বৃক্ষেই প্রত্যক্ষ
নর্মদার তীরে অখন্ড নিরাহার অবস্থায় দাদাগুরু নামক এক যোগী মহাত্মা আছেন, ইউটিউবে ওঁর একটি অনবদ্য বাণী শুনলাম, "बृक्ष ही प्रत्यक्ष है", অর্থাৎ বৃক্ষই (তাঁর) প্রত্যক্ষ রূপ। যখন থেকে শুনেছি তখন থেকে মনের মধ্যে ক্রমাগত বাক্যটি ঘুরে চলেছে আর যত ভাবছি তত ধীরে ধীরে এর গুঢ়ার্থ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। কত রকমের angle যে এই ছোট্ট কথাটার মধ্যে আছে, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। এ যেন সেই উপনিষদীয় মহাবাক্যের মতো - codified - যত ছাড়াবে তত ভেতরের শাঁস বেরোবে। ওই মধ্যপ্রদেশেই একজন স্বামী চিদানন্দ মহারাজ আছেন, উনি আবার বৃক্ষকেই প্রত্যক্ষ শিব বলেন (वृक्ष ही प्रत्यक्ष शिव हैं, जो कार्बन डाइऑक्साइड रूपी विष को ग्रहण कर हमें अमृत रूपी ऑक्सीजन दान देते हैं) কারণ বৃক্ষ কার্বনডাইঅক্সাইডরূপী বিষ নিজে গ্রহণ করে আমাদের অক্সিজেনরূপী প্রাণবায়ু প্রদান করে।
আমার মনে পড়ছে আসানসোলে বাবার সরকারি বাংলোর গেটে ঢোকার মুখে বাঁ ধারে একটা অর্জুন গাছ ছিল। অর্জুন শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ঋজু শব্দ থেকে। ঋজু মানে একদিকে যেমন সোজা, straight, আবার অন্যদিকে সরল। কারো সরল স্বভাব মানে কিন্তু তাঁর সংস্কার অতি উচ্চমানের, এ এক দারুন strength। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতের অর্জুনকে বলছেন দেহাভিমান জয় করতে হলে শরীর, মন ও বাণী সরল হতে হবে, প্যাঁচঘোঁচ থাকলে চলবে না বাপু। আমাদের সেই অর্জুন গাছটি ছিল সরলতার প্রতিমূর্তি - কেউ তার বাকল ছিঁড়ে নিয়ে যেত বেটে খোশ পাঁচড়ায় লাগাবে বলে, কেউ তার পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যেত ফুটিয়ে কত্থটি আমাশয়ের ওষুধ হিসেবে খাবে বলে, পারলে কেউ তার কান্ডটাও হয়তো কেটে নিয়ে যেত গরুর গাড়ির চাকা বানাবে বলে, ভাগ্যক্রমে আমরা থাকাকালীন সেটা আর সম্ভব হয়নি। কাউকে কোনোদিন ওর গোড়ায় জল বা সার কিছুই দিতে দেখিনি - ও গাছ কেবল দিত, নিত না কিছুই।
আসলে আমাদের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে বৃক্ষ বারবার ফিরে এসেছে ত্যাগের প্রতীক হয়ে। পুরাণে যে কল্পতরুর কথা বলা আছে, সেই বৃক্ষের কাছে যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়। তাই যেদিন কাশীপুর বাগানবাড়িতে একটি বৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেব ভক্তবাঞ্ছা কল্পতরুরূপে ধরা দিয়ে বলেছিলেন, "আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হোক", সেইদিনটি কল্পতরু দিবস হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে। এক শতাব্দীরও বেশি সময় হলো ঠাকুরের শরীর চলে গেছে কিন্তু সেদিনের সেই ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে সেই বৃক্ষটি কিন্তু আজও রয়ে গেছে - মানুষ ওখানে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে। একইভাবে রয়ে গেছে কামারপুকুরে ঠাকুরের নিজের হাতে পোঁতা আমের আঁটির গাছ, ঠাকুরের স্মৃতি হিসেবে যার একটি পাতা আমাদের বাড়িতেও সংরক্ষিত আছে। এই বৃক্ষগুলিকে দেখলে ঠাকুরের কথা মনে পড়ে - ওরা যেন ঠাকুরেরই extension, তাঁরই লীলাসঙ্গী।
একই কথা বুদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বুদ্ধদেবের সময়কার সেই অশ্বথ গাছটি আর বেঁচে নেই, কিন্তু বুদ্ধদেবের সেই লীলাসঙ্গীর সন্তান সন্ততিরা ছড়িয়ে রয়েছে সারা বিশ্বজুড়ে। সাধনকালে বোধিবৃক্ষ বুদ্ধদেবকে ছায়া প্রদান করেছিল বলে পরে তিনি ওই বোধিবৃক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। এখনও ভক্তদের মনে বুদ্ধদেবের স্মৃতিকে নতুন করে জাগরিত করতে প্রতিটি বৌদ্ধবিহারে বোধিবৃক্ষের উপস্থিতি একান্তই আবশ্যক। এমনকি সম্রাট অশোক তার পুত্র মহেন্দ্র ও তার কন্যা সংঘমিত্রাকে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে সিংহলে পাঠানোর সময় ওই বোধিবৃক্ষের চারাই সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। এখনো শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধরা পবিত্র বোধিবৃক্ষের শাখাতেই পরলোকগত জ্ঞাতিবর্গের উদ্দেশে শ্বেতবর্ণের কাপড়ের তৈরি স্তম্ভক আকৃতির অর্ঘ টাঙিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন।
দেখছি শান্তিনিকেতনে দশম সাম্বৎসরিক ব্রহ্মোৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বক্তৃতায় সবটা কেমন সুন্দরভাবে মিলিয়ে দিচ্ছেন। আচার্য্য বলছেন, "বৃক্ষে যে ফল থাকে সে ফল হইতে রস আকর্ষণ করিয়া পরিপক্ব হইয়া উঠে। যতই সে পরিপক্ব হইতে থাকে ততই বৃক্ষের সহিত তাহার বৃন্তবন্ধন শিথিল হইয়া আসে, অবশেষে তাহার অভ্যন্তরস্থ বীজ সুপরিণত হইয়া উঠিলে বৃক্ষ হইতে সে সহজেই বিচ্ছিন্ন হইয়া বীজকে সার্থক করিয়া তোলে। আমরাও সংসারবৃক্ষ হইতে সেইরূপ বিচিত্র রস আকর্ষণ করি-- মনে হইতে পারে তাহাতে সংসারের সহিত আমাদের সম্বন্ধ ক্রমেই দৃঢ় হইবে-- কিন্তু তাহা নহে, আত্মার যথার্থ পরিণতি হইলে বন্ধন আপনি শিথিল হইয়া আসে। ফলের সহিত আমাদের প্রভেদ এই যে, আত্মা সচেতন; রস নির্ব্বাচন ও আকর্ষণ বহুল পরিমাণে আমাদের স্বায়ত্ত।
"আত্মার পরিণতির প্রতি লক্ষ করিয়া বিচারপূর্ব্বক সংসার হইতে রস গ্রহণ ও বর্জ্জন করিতে পারিলেই সংসারের উদ্দেশ্য সফল হয় এবং সেই সঙ্গে আত্মার সফলতা সম্পন্ন হইলে সংসারের কল্যাণবন্ধন সহজেই শিথিল হইয়া আসে। অতএব ঈশ্বরের দ্বারা সমস্ত আচ্ছন্ন জানিয়া সংসারকে তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা, তাঁহার দত্ত সুখসমৃদ্ধির দ্বারা ভোগ করিবে-- সংসারকে শেষ পরিণাম বলিয়া ভোগ করিতে চেষ্টা করিবে না। অপর পক্ষে সংসারের বৃন্তবন্ধন বলপূর্ব্বক বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহার মঙ্গলরস হইতে আত্মাকে বঞ্চিত করিবে না । ঈশ্বর এই সংসারবৃক্ষের সহস্র তন্তুর মধ্য দিয়া আমাদের আত্মার কল্যাণরস প্রেরণ করেন; এই জীবধারয়িতা বিপুল বনস্পতি হইতে দম্ভভরে পৃথক্ হইয়া নিজের রস নিজে যোগাইবার ক্ষমতা নাই।"
বিভিন্ন আধ্যাত্মিক আলোচনায় 'দেহবৃক্ষ' শব্দটিরও একটি বিশেষ মাহাত্ম আছে, অর্থাৎ দেহকে বৃক্ষের সাথে তুলনা করে একটা বৌদ্ধিক allegory টানা হয় - বৃক্ষের ক্ষেত্রে যেমন জাইলেমের মাধ্যমে জল ও খনিজ পোষণ মাটির নিচ থেকে ওপরে পাতা অবধি ওঠে, তেমনি দেহের মূলাধারে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকা কুলকুন্ডলিনী যোগক্রিয়ার মাধ্যমে ব্রহ্মতালুতে অর্থাৎ সহস্ররারে গিয়ে পৌঁছয়। অন্যভাবেও, মানবদেহকে নানা মতাবলম্বীরা নানাভাবে বৃক্ষের সাথে তুলনা করেছেন - সেই গোবিন্দ দাসের কড়চায় আছে না,
এই বিশ্ব ঢাকিয়াছে পাপ অন্ধকারে ।
হরি ভিন্ন কিছু সত্য নাহিক সংসারে ।।
পাখি দুটি দেহবৃক্ষ যেদিন ছাড়িবে ।
সেদিন জড় দেহ পড়িয়া রহিবে ।।
তখন শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে কাশীপুরের বাগানবাড়িতে আছেন, সেদিন শুক্রবার বেলা ৫টা, চৈত্র শুক্লা পঞ্চমী। ৯ই এপ্রিল, ১৮৮৬। ঠাকুর বলছেন,
"হৃষীকেশের সাধু এসেছিল। সে (আমাকে) বললে, কি আশ্চর্য! তোমাতে পাঁচপ্রকার সমাধি দেখলাম!
"কখন কপিবৎ — দেহবৃক্ষে বানরের ন্যায় মহাবায়ু যেন এ-ডাল থেকে ও-ডালে একেবারে লাফ দিয়ে উঠে, আর সমাধি হয়।
"কখন মীনবৎ — মাছ যেমন জলের ভিতরে সড়াৎ সড়াৎ করে যায় আর সুখে বেড়ায়, তেমনি মহাবায়ু দেহের ভিতর চলতে থাকে আর সমাধি হয়।
"কখন বা পক্ষীবৎ — দেহবৃক্ষে পাখির ন্যায় কখনও এডালে কখনও ও-ডালে।
"কখন পিপীলিকাবৎ — মহাবায়ু পিঁপড়ের মতো একটু একটু করে ভিতরে উঠতে থাকে, তারপর সহস্রারে বায়ু উঠলে সমাধি হয়।
"কখন বা তির্যক্বৎ — অর্থাৎ মাহবায়ুর গতি সর্পের ন্যায় আঁকা-ব্যাঁকা; তারপর সহস্রারে গিয়ে সমাধি।”
শেষ করছি আমাদের সনাতন সংস্কৃতিতে প্রত্যক্ষ ব্রহ্মরূপী বৃক্ষের কি স্থান, প্রাচীন text থেকে তার উদাহরণ দিয়ে। নিশ্চয় জানা আছে যে অত্যন্ত প্রয়োজনে কোনো জীবিত বৃক্ষকে কাটার আগে তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে তার প্রাণ বিসর্জনের রীতি এখনো এ দেশে প্রচলিত আছে। তিনটি মাত্র উদ্ধৃতি দেবো, আমাদের সভ্যতার অন্তরাত্মাকে বোঝার জন্য তাই যথেষ্ট:
১. যদি কোন দরিদ্র ব্যক্তি একটিমাত্র গাছও রোপণ করেন তবে তিনি ব্রহ্মসদনে যাবার অধিকার অর্জন করেন এবং তার তৃতীয় পুরুষ পর্যন্ত সেই ফল ভোগ করে। (ব্রহ্মনারদীয় পুরাণ, ১৩/৫২)
২. উদ্ভিদাদি রোপণ ও পরিচর্যা করলে ভূমিদান ও গোদানের সমতুল্য পুণ্য অর্জিত হয়। (বরাহপুরাণ, ১৭২/৩৫)
৩. যদি কেউ স্বীয় রন্ধনের উদ্দেশ্যে জ্বালানির জন্য অপরিপক্ক বৃক্ষ ভূপাতিত করে তবে তাকে চরম পতিত বলে গণ্য করা হবে। (মনুস্মৃতি, ১১/৬৬)
No comments:
Post a Comment