Wednesday, November 22, 2023

অন্তরতর



রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে ও কবিতায় একাধিকবার 'অন্তরতর' শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যেমন 'অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে, নির্মল করো উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে' অথবা 'কে গো অন্তরতর সে, আমার চেতনা আমার বেদনা তারি সুগভীর পরশে' ইত্যাদি। লক্ষ্য করে দেখেছি যখনই রবীন্দ্রনাথ এই শব্দটি ব্যবহার করে গান বেঁধেছেন, অধিকাংশ সময়ই হয় ইমন নয় ঝিঁঝোটী নয় ভৈরবী রাগের ওপর নির্ভর করেছেন অর্থাৎ যথাক্রমে রাত্রির প্রথম প্রহর, দ্বিতীয় প্রহর ও দিনের প্রথম প্রহরের রাগ, সবকটিই ধ্যানের পক্ষে একেবারে আদর্শ সময়। এখন প্রশ্ন হলো অন্তর মানেই তো ভিতর, তাহলে বিশেষ করে 'অন্তরতর' (যার অর্থও ভিতর) শব্দটি ব্যবহার করার প্রয়োজন কি এবং যদি innermost বলতে হতো তাহলে অন্তরতম কেন ব্যবহৃত হলো না? 

আসলে বিশেষণ হিসেবে অন্তরের অর্থ 'অপর' হলেও, বিশেষ্য হিসেবে অন্তর মানে কিন্তু 'মন' বা 'হৃদয়'। ওদিকে আবার হরিচরণ বন্ধ্যোপাধ্যায় বলছেন বাংলা অন্তরের মূলে হলো সংস্কৃত ‘অনন্তর’, অব্যয় পদ, যার অর্থ 'তাহার পর' বা 'অতঃপর'। ন + ব্যয় = অব্যয় - যার পরিবর্তন বা ব্যয় হয় না, অর্থাৎ যা অপরিবর্তনীয় তাই অব্যয়, এই পদটির বিশেষত্বও এখানে বিবেচ্য। আমার ধারণা এখানে রবীন্দ্রনাথ অন্তর বলতে প্রচলিত অর্থে 'মন'কে এবং অন্তরতর বলতে 'মনের পারে' অর্থাৎ মনের দ্রষ্টাকে বুঝিয়েছেন। মনের যিনি দ্রষ্টা, যিনি তুরীয়, যাঁর বিনাশ নেই, বিন্যাসও নেই, যিনি অপরিবর্তনীয়, তিনিই রবীন্দ্রনাথের অব্যয় পদধর্মী 'অন্তরতর'। 

অন্যদিকে, বাংলা ভাষায় 'অন্তরতম' শব্দটি সাধারণত 'প্রিয়তম' বা 'ঘনিষ্টতম' অর্থে ব্যবহার করা হয়, অর্থাৎ এই শব্দটির মূলে একটা দ্বৈতভাব আছে - আমার প্রিয়তম, অর্থাৎ আমি আর আমার প্রিয়তম দুটি ভিন্ন স্বত্তা। এক্ষেত্রে মনেরও একটা বড় ভূমিকা আছে - মন যাকে সবচেয়ে বেশি প্রিয় মনে করে, তিনিই অন্তরতম। অন্তরতর কিন্তু মনের পারে - তিনি স্থির, নিশ্চল, তিনি খালি মনের গতিবিধি লক্ষ্য করে চলেছেন কিন্তু লিপ্ত হচ্ছেন না। তিনি আত্মা, অবিনশ্বর। তিনি একম্ সৎ, বিপ্রঃ বহুধা বদন্তি, যা নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক ব্রাহ্ম মতাবলম্বী রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসের সাথেও সম্পূর্ণরূপে সম্পৃক্ত। 

শাস্ত্রের সাথে মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে অদ্বৈত বেদান্তের আকর গ্রন্থ দৃগ্-দৃশ্য-বিবেকে ভারতীতীর্থস্বামী প্রথম শ্লোকে এঁর সম্পর্কেই বলেছেন, 
रूपं दृश्यं लोचनं दृक् तद्दृश्यं दृक्तु मानसम् । 
दृश्या धीवृत्तयः साक्षी दृगेव न तु दृश्यते ॥ १॥ 
দেখছে যে চোখ , হচ্ছে সে 'দৃক', যা দেখি তাই 'দৃশ্য',
আবার চোখ কে দেখে মন যখন - চক্ষু সেথায় দৃশ্য ।
আবার মন আর মনের ভাবনাগুলি 'আত্মা' তাদের দেখে,
সে আত্মা দৃশ্য তো নয় - 'দৃক্' কহি মোরা যাকে ।।
রবীন্দ্রনাথ তো বোধি, বোধের উচ্চতম শিখরে তাঁর অবস্থান। তাঁর কাছে আত্মা আর পরমাত্মা এক এবং অবিচ্ছেদ্য। তাই কবি যখন অন্তরাত্মার কাছে প্রার্থনায় নত, তখন তিনি অবলীলায় গেয়ে ওঠেন,
"হে বন্ধু মোর, হে অন্তরতর,
এ জীবনে যা-কিছু সুন্দর
সকলি আজ বেজে উঠুক সুরে
প্রভু, তোমার গানে, তোমার গানে, তোমার গানে।"

এমন কথা এত সহজে কি আর সবাই বলতে পারেন? আমরা কজনই বা আর অন্তর পেরিয়ে অন্তরতরকে প্রাত্যহিক যাপনে অনুভব করতে পারি? যদি পারতাম তাহলে আমাদের আত্মকথনও হয়তো এমনতর হতো:
"সোনালি রুপালি সবুজে সুনীলে      
সে এমন মায়া কেমনে গাঁথিলে--
তারি সে আড়ালে চরণ বাড়ালে, ডুবালে সে সুধাসরসে।
কত দিন আসে কত যুগ যায়,      
গোপনে গোপনে পরান ভুলায়,
নানা পরিচয়ে নানা নাম ল'য়ে নিতি নিতি রস বরষে॥"

আত্মপ্রত্যয় নামক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপলব্ধি বর্ণনা করে লিখছেন, 'আমরা সামজকে যে এক বলে জানি সেই জানবার ভিত্তি হচ্ছে আমাদের আত্মা-- মানবকে এক বলে জানি, সেই জানার ভিত্তি হচ্ছে এই আত্মা-- বিশ্বকে যে এক বলে জানি তারও ভিত্তি হচ্ছে এই আত্মা এবং পরমাত্মাকে যে অদ্বৈতম্‌ বলে জানি তারও ভিত্তি হচ্ছে এই আত্মা। এইজন্যই উপনিষৎ বলেন, সাধক-- আত্মন্যেবাত্মানং পশ্যতি-- আত্মাতেই পরমাত্মাকে দেখেন। কারণ, আত্মাতে যে ঐক্য আছে সেই ঐক্যই পরম ঐক্যকে খোঁজে এবং পরম ঐক্যকে পায়। যে জ্ঞান তার নিজের ঐক্যকে আশ্রয় করে আত্মজ্ঞান হয়ে আছে সেই জ্ঞানই পরমাত্মার পরম জ্ঞানের মধ্যে চরম আশ্রয় পায়। 

'এইজন্যই পরমাত্মাকে "একাত্মপ্রত্যয়সারং" বলা হয়েছে। অর্থাৎ নিজের প্রতি আত্মার যে একটি সহজ প্রত্যয় আছে সেই প্রত্যয়েরই সার হচ্ছেন তিনি। আমাদের আত্মা যে স্বভাবতই নিজেকে এক বলে জানে, সেই এক জানারই সার হচ্ছে পরম এককে জানা। তেমনি আমাদের যে একটি আত্মপ্রেম আছে, আত্মাতে আত্মার আনন্দ, এই আনন্দই হচ্ছে মানবাত্মার প্রতি প্রেমের ভিত্তি, বিশ্বাত্মার প্রতি প্রেমের ভিত্তি, পরমাত্মার প্রতি প্রেমের ভিত্তি। অর্থাৎ এই আত্মপ্রেমেরই পরিপূর্ণতম সত্যতম বিকাশ হচ্ছে পরমাত্মার প্রতি প্রেম-- সেই ভূমানন্দেই আত্মার আনন্দের পরিণতি। আমাদের আত্মপ্রেমের চরম সেই পরমাত্মায় আনন্দ। তদেতৎ প্রেয়ঃ পুত্রাৎ প্রেয়ো বিত্তাৎ প্রেয়োহন্যস্মাৎ সর্বস্মাৎ অন্তরতর যদয়মাত্মা।'

এটা পড়ার পর মনে হয়েছে যে আমি যেভাবে রবীন্দ্রনাথের দ্বারা অন্তরতর শব্দটির ব্যবহারকে বুঝেছি, সেটা বোধহয় ঠিকই আছে। এ বিষয়ে অন্য রবীন্দ্রানুরাগীদের মধ্যে যদি কেউ ভিন্ন মত পোষণ করেন, দয়া করে জানাবেন - সমৃদ্ধ হবো। সত্যি কথা বলতে কি, ওনাকে বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সকলের জন্য একটাই কথা প্রযোজ্য:
আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না। 
এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা ॥

No comments:

Post a Comment