Tuesday, February 13, 2024

মা বিশালাক্ষ্মী, কাশী

আজ বলবো গত ৭ই ফেব্রুয়ারি রাতে কাশীতে হটাৎই অযাচিতভাবে মা বিশালাক্ষ্মীর দর্শন পাওয়ার সৌভাগ্যের কথা। লক্ষ্য করে দেখেছি, আমার ক্ষেত্রে দেবদর্শনের সংযোগগুলি অদ্ভুতভাবেই ঘটে, খুব যে একটা পূর্বযোজনা অনুযায়ী চলা যায়, তা কিন্তু সচারচর নয়। কাশীর পবিত্র ভূমিতে ছয়টি এমন পূণ্যক্ষেত্র আছে যেগুলি ষষ্ঠাঙ্গ যোগের দ্যতক - বাবা বিশ্বনাথের মন্দির, মা বিশালাক্ষ্মীর মন্দির, মা গঙ্গা স্বয়ং, বাবা কালভৈরবের মন্দির (যিনি মা বিশালাক্ষ্মীর ভৈরবও বটে), ধুন্ডি বিনায়ক মন্দির (শিব-পার্বতীপুত্র শ্রীগণেশের মন্দির) আর দণ্ডপাণির শিবমন্দির - এগুলি অবশ্য গন্তব্য। এবারে কাশীতে শেষদিনে বড্ড অসুস্থ হয়ে পড়ায় শেষ দুটি মন্দির এবারে আর দর্শন করা সম্ভব হয়নি, পরেরবার শুরুই করবো ওখান থেকে। 

যাইহোক, এক শুভানুধ্যায়ীনি মা বিশালাক্ষ্মীকে দর্শন করার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন যে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরের পাশের এক গলিতে এই মন্দির। কাশী বিশ্বনাথ করিডোরের মধ্যে এখন অনেকগুলি প্রাচীন মন্দির সমাহিত, এবং সেখানে একটি বিশালাক্ষ্মীর মন্দিরও আছে, ফলে আমি ভেবেছিলাম বোধহয় এইটির কথাই তিনি লিখেছিলেন। খটকা লাগলো যখন বিশ্বনাথ গলিতে একদিন সকালে দক্ষিণভারতীয় এক যুবক রাস্তায় আমার কাছে বিশালাক্ষ্মী মন্দিরের পথনির্দেশ চাইলেন কারণ তিনি সদ্য বাবাকে দর্শন করেই বেরিয়েছিলেন। 

সেইদিনই রাতের শৃঙ্গার আরতি দর্শন করে আর বেশি হাঁটতে ইচ্ছে করছিল না কারণ তার আগেই ধর্মশালায় আমার বেশ বারকয়েক বমি হয়ে গিয়েছিল। তাই পুলিশকে ওই করিডোর থেকে দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে যাওয়ার কোনো শর্টকাট আছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে উনি গঙ্গার দিকে 'উডিপি টু মুম্বাই' রেস্টুরেন্টের ঠিক লাগোয়া ডানদিকের একটি গলি দেখিয়ে দিলেন যা মিরঘাট লাহোরিটোলা হয়ে এঁকেবেঁকে দশাশ্বমেধ পৌঁছে যায়। বেশ রাত, প্রায় নিঝুম গলি, দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু করেছে, আমরা দুজন বাঁ দিক ডানদিক করতে করতে কখনো আন্দাজে কখনো দিশা জিজ্ঞেস করে হাঁটছি, হটাৎ এক বাঁকের ঠিক আগে মাথার ওপর দেখি এক প্রায়ান্ধকার বোর্ডে লেখা 'শ্রীকাশী বিশালাক্ষ্মী মন্দির'। মাথার ভেতর কে যেন হটাৎ একটা টোকা মেরে বললো - এটাই।

ঘুরতেই ডানহাতে মন্দির, দরজার ওপর দক্ষিণভারতীয় কোনো ভাষায় কিসব যেন লেখা, ভেতরে একটি দক্ষিণভারতীয় ভক্ত পরিবার পূজারত, এমনকি বাইরে, ফটকের ডানহাতে যে বৃদ্ধা গোলাপের মালা ইত্যাদি নিয়ে বসে আছেন, তিনিও দক্ষিণ ভারতীয় এবং আমাদের দেখে নিজের ভাষায় কি যে বললেন কিছুই বোধগম্য হলো না, বোধহয় পূজার সামগ্রী নেবার কথা বলছিলেন। ভেতরে উঁকি মারতেই দেখি সামনেই মা - একেবারে জ্বলজ্বল করছেন। 

বিশালাক্ষ্মী অর্থাৎ বিশাল আঁখি যাঁর - সত্যিই বিশাল নেত্রদ্বয় মায়ের। এই সতীপীঠে হয় মায়ের আঁখি পড়েছিল (যার সম্ভাবনা সমূহ) অথবা কানের মণিকুন্তল, যদিও পুরোহিত বললেন দেবীভাগবৎ পুরাণের মতে মায়ের গোটা মুখটাই নাকি এখানে পড়েছিল, এখন মাতৃমূর্তির পেছনে সযত্নে সুরক্ষিত আছে। কুলার্নব তন্ত্রে যে অষ্টাদশ পীঠের উল্লেখ আছে সেই তালিকায় এটি ষষ্ঠ। কেন দক্ষিণ ভারতীয় ভক্তদের এত উৎসাহ জানতে গিয়ে জানা গেল যে তাঁরা মূলত তিনরূপে দেবীমহাশক্তির উপাসক - বিশালাক্ষ্মী, কামাক্ষ্মী এবং মিনাক্ষ্মী, বাকি দুজন দক্ষিনেই আছেন, ফলে অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য, কেবল ইনি কাশীতে, ফলে ওঁর প্রতি দক্ষিণীদের এত আকর্ষণ। কাশী-তামিল সঙ্গমের বিষয়টি যে কোন স্তরে কত গভীরভাবে ব্যঞ্জনাময়, সেটা বোধগম্য হলো এতদিনে। 

এক অচেনা গলিতে হটাৎ করে মন্দিরটি আবিষ্কার করার সময়ই আমার স্থির বিশ্বাস জন্মেছিল যে আমি মা বিশালাক্ষ্মীকে দর্শন করতে যাইনি, উনিই অহেতুকি কৃপা করে টেনে এনে আমায় দর্শন দিয়েছেন। আমি তো জানতাম করিডোরের ভেতরেই আমার ওঁকে দর্শন করা হয়ে গেছে কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতি উনি সৃষ্টি করলেন যাতে ওঁর মন্দিরের রাস্তা আমায় ধরতেই হয় এবং বেশ রাতে প্রায় ফাঁকা মন্দিরে একদম সামনে থেকে দুচোখ ভরে আমি ওঁকে দেখতে পারি, ওঁকে প্রণাম করতে পারি, চরণামৃত পান করতে পারি। কি অপূর্ব মা আমার, নিকষ কালো, ডাগর আঁখি, সুগন্ধি ফুলের মালার অঙ্গরাগে সুসজ্জিতা। ওই চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মাথার ভেতর কেমন কেমন যেন লাগে, মনে হয় এবার বোধহয় বাহ্যজ্ঞান লোপ পাবে। ছবি তোলা নিষেধ না থাকলে মায়ের সেদিনের রূপ আপনাদেরও দেখাতে পারতাম, আপাতত সেটি আমার মনের মধ্যে ধরা আছে। যে ছবিটি দিলাম সেটি নেট থেকে নেওয়া। বাকি ছবিগুলি মন্দিরের বহিরঙ্গের।

No comments:

Post a Comment