অধিকাংশ বাঙালি যাঁদের ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, যাঁদের গুণমুগ্ধ, বেছে বেছে তাঁদেরই গালি দিতে হবে। কিছু বাঙালি নামধারীদের মাথায় গজাল মেরে ঢুকিয়ে দাও যে বাঙালি বুদ্ধিজীবী মানেই দেশের শত্রু আর তারপর তাদের বাজারে ছেড়ে দাও একধারসে সব বাঙালির পছন্দের মানুষকে হেয় করতে। তা সে আইকনিক ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলির গৌতম চট্টোপাধ্যায়ই হোন বা কবিদের উত্তমকুমার শঙ্খ ঘোষ, নাথবতী অনাথবৎ-এর শাঁওলি মিত্রই হোন বা সদ্যপ্রয়াত জনপ্রিয় সাংবাদিক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এদের পেরিনিয়াল লাভ হলেন অমর্ত্য সেন, যাঁর বিরুদ্ধে যত বেশি কুকথা বলা হয়, উচ্চশিক্ষিত ও বিশ্ববন্দিত বাঙালিদের প্রতি স্বভাবত শ্রদ্ধাবান মধ্যবিত্ত মধ্যমেধার বাঙালি তত বেশি ক্ষেপে যায়।
এখানে বঙ্কিমচন্দ্র নিয়ে সেমিনারে কিই-নোট এড্রেস কোনো বাঙালি বঙ্কিম-বিশারদকে দিয়ে মোটে দেওয়ানো যাবে না, বাইরে থেকে অবাঙালি অপ্রবুদ্ধ নেতা ধরে আনতে হবে কারণ সেখানে তাঁর ইমেজ বিল্ডিংই হলো আসল। ভাষণটা কিন্তু নির্ঘাত কোনো বেতনভুক চামচে প্রবাসী বাঙালিরই লিখে দেওয়া। কেবল এই অবধি হয়ে থেমে গেলেও হতো। কোটি কোটি বাঙালির আস্থা যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে জড়িয়ে আছে, এরা তাদেরও হেয় করতে ছাড়ে না। রামকৃষ্ণ মিশন কেন যীশুপুজো করলেন বা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ কেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানালেন - শুরু হয়ে গেল বিদ্রুপ আর কটাক্ষ। শ্রীশ্রীঅনুকূল ঠাকুর হলে তো কথাই নেই, নোংরামির একশেষ। যা যা করলে বহু বাঙালি বিরক্ত হয় সেগুলোই বেশি বেশি করে করতে হবে কারণ এটাই নাকি বাঙালির 'সাচ্চা' প্রতিনিধিত্ব!
আসলে বাঙালি হলো এক ওপরচালাক নির্বোধ জাতি তো, সে ৫০০ টাকার জন্য মেরুদন্ড বিকিয়ে দেয়, তার মোল্লাপ্রীতি তুলনাহীন, তার কোনো জাত্যাভিমানই নেই। অর্থাৎ বাঙালি একটি সাব-ন্যাশনালিসমে আচ্ছন্ন উচ্ছন্নে যাওয়া জাত এবং তার পছন্দের মানুষগুলোও পাতে দেওয়ার যোগ্যি নয় - অথচ সেই অসভ্য বাঙালিরই সমর্থন চাই! তারপর রয়েছে বুদ্ধিমানদের বানানো বাঙালিকে জাগানোর চূড়ান্ত মাস্টারপ্ল্যান। এমনিতে তো আর এই অধঃপতে যাওয়া জাতকে জাগানো যাবে না, ছাগলগুলো মাঝেমাঝে যত বেশি সংখ্যায় মরে, যত বেশি ঘরছাড়া হয়, যত অত্যাচারিত হয়, তত মঙ্গল। মরুক মর্কটগুলো, পাশে দাঁড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। বলির রক্ত দেখে দেখে যদি এই 'কাঙ্গালি' বাঙালিগুলোর কিছুটা হলেও টনক নড়ে! ততক্ষণ যারা মারছে তাদের খোলা ছুট।
ও হ্যাঁ, বাঙালিকে কিছুতেই বিশ্বাস করা যাবে না, কিছুতেই যাবে না, মহাবদমাইশ এই জাত। ইংরেজদের দেশে গিয়ে নতুন করে সংসদীয় গণতন্ত্র শিখে এসে এরা ওই ইংরেজদেরই পেছনেই বাঁশ দিয়েছিল। ইংরেজদের হাতে ট্রেনিং প্রাপ্ত সেনা নিয়ে ইংরেজদেরই বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল। একটু জায়গা পেয়েই স্বয়ং গান্ধীজিকে তুড়ি মেরে হারিয়ে দিয়ে কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল আর সিন্ধীরা যখন ভয়ে নিজেদের ভাষা ভুলে গিয়ে চুপচাপ উর্দু হজম করছিলেন, এই ছাগল বাঙালিগুলো প্রথমে শিলচরে আর তারপর ঢাকায় নিজেদের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য জান দিয়ে হক ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিল।
এরা সেই বস্তু যারা ইংরেজের কাছে কেমিস্ট্রি পড়ে, ফর্মুলা শিখে, বোমা বানিয়ে 'জয় মা কালী' বলে ইংরেজের ওপরেই ছুঁড়তো, কি ডেঞ্জারাস জাত ভাবুন একবার!
এদের কোনোমতে মাথায় উঠতে দেওয়া যাবেনা, এদের কেউ নেতা হয়ে গেলেই বিপদ। ক্রমাগত বলে যেতে হবে বাঙালির সব খারাপ - বাঙালি কবি খারাপ, বাঙালি নাট্যকার খারাপ, বাঙালি শিল্পী খারাপ, বাঙালি আমলা খারাপ, বাঙালি সাংবাদিক খারাপ, বাঙালির মনন এবং মানসিকতা - সব খারাপ। কবি জয় গোস্বামী হাসপাতালে ভর্তি হলে তাঁকে দেখতে যাওয়া তো দূরের কথা, ক্রমাগত গালি দিয়ে যেতে হবে। বুদ্ধবাবু এখনো বহু বাঙালির সফ্টস্পট, তিনি হাসপাতালে ভর্তি হলেও একই ব্যাপার। সোনিয়া গান্ধী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে যা করেছিলেন, সেটা অবশ্যই শিক্ষণীয় নাহলে এতদিনে গান্ধী পরিবারকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে কংগ্রেস হয়তো আবার নিজস্ব শক্তি সঞ্চয় করে ফেলতো। ইংরেজের যেমন ম্যাকলে ছিল, অমন আরো একপিস চাই যিনি এসে শেখাবেন যে সভ্যতার পিঠস্থান থেকে মহামতি আর্য্যরা এসে বন্য অসভ্য বঙ্গবাসীকে সভ্যতার আলো দেখিয়েছিলেন। যেদিন ওই লেভেলের একটা বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে, সেদিনই কেল্লাফতে। চলুন সবাই মিলে খুঁজি। তার আগে প্রবাস নিবাস বৈঠক ভোজন বিশ্রাম কোনোকিছুরই যে মনমতো বিস্তার করা যাচ্ছে না।
একটা কথা না বলে শেষ করলে পাপ হবে। যে বাঙালি দেশকে স্বাধীন করানোর জন্য সবচেয়ে আগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যে বাঙালি কোনোদিন নিজের প্রাণের মায়া করেনি, যে বাঙালি নিজের হিন্দু সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে সহ সর্বস্ব জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতে চলে এসেছিল, আজ সেই যুগান্তর অনুশীলনের বাঙালিকে রাষ্ট্র্ববাদ শেখানোর জন্য বাইরের মাষ্টার দরকার পড়ছে, ভাবলেই কেমন যেন শিহরণ জাগে।
No comments:
Post a Comment