একদিকে আব্রাহামীয় বা কম্যুনিস্টদের 'একটাই জীবন - খাও পিও ঔর মৌজ করো', যাকে one life consumption model বলে আর অন্যদিকে ভারতের সেই সনাতন ঋষিবাক্য 'শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা' - বিশ্ববাসী, তুমি অমৃতের পুত্র, তুমি মৃত্যুহীন - বহু শতাব্দী জুড়ে বৌদ্ধিকস্তরে এই দুই বিপরীতমেরুর দ্বন্ধ চলছে তো চলছেই। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যখন এক জীবনে বিশ্বাসী অসনাতনীরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যেকার একাংশের মতের প্রভুত্ব অন্যদের ওপর কায়েম করতে চায়, তখন এই দ্বন্ধ চরম সংঘাতে পর্য্যবসিত হয় এবং ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো কিছুসময়ের জন্য তা আবার ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে এবং ব্যাপক লোকক্ষয়ের কারণ হবে। সবের মূলে কিন্তু জীবনে চলার পথে শুভ আর অশুভের মধ্যে থেকে অনেক সংখ্যক মানুষের অশুভকে বরণ করে নেওয়া। বেশিদূর যেতে হবে না, এই তো সেদিন ১৯৬৬-৭৬ চিনে cultural revolution হলো, ঈশ্বরই জানেন আসলে কত মানুষ সেই পাগলামোতে প্রাণ খোয়ালেন।
ঠিক তার আগেই ১৯৬২তে চিন কেন ভারত আক্রমণ করেছিল জানেন? রকমারি থিওরি শোনা যায় বটে কিন্তু আসল কারণ হলো তার আগের ২০০০ বছর ধরে চিনারা ভারতীয় আধ্যাত্মিক জ্ঞানতন্ত্র এবং মন্দির বাস্তুতন্ত্রের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত ছিলেন যে মাও জে দংকে সেই মানসিক অবকাঠামো ভাঙতে হলে আগে ভারতকে চিনবাসীর চোখে হেয় প্রতিপন্ন করতে হতো - তিনি ঠিক সেটাই করেছিলেন। চিনারা মানসিকভাবে এমনই যে ও দেশে যদি রাস্তায় কেউ কাউকে bully করে, যে bully হয় লোকে উল্টে তাকেই ঘিরে ধরে দুয়ো দেয়, কমজোরের প্রতি সহানুভূতি চিনাদের রক্তে নেই, ওঁরা শক্তের ভক্ত। আর এই গাজোয়ারী মানসিকতাকেই মাও চার বছর পরে কম্যুনিজম কায়েম করার কাজে ভরপুর লাগিয়েছিলেন।
সেদিন পড়লাম কে যেন লিখেছেন যে এখনকার চিনারা ভারতীয়দের নাকি হীনদৃষ্টিতে দেখেন কারণ ১০০০ বছর ধরে আমরা নিজেরাই নিজেদের জাতভাইদের পরের গোলামী মেনে নিতে বাধ্য করেছি। কতজনই বা ইংরেজ থাকতো ভারতবর্ষে, ভারতীয় চাকরদের দিয়েই তো তারা এত কোটি ভারতীয়দের ওপর দুশো বছর ধরে শাসন চালিয়ে গেল। মুঘল আমলেও তাই। ব্যাপারটা পড়ে আমার মনে হলো কেউ কি চিনাদের জিজ্ঞেস করবেন যে এই যে cultural revolutionএর নামে কোটি কোটি চিনার গলা কেটে নামিয়ে দেওয়া হলো - কে কাটলো রে ভাই? নিজেরাই নিজেদের কাটলেন তো, তাহলে আবার এত বড় বড় কথা কিসের? আসলে বিষয়টা তা নয়, একটা জীবনদর্শনকে শেষ করে দিতে গেলে তার মূলে আঘাত করতে হয়। ফলে মাওয়ের প্রোপাগান্ডা মেশিনারি পুরোদমে সক্রিয় ছিল ভারত, ভারতীয়তা, ভারতীয় সভ্যতা, ভারতীয় সংস্কৃতি, ভারতীয় ধর্মবোধ এবং ভারতীয় দর্শনকে চিনাদের মাথা থেকে মুছে ফেলতে, এবং তার জন্য সবচেয়ে সহজ উপায়টাই তারা বেছে নিয়েছিল, যা আজও সমানভাবে সক্রিয়। ভারত অর্থাৎ সনাতন ধর্মবোধযুক্ত একমাত্র জীবিত প্রাচীন সভ্যতা।
এই যে one life থিওরি, এরই একটা অব্যর্থ পরিণতি হলো radicalisation বা অতিবাদ-মনস্কতার বৃদ্ধি। মানুষের সামনে যদি কোনো বৃহত্তর লক্ষ্য না থাকে, যদি কর্মফল ভোগ করা এবং কর্মফল ত্যাগ করে মোক্ষপ্রাপ্তিই উদ্দেশ্য এবং নিজের যাপনের মাধ্যমে তা সাধিত করার উপায় না থাকে তাহলে তাৎক্ষণিক সুখ ছাড়া তার আর জীবনে চাওয়ার কিই বা থাকতে পারে? আজকের হামাস বা দায়েশ বা হিজবুল্লারা যতটা অতিবাদী, পল পট বা মাও বা স্ট্যালিনের cultও ঠিক ততটাই অতিবাদী - ফারাক কেবল ফলিত প্রয়োগে। যে কোনো অতিবাদের পেছনে আবার একটাই মূল factor - অতিলোভ। বৌদ্ধিকতার আড়ে বিশ্বের ইতিহাসে এই লোভে লোভে ঠোকাঠুকি যত হয়েছে, সত্যিকারের বৈচারিক বিবাদ তার ধারে কাছেও হয়নি। আর লোভ মানেই গা জোয়ারী, যা স্বাভাবিক উপায়ে পাওয়ার উপায় নাই তাকে জোর করে কেড়ে নিতে হবে, তা সে আনুগত্য হোক বা অনুগ্রহ।
একটু তলিয়ে ভাবলেই দেখবেন যে consumerism এর মূলে হলো want আর profit - একদলের রাস্তা হলো মানুষের মনে একটা চাহিদা তৈরি করো, সেই চাহিদা পূরণ করার একটা তন্ত্র বানাও, খুব মাল বেচো আর মুনাফা কামাও আর অন্যদলের রাস্তা হলো যা আছে তার চেয়ে অন্যরকম কিছু চাই, নতুন কিছু চাই যা আমায় নতুন করে সুখ দেবে আর যা পাওয়ার জন্য আমি নিজেকে বিকিয়ে দিতেও রাজি আছি। এবার সেই want যদি সেকালে বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার উৎস হয়ে ওঠা হয় তাহলে তার তন্ত্র হলো চার্চ আর গ্যালিলিওর গৃহবন্ধি হওয়া, যদি আজকের সময়ের narcotics বা অবৈধ অস্ত্র হয় তাহলে তার তন্ত্র হলো জিহাদের নামে ইসলামিস্ট সন্ত্রাসবাদ, যদি দেশের মানুষের সম্মিলিত সম্পদকে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের ভোগযোগ্য সম্পদে পরিণত করতে হয় তাহলে তার তন্ত্র হলো কম্যুনিস্ট শাসনব্যবস্থা, যদি সারা বিশ্বকে নিঃস্ব করে নিজেদের দেশকে ধনবান করতে হয় তাহলে তার তন্ত্র হলো ছদ্মসাম্রাজ্যবাদ আর যদি বিশ্বের বৃহৎ ধনীদের পকেট আরো ভরতে হয় তাহলে তার তন্ত্র হলো যুদ্ধ আর মহামারি - আখেরে তো এই।
হামাস, হুতি, হিজবুল্লাহ আর ইরানি শিয়া জঙ্গিরা সব একসাথে ইজরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে দেখে আমরা কেউ কি একটুও আশ্চর্য্য হচ্ছি? এটাই তো হওয়ার ছিল কারণ অসনাতনীদের জমি দখলের লড়াই চিরকাল নিজেদের পন্থীয় অথবা মতবাদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিকে সামনে রেখেই করা হয়ে এসেছে। আসলে পন্থসহ যে জীবনদর্শনের ভিত্তিটাই transactional, সেখানে মানুষে মানুষে সম্পৰ্কটাও তো তাইই। সনাতনীদের বৈদিক বিবাহপদ্ধতি বিচ্ছেদবিহীন আর আব্রাহামীয়দের বিবাহ নিকাহনামা নামক চুক্তিভিত্তিক - কেন? সনাতনীর সন্তান জন্মসূত্রেই সনাতনী আর আব্রাহামীয়দের সন্তানকে baptise করে পন্থগ্রহণ করাতে হয় - কেন? সনাতনী মৃত্যুর পর শরীরকে পঞ্চভূতে বিলীন করে দেয় আর অসনাতনী শেষ বিচারের অপেক্ষায় কফিনে শুয়ে থাকে - কেন?
সনাতনী আর অসনাতনীদের মধ্যে এই যে সম্পুর্ন দুই বিপরীতমুখী জীবনদর্শন, এরই ফলে সনাতনী কারো ওপর কোনোদিন কোনোকিছু জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়না - সে জানে যা কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তা সাময়িক আর যা কিছুই সাময়িক তাই অনিত্য, ফলে মূলত অসত্য। আর যা সত্য, যা সনাতন, তা জাগতিক লেনদেনে নেই, তার খোঁজ আছে অদ্বৈত বেদান্তে। এই জন্যই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে বিশ্বের অগ্রণী শক্তি হওয়া সত্ত্বেও ভারত কোনোদিন কাউকে আক্রমণ করেনি, উল্টে বিশ্বের সমস্ত আক্রান্তাদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। নিঃস্বার্থভাবে ভারত জ্ঞান বিতরণ করেছে, বিনিময়ে কোনো কিছুই সে চায়নি। বিশ্বজুড়ে এত সভ্যতার উদয় হয়েছে, কিন্তু একমাত্র ভারতীয় সভ্যতা ছাড়া তারা সব আজ অস্তমিত, অলক্ষ্যে কোনো তো একটা কারণ আছে, তাই না?
একবার চোখ মেলে চেয়ে দেখুন ভারতের ভেতরে ও বাইরে ইদানিং কি ঘটছে, বুঝতে পারবেন। দেখবেন অযোধ্যায় যখন শ্রীরামজন্মভূমি মন্দির দ্রুত প্রাণপ্রতিষ্ঠার শুভক্ষণের দিকে এগোচ্ছে, সুদূর চিনের গ্রামেগঞ্জে সদ্য রোজগার হারানো সাধারণ মানুষ এতবছর পর আবার বন্ধ হয়ে যাওয়া গ্রাম্য মন্দিরগুলি খুলছেন, তাঁরা ওই মন্দির ecosystemটি ফিরে পেতে আগ্রহী। মন্দির মানে ধ্যান, মানসিক শান্তি, মন্দির মানে দান দক্ষিণা, মন্দির মানে লঙ্গর, মন্দির মানে স্থানীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের রোজগার, মন্দির মানে সামাজিক ধর্মচেতনার উৎস, মন্দির গরিবের আশ্রয়স্থল। খোদ আরবের বুকে এখন বিশালাকায় মন্দির নির্মাণ হচ্ছে, আমেরিকায় হচ্ছে, আফ্রিকা জুড়ে হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে না? এমনকি পাক অধিকৃত কাশ্মীরের তথাকথিত সংসদে resolution নেওয়া হচ্ছে যে মা সরদার বিধ্বস্ত প্রাচীন পূজাস্থল ভক্তদের জন্য আবার খুলে দেওয়া হোক। বিশ্বজুড়ে যত দ্বন্দ্ব বাড়ছে, সংঘাত বাড়ছে, তত বেশি করে হটাৎ মন্দির তৈরি হওয়া বা সংস্কার হওয়াও বেড়ে গেছে, এটা কি লক্ষ্য করেছেন? কেন?
কারণ ধীরে ধীরে মানুষ বুঝতে পারছেন যে one life consumption model পুরোপুরি ফেল করে গেছে, ক্যাপিটালিসম এবং কম্যুনিসম দুটোই অসাড় প্রমাণিত হয়েছে, এবার পন্থীয় অতিবাদেরও শেষ হওয়ার পালা। এই যে মধ্যপ্রাচ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, এর অন্তে অতিবাদীরা নিজেরাই অতিবাদ শেষ করবে, যে প্রক্রিয়াটিকে de-radicalisation বলে। তারপর? শ্রীকৃষ্ণ নিশ্চয় আজকের অর্জুনকে আবার মনে করিয়ে দেবেন, "তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ" - হে কুন্তীপুত্র, যুদ্ধের জন্য কৃতসংকল্প হও, তোমায় নগ্ন ভোগস্পৃহার সাথে নির্ণায়ক লড়াই লড়তে হবে। বিশ্ব যাতে লোভ ঈর্ষা আর ভোগবাদের তাড়না ত্যাগ করে সকলে মিলেমিশে বাঁচার আনন্দ উপভোগ করতে পারে, সেই পথ তুমি দেখাবে। আর কি? আর বোঝাবে, "কেউ পর নয় মা, জগৎ তোমার। যদি শান্তি চাও মা, কারও দোষ দেখোনা। দোষ দেখবে নিজের।"
No comments:
Post a Comment