Friday, February 16, 2024

বাংলায় দেবী সরস্বতীর আবাহন মন্ত্র

 মধুর মধুর ধ্বনি বাজে

হৃদয়কমলবনমাঝে॥


নিভৃতবাসিনী বীণাপাণি   অমৃতমুরতিমতী বাণী

হিরণকিরণ ছবিখানি-- পরানের কোথা সে বিরাজে॥


মধুঋতু জাগে দিবানিশি   পিককুহরিত দিশি দিশি।

মানসমধুপ পদতলে   মুরছি পড়িছে পরিমলে।


এসো দেবী, এসো এ আলোকে,   একবার তোরে হেরি চোখে--

গোপনে থেকো না মনোলোকে   ছায়াময় মায়াময় সাজে॥


অর্থ : 

হৃদয় নামক পদ্মবনে তিনি বিচরণ করছেন, তাঁর নূপুরধ্বনির মধুর সুর মনের মধ্যে শোনা যাচ্ছে।


তিনি বীণাপাণি, সারদা, সরস্বতী - তিনি নিভৃতবসিনী, গোপনচারিণী, কারণ বিদ্যা আত্মস্থ করতে হয়, আত্মসাৎ করতে হয়, বিদ্যা জাহির করার বিষয় নয়। তাঁর বাণী সাক্ষাৎ অমৃত যা হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে সে আত্মবোধ জাগরিত করে মরণের পারে নিয়ে যায়, মোক্ষপ্রদান করে। 'হিরণকিরণছবি', অর্থাৎ, তিনি সোনার মত উজ্জ্বল প্রভাযুক্ত। তা মা সরস্বতী কোথায় বিরাজ করেন? ঘুরেফিরে সেই শুরুর কথা - হৃদয়কমলবনে, হৃদয়কে আলোকিত করে থাকেন। 


আমার হৃদয়ে যেহেতু স্বয়ং পরমজ্ঞানদাত্রী বিরাজ করেন, ফলে আমার অন্তরে চিরবসন্ত আর সেখানে ডালে ডালে বসন্তের অগ্রদূত কোকিল ডাকে। অন্তরে চিরবসন্ত অর্থাৎ মন নিত্য সৃজনশীল, নিত্য ক্রিয়াশীল, নিত্য চিন্তাশীল - সেখানে ক্রমাগত শ্রবণ মনন আর নিদিধ্যাসন ঘটে চলেছে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, 'if the cuckoo sings, can spring be far behind?' বসন্তে কোকিলের ডাকের সাথেই শুরু হয় নতুন পাতার উদ্গম, নতুন প্রাণের সঞ্চার - নতুন সৃজনের আভাস পাওয়া যায় - নতুন আশা, নতুন আকাঙ্খা, নবযৌবন। আধাত্মপথের পথিকের ক্ষেত্রে এর অর্থ নতুন উদ্যম, নতুন করে কাজে লেগে পড়া, যাতে মায়ের কৃপায় এই শরীরেই মনুষ্যজন্মের আসল উদ্দেশ্য সাধন করা সম্ভব হয়।


'মানসমধুপ', অর্থাৎ আমার মনরূপী ভ্রমর, এই হৃদকাননের পরিমলে অর্থাৎ পুষ্পসৌরভে কমলাসনা দেবীর পদতলে মুর্চ্ছিত হয়ে আছে। এ মূর্ছার অর্থ কি? পার্থিব চাওয়া-পাওয়া, লোভ-লালসা ইত্যাদির চাহিদা লোপ পাওয়া, সেই অর্থে সংজ্ঞাহীন হওয়া, আর চেতনের সৌরভে সুরভিত হওয়া। 


দেবী অন্তরালবাসিনী। মনের গহনে লুকিয়ে রয়েছেন। আসলে, আমার মনের মধ্যে 'আমি' সম্পর্কে যে প্ৰশ্ন জাগরিত হয়েছে, যা ধীরে ধীরে আমায় আধ্যাত্মপথের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেই প্রশ্নের অন্তরেই সারদার বাস। সেই মুর্তিমতী জ্ঞানকে এই বিশেষ দিনে শুভ্রা, হংসবাহিনী মূর্তিতে চোখের সামনে প্রকাশিত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তিনি বলছেন, "এস দেবী এস, এ আলোকে, একবার তোরে হেরি চোখে"। এখানে তাঁর নিরাকারকে সাকারে দেখার তীব্র ইচ্ছাই প্রকাশিত হচ্ছে।

No comments:

Post a Comment