আমার বাবা ঘোর শাক্ত ছিলেন। ছোটবেলায় মঠে বা মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বাবা প্রার্থনা করতে শেখাতেন, বলতেন "বলো মা জ্ঞান দাও, ভক্তি দাও, প্রেম দাও, বিবেক দাও, বৈরাগ্য দাও"। ঠাকুরঘরেও রোজ সকালে স্নানের পর দেবদেবীদের প্রণাম করে ওটাই বলতে হতো, সাথে আদ্যাস্তোত্ৰটি মুখস্ত বলতে হতো। একটি শব্দেরও মানে বুঝতাম না, না তো প্রার্থনার, না সংস্কৃতে লেখা স্তোত্রের, কিন্তু নিয়ম করে প্রতিদিন বলে যেতে হতো। একদিন মানে জিজ্ঞেস করায় বাবা বলেছিলেন এগুলো হচ্ছে মনের খিদে মেটানোর জন্য ভাত ডাল তরকারি মাছ ও দইয়ের মতন আর এগুলো একমাত্র মা কালীই দিতে পারেন। তাই রোজ যেমন শরীরের খিদে পেলে মাকে 'মা ভাত দাও' বলি, তেমনি মানুষ হতে গেলে রোজই মা কালীর কাছেও এইসব খাবার চেয়ে নিতে হয়। আর বলেছিলেন স্তোত্র হলো যাঁর কাছে চাইছি, তাঁকে বন্দনা করে মানুষ করার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা; পরে বড় হলে একদিন ঠিকই বুঝতে পারবো সত্যি সত্যিই কতটা মানুষ হতে পারলাম। মনে আছে সেদিন বেশ অবাক হয়েছিলাম। আমি তো মানুষই! লিও, অর্থাৎ আমাদের পোষ্য এলসেশিয়ানের মতন কুকুর তো নই, তাহলে আবার আলাদা করে কি মানুষ হবো রে বাবা? আজ মধ্য বয়সে এসে হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি বাবা সেদিন আসলে কি বলেছিলেন। বড় হলাম বটে, সত্যিকারের মানুষ আর হতে পারলাম কৈ?
বাবা আমার ছেলেবেলাতেই সাধনোচিত ধামে পাড়ি দিলেন, আমার অবিভাবকত্বেরও হাতবদল হলো। বাড়িতে মা বলতে লাগলেন, "রোজ ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা কর যাতে ভালোভাবে পড়াশুনা করে শিগগির শিগগির মানুষ হতে পারিস" আর স্কুলে মাষ্টারমশাইরা বলতে লাগলেন, "আরো মন দিয়ে পড়, ভালো রেজাল্ট কর, ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারবি না আর ভালো চাকরিও পাবি না, তখন জীবন দুর্বিষহ হয়ে যাবে"। যত চাপ বাড়তে লাগলো তত বাবার শেখানো প্রার্থনা ভুলে গিয়ে প্রার্থনায় 'ভালো রেজাল্ট দাও' দিয়ে শুরু করে পরে 'অমুকের মতো পেন দাও', 'তমুকের মতো জামা দাও'তে গিয়ে ঠেকলো। স্পষ্ট মনে আছে এক সরস্বতী পূজায় শুধু জ্ঞান চেয়েই থেমে গেলাম, ভক্তি প্রেম বিবেক বৈরাগ্য সব কেমন করে যেন নিজে থেকেই বাদ চলে গেল। ধীরে ধীরে একসময় আদ্যাস্তোত্ৰটিও ভুলে গেলাম। কখনো কখনো মনে পড়লে 'শৃণু বৎস প্রবক্ষ্যামি আদ্যাস্তোত্রং মহাফলম্/ যঃ পঠেৎ সততং ভক্ত্যা স এব বিষ্ণুবল্লভঃ' অবধি গিয়েই আটকে যেতাম। আমার যখন ১৪-১৫ বছর বয়স, তখন আমার মানসে মানুষ হওয়ার সংজ্ঞা হলো আমারই এক নিকট আত্মীয়ের মতো অঢেল পয়সা কামানো আর যথেচ্ছ খরচ করার ক্ষমতা অর্জন করা।
তারপর জীবন যেদিকে নিয়ে গেল, ভেসে গেলাম। দীর্ঘদিন চাকরি, দেশ-বিদেশ ভ্রমণ, সংসার, সন্তান, কর্পোরেট ল্যাডার বেয়ে শীর্ষে ওঠা, তারপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করা, সাথেসাথে সমাজে একটুআধটু নাম কামানোর চেষ্টা, ইতিমধ্যে ছেলেরা উপার্জনক্ষম হয়ে যাওয়া আর আমার active involvement ছাড়াই রোজকার ডাল ভাতের একটা হিল্লে হওয়ার পর অবশেষে সব হ্যাপা জলাঞ্জলি দিয়ে ভাবতে বসা যে সত্যিই কি মানুষ হলাম? ভাবতে গিয়ে দেখলাম যে 'পরের জাগা পরের জমিন, ঘর বানাইয়া আমি রৈ / আমি তো সেই ঘরের মালিক নৈ'! তাহলে হলোটা কি? মাঝখানে গুচ্ছের সময় অপব্যয় করে আবার সেই বাবার শিক্ষায় ফিরে আসা - মনের খাবার যোগাড় করো, ওটাই আসল। মনটা থাকবে, বাকি আর কিছুই থাকবে না। বাবার অসময়ে চলে যাওয়ায় আমার আসলে কতটা ক্ষতি হয়েছিল সেটা আমি এই বয়সে এসে যতটা গভীরভাবে বুঝতে পারলাম, ততটা এযাবৎ বুঝিনি। তবে একটাই রক্ষা ছিল - সেটা আমার মন্ত্রদীক্ষা, গুরুদেবের দেওয়া বীজমন্ত্র এবং তাঁর আশীর্বাদ। ওটা ছাড়া হয়তো এখনো স্যুট টাই পরে পাঁচতারা হোটেলে একগাদা সাহেবসুবোর সাথে রোজ সিঙ্গেল মল্টে চুমুক দিতে দিতে আর কৃত্তিম হাসিঠাট্টায় মশগুল হয়ে ব্যবসায়িক লেনদেন করতে করতে ভাবতাম, this is it, I have arrived.
আগের সবকিছু বাদ দিয়ে আবার নতুন করে সনাতন সংবাদ পড়ছি। শাস্ত্র পড়ছি, সৎসঙ্গ করছি, মনটাকে বসে আনার চেষ্টা করছি। এ এক অন্য জগৎ - দুনিয়াদারি থেকে সরে গিয়ে সত্যিকারের মানুষদের জগৎ, এর স্বাদ গন্ধ বর্ণ সব একেবারে আলাদা। নিজের চেষ্টায় অল্প অল্প সংস্কৃত শেখার চেষ্টা করেছি, ফলে এতদিনে আদ্যাস্তোত্রের মানে বুঝতে পেরেছি এবং কেন বাবা রোজ পাঠ করতে বলতেন, সেটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে। মনের মধ্যে 'কি করছি?' প্রশ্নটি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মা যে দ্রুততার সঙ্গে বাইরের কাজ ও ভোগবাসনা কমিয়ে দিলেন, সেটা তো নিজেই অনুভব করলাম আর সেই সাথে সাথে দৈবনির্ভরতাও বেড়ে গেল বহুগুণ। এর কোনোকিছুই যে জোর করে করতে হয়েছে, তা তো নয় - যা হয়েছে সব আপনেআপই হয়েছে। কেন যে হটাৎ করে জীবনের focus-টা একদম ১৮০° ঘুরে গেল, স্বামী শিষ্য সংবাদ পড়তে পড়তে একজায়গায় তার উত্তর পেলাম। গুরুকৃপা হলে পুরুষকার জাগে, তারপর it is just a matter of time আর গুরু এবং ইষ্ট এক। আমার অসীম সৌভাগ্য যে সদগুরুর কৃপা পেয়েছিলাম, ফলে শরীরে না থেকেও তিনিই ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছেন। ওখানেই দেখলাম গুরু স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে কিভাবে inspire করছেন, "কি জানিস বাবা, সংসার সবই দুনিয়াদারি! ঠিক সৎসাহসী ও জ্ঞানী কি এ-সব দুনিয়াদারিতে ভোলে রে বাপ! জগৎ যা ইচ্ছে বলুক, আমার কর্তব্য কার্য করে চলে যাব—এই জানবি বীরের কাজ। নতুবা এ কি বলছে, ও কি লিখছে, ও-সব নিয়ে দিনরাত থাকলে জগতে কোন মহৎ কাজ করা যায় না।
এই শ্লোকটা জানিস না?—
নিন্দন্তু নীতিনিপুণা যদি বা স্তুবন্তু
লক্ষ্মীঃ সমাবিশতু গচ্ছতু বা যথেষ্টম্।
অদ্যৈব মরণমস্তু শতাব্দান্তরে বা
ন্যায্যাৎ পথঃ প্রবিচলন্তি পদং ন ধীরাঃ॥
লোকে তোর স্তুতিই করুক বা নিন্দাই করুক, তোর প্রতি লক্ষ্মীর কৃপা হোক বা না হোক, আজ বা শতবর্ষ পরে তোর দেহপাত হোক, ন্যায়পথ থেকে যেন ভ্রষ্ট হসনি। কত ঝড় তুফান এড়িয়ে গেলে তবে শান্তির রাজ্যে পৌঁছান যায়। যে যত বড় হয়েছে, তার উপর তত কঠিন পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষার কষ্টিপাথরে তার জীবন ঘষে মেজে দেখে তবে তাকে জগৎ বড় বলে স্বীকার করেছে। যারা ভীরু কাপুরুষ, তারাই সমুদ্রের তরঙ্গ দেখে তীরে নৌকা ডোবায়। মহাবীর কি কিছুতে দৃকপাত করে রে? যা হবার হোক গে, আমার ইষ্টলাভ আগে করবই করব—এই হচ্ছে পুরুষকার। এ পুরুষকার না থাকলে শত দৈবও তোর জড়ত্ব দূর করতে পারে না।
শিষ্য॥ তবে দৈবে নির্ভরতা কি দুর্বলতার চিহ্ন?
স্বামীজী॥ শাস্ত্র নির্ভরতাকে ‘পঞ্চম পুরুষার্থ’ বলে নির্দেশ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে লোকে যেভাবে ‘দৈব দৈব’ করে, ওটা মৃত্যুর চিহ্ন, মহা-কাপুরুষতার পরিণাম, কিম্ভূতকিমাকার একটা ঈশ্বর কল্পনা করে তার ঘাড়ে নিজের দোষ-চাপানর চেষ্টামাত্র। ঠাকুরের সেই গোহত্যা-পাপের গল্প শুনেছিস তো? সেই গোহত্যা-পাপে শেষে বাগানের মালিককেই ভুগে মরতে হল। আজকাল সকলেই ‘যথা নিযুক্তোঽস্মি তথা করোমি’ বলে পাপ-পুণ্য দুই-ই ঈশ্বরের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। নিজে যেন পদ্মপত্রে জল! সর্বদা এ ভাবে থাকতে পারলে সে তো মুক্ত! কিন্তু ভাল-র বেলা ‘আমি’, আর মন্দের বেলা ‘তুমি’—বলিহারি তাদের দৈবে নির্ভরতা! পূর্ণ প্রেম বা জ্ঞান না হলে নির্ভরের অবস্থা হতেই পারে না। যার ঠিক ঠিক নির্ভর হয়েছে, তার ভালমন্দ-ভেদবুদ্ধি থাকে না—ঐ অবস্থার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের (শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শিষ্যদের) ভেতর ইদানীং নাগ-মহাশয়।"
No comments:
Post a Comment