আজ সকালে তীর্থযাত্রা সেরে বাড়ি ফিরে এসেছি কিন্তু মন জুড়ে শুধুই তাঁরা সবাই, যাঁদের সান্নিধ্যে গত একটা সপ্তাহ কাটিয়ে এলাম। চোখ বন্ধ করে তো বটেই, চোখ খুলেও তাঁদেরকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। গত ৫ই ফেব্রুয়ারি কাশীতে নেমেই এযাত্রায় প্রথম দর্শন করেছিলাম সঙ্কটমোচনকে। এখনো আমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছি আর ঠিক তাঁর বুক বরাবর উল্টোদিকের এক অতি প্রাচীন মন্দিরে বিরাজমান তাঁর ইষ্টদেবকেও, যাঁকে এই মুহূর্তেও হৃদয়ে ধারণ করে তিনি মর্তে বিরাজ করছেন।
আজ যখনই চোখের সামনে সঙ্কটমোচন ভেসে উঠছেন অমনি মনে পড়ছে তুলসীদাসবাবাজিকেও কারণ তাঁর নিজের হাতে মাটি দিয়ে গড়া ওই অপুরূপ বিগ্রহের মধ্যেই শুধু নয়, তুলসী ছড়িয়ে আছেন ওই ভূমির প্রতিটি কণায়। রচিত হওয়ার সাথে সাথে মানসের কত না দোহা প্রথম শুনেছেন তাঁর প্রাণনাথ আমাদের বাল ব্রহ্মচারী, ওখানকার জঙ্গলের বৃক্ষরাজি, ওখানকার আকাশ, বাতাস, মাটি।
এখনো ক্রমাগত তাঁর রচিত স্তবই পাঠ হয়ে চলেছে ওই মন্দির চত্বরে, কথক লাগাতার ব্যাখ্যা করে চলেছেন মানসের, ভক্তরা তাঁরই প্রদর্শিত পথে ওখানে যে যাঁর মতন জায়গা খুঁজে নিয়ে রামনামের জপে-ধ্যানে মগ্ন। আমাকে একজন মহাত্মা বলেছিলেন যে মহাবীরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গেলে তাঁর সামনে আর তাঁর নিজের সুখ্যাত করতে নেই, রামের গুণগান গাইতে হয়, তাহলেই উনি যারপরনাই প্রসন্ন হন।
গেট থেকে বাগানের পথ পেরিয়ে আমি যখন তাঁকে দর্শন করতে পৌঁছিয়েছিলাম তখন মন্দিরে বেশ কয়েকজন সমবেত কণ্ঠে জোরে জোরে হনুমান চল্লিশা পাঠ করছিলেন, আমি চুপ করে এককোণে দাঁড়িয়ে প্রথমে মন দিয়ে গোটাটা শুনলাম। তারপর তাঁদের পাঠ শেষ হলে 'জয় রাম জয় রাম জয় জয় রাম' গাইতে গাইতে মহাবীরের সামনে যেতেই কেন জানি না অনুভব হলো যে উনি আমার গান শুনছেন - আমার মুখের দিকে তাকিয়ে উনি রাম নাম শুনছেন।
ভিড় না থাকলেও লাইন তো একটা ছিলই কিন্তু কেউ আমায় ধাক্কা দিলেন না, কেউ ঠেলে সরিয়ে দিলেন না, ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিশ্চিন্তে তিন তিনবার গোটা নামমন্ত্রটা গাইলাম, তারপর প্রণাম করে ওনার সামনে থেকে চুপচাপ বাঁদিকে সরে গেলাম - এটা আমার মনে আছে। যতক্ষন আমি ওনার সামনে ছিলাম, আমার এই ক্ষীণদৃষ্টি নিয়েই ওই মেটে সিঁদুরের প্রলেপ ভেদ করে ওনার চোখদুটিকে একটু ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করছিলাম আর আমি নিশ্চিত যে উনিও মাথাটা সামান্য বেঁকিয়ে একদৃষ্টিতে আমার দিকেই তখন তাকিয়েছিলেন।
তুলসী লিখেছিলেন 'শঙ্কর সুবন কেশরী নন্দন, তেজ প্রতাপ মহাজগবন্দন', যদিও তুলসীপীঠাধিশ্বর স্বামী রামভদ্রাচার্য্যজির মতে ওটা ভুল, আসলে তুলসী লিখেছিলেন 'শঙ্কর স্বয়ং কেশরী নন্দন, তেজ প্রতাপ মহাজগবন্দন', যা পরে সাধারণ মানুষের মুখে 'সুবন' হয়ে যায়। আসলে, কেশরী নন্দন মহাদেবের অবতারই হন বা মহাদেব স্বয়ং, তাতে সত্যিই কিই বা আসে যায়?
দেখি কখনো তিনি রামেশ্বররূপে শ্রীরামচন্দ্রের আরাধ্য, আবার কখনো হনুমানরূপে শ্রীরামচন্দ্রই তাঁর আরাধ্য, এখানে কে ভক্ত আর কেই বা ভগবান, সবই তো এক! ওখানে প্রদক্ষিণ করতে করতে এই কথাটাই ভাবছিলাম আর মনে পড়ে যাচ্ছিল ঠাকুর বলতেন 'ভাগবত ভক্ত ভগবান, তিন এক'। শিব, মহাবীর, রাম, মানস, কাশী - সব এক, সব এক।
সঙ্কটমোচনে কাশীপতি আর অযোধ্যাপতি দুজনে যেন মিলেমিশে যাচ্ছেন, আবার মন চাইলে আলাদা আলাদা হয়েই চোখের সামনে এখন ভেসেও উঠছেন। এঁদের মধ্যে কে যে কার ভক্ত আর কে যে কার আরাধ্য, তাঁরাই জানেন। মা বলতেন না, 'যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন' - ওটাই সার কথা। সঙ্গে একটি ছবি দিলাম রাম-জানকি মন্দিরের গর্ভগৃহের, অত সুন্দর রামমূর্তি আমি খুবই কম দেখেছি। পরেরবার যখন কাশী যাবো তখন ঐ মন্দিরে দীর্ঘক্ষণ কাটানোর ইচ্ছা প্রবল।
No comments:
Post a Comment