক্ষে দ্রষ্টা বাকি সবই দৃশ্য, তখন ভারতীতীর্থের দৃক-দৃশ্য-বিবেকের logic আমায় আকৃষ্ট করবে, তখন আর আমি আকাশের দিকে মুখ করে বাইরের অচেনা কোনো ঈশ্বরকে খুঁজতে যাবো না। 


উল্টোদিকে বিশ্বাস হল অন্ধ - হয় সম্পুর্ন বিশ্বাস আছে অথবা একেবারেই নেই - এর মাঝামাঝি কোনো অবস্থান সম্ভব নয়। আর বিশ্বাস যেখানে প্রবল সেখানে লজিকেরও কোনো স্থান নেই। যা লেখা আছে বা যা বলা আছে সেটাকেই ধ্রুব সত্য বলে প্রথমে মেনে নিতে হয়, তারপর জীবনকে এমন এক নির্দিষ্ট দিশায় নিয়ে যেতে হয় যেখানে যাপন বিশ্বাসকে আরো পুষ্ট করে, বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করে। এরই পিঠোপিঠি বিষয় হলো অসহিষ্ণুতা এবং অন্যের বিশ্বাসের প্রতি অবজ্ঞা ও বিদ্বেষ। আসলে যেখানে যুক্তি নেই, বিশ্লেষণ নেই, তর্ক বিতর্ক নেই, শাস্ত্রার্থ নেই, শ্রবণ মনন নিদিধ্যাসন নেই, সেখানে যাচাই বাছাই করে নিজের মনের মতন মতটিকে গ্রহণ করার যেহেতু কোনো অবকাশই নেই, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা বা স্বীকৃতি বা গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নও নেই। 


সর্বোপরি হলো ধর্মবোধ। ধর্ম মানে সেই মানবিক মূল্যবোধ যা সমাজের ভিত্তি, যা সমাজকে ধারণ করে। বিশ্বাসীদের কোনো life after life concept নেই, একটাই জীবন - one life concept এবং এটিই হলো ভোগবাদের জনক। একটাই তো জীবন, তাই যত পারো লুটেপুটে খাও, বাকিটা judgement day-র দিন বুঝে নেওয়া যাবে'খন। এই যে অন্ধবিশ্বাসীরা সারা পৃথিবী জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করে অন্যের ধন সম্পদ কেড়ে নিয়ে, জোর করে তাদের পন্থ পরিবর্তন করিয়ে তাদের ওপর শতাব্দীর পর শতাব্দী রাজত্ব ও শোষণ করেছে, এর পেছনে ওই ভোগবাদের ভূতই কাজ করেছে। আমরাও তো ভিনদেশে গিয়েছি, কি নিয়ে গিয়েছি? শিক্ষার আলো নিয়ে গিয়েছি, জ্ঞানের উজ্জ্বল শিখা নিয়ে গিয়েছি, শাশ্বত সনাতন ধর্মের বাণী নিয়ে গিয়েছি। ঋষি অগস্ত‍্য যখন ইন্দোনেশিয়া যাচ্ছেন, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন বেদ চতুষ্টয়, অঙ্করভটে কেল্লা নয়, বিষ্ণুর মন্দির তৈরি হচ্ছে, অতীশ দীপঙ্কর যখন চীন যাচ্ছেন বুদ্ধের অমৃতবাণী নিয়ে যাচ্ছেন ঝোলায় বয়ে আর সম্রাট অশোকের সন্তান যখন শ্রীলঙ্কায় যাচ্ছেন, পবিত্র বোধিবৃক্ষের চারা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন যত্ন করে। 


এই যে এ দেশে এতগুলি ঋষির আশ্রম, এত গুরুকুল, গ্রামে গ্রামে এত পাঠশালা, রত্নাগিরি, জগদ্দল, বিক্রমশীলা, পুষ্পগিরি, ওদান্তপুরী, সোমপুরা, নালন্দা, তক্ষশীলা, বলভী আর বিক্রমপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন এতগুলি উৎকৃষ্ট জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল, তা কি ধর্মবোধ না থাকলে হয়? আমরা জানি যে বারেবারে ভিন্ন ভিন্ন শরীর নিয়ে এখানেই ফিরে আসতে হবে, ফলে জীবনকে এমনভাবে চালনা করো, উন্নত থেকে উন্নততর করো, যাতে তা 'সর্বজন হিতায়, সর্বজন সুখায়'-এর নিমিত্তে নিবেদিত হয়, কেবল 'আমি' নয়, 'আমরা' - সারা বিশ্বসংসার, যাতে কোনো না কোনো এক জন্মে পরা থেকে অপরার দিকে আমাদের যাত্রাপথ সুগম হয়। অনেকদিন হয়ে গেল ঔপনিবেশিক ভাবধারার প্রভাবে নিজেদের শাস্ত্রনির্দেশিত ধর্মবোধকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। ভুলটাকে নির্দ্বিধায় উচ্চৈঃস্বরে ভুল বলতে পারলে তাকে বর্জন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়, একটা স্তরে closure হয় তো বটেই। Let us stop romanticising what is intrinsically anticultural - যা আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতির পরিপন্থী তা অবশ্যই বর্জনীয়। চলুন পাল্টাই।

No comments:

Post a Comment