ভৌগোলিকভাবে কাছাকাছি চারটি পুরানো সভ্যতা - মেসোপটেমিয়ার, পারসিক, ভারতীয় আর চৈনিক - আজ তাদের কি দশা? মেসোপটেমিয়া অর্থাৎ আধুনিক ইরাক এবং তৎসংলগ্ন দুটি দেশ আর পারস্য অর্থাৎ কমবেশি আধুনিক ইরান তলোয়ারের চোট সামলাতে না পেরে তাদের আদিম উন্নত উদার সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে মরুভূমির অনুন্নত বেদুইন সংস্কৃতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে এখনো বসে আছে। একই দুর্দশা অখন্ড ভারতের পশ্চিমপ্রান্তের অর্থাৎ গান্ধার বা আধুনিক আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান ও পাকিস্তানের এবং ভারতের পূর্বপ্রান্ত অর্থাৎ বাংলাদেশের। তারপরের ভূভাগ, যেখানে যেখানে ভারতীয় সভ্যতার আলো ছড়িয়ে পড়েছিল অর্থাৎ মায়ানমার থেকে নিয়ে লাওস কাম্বোডিয়া ভিয়েতনাম থাইল্যান্ড হয়ে ইন্দোনেশিয়া পর্য্যন্ত অথবা সমুদ্রপারের শ্রীলঙ্কা ও মলদ্বীপে, সেখানে পূজা পদ্ধতি পাল্টে গেলেও ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়নি। আর বাকি থাকে চিন - ওঁরা যে কি চান সেটা ১৯৫০ থেকে ওঁরা খুঁজেই চলেছেন এবং ভারতীয় সভ্যতার প্রভাব থেকে তিব্বতকে বের করে এনে একটা অধার্মিক ভোগবাদী যাপনের দিকে ঠেলে দেওয়ার নিষ্ফল প্রচেষ্টা ক্রমাগত চালিয়ে যাচ্ছেন। এই বিপরীত পরিস্থিতিতে একমাত্র ভারতের একটি বিরাট ভূভাগ যে এখনো নিজের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছে তার কারণ তার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধর্ম। এখনো পুষ্করে কাশীতে প্রয়াগরাজে ঋষিকেশে এবং অজস্র প্রাচীন ছোট বড় জনপদে আধুনিক মানুষ বাস করেন, তাঁদের পূর্বপুরুষের জীবনবোধ নিজেদের মধ্যে ধারণ করেন, আর নিজেদের সামাজিক ও ধার্মিক উত্তরাধিকারকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে হস্তান্তর করতে করতে চলেন। ফলে একমাত্র এই ভারতীয় সভ্যতাই এখনো বাস্তবে চলমান, যাকে মধ্যযুগীয় মরুদস্যুরা হিন্দুসভ্যতা বলতো, এখন আমরাও বলি।
স্বামীজী বলেছিলেন, "ভিখারির আবার ত্যাগ কি? আগে সব পাও, তারপর মায়ামুক্ত বৈদান্তিকের উদাসীনতায় সব লাথি মেরে ফেলে দাও।" বলেছিলেন, "আগে ভেতরের শক্তি জাগ্রত করে দেশের লোককে নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করা, উত্তম অশন-বসন -- উত্তম ভোগ আগে করতে শিখুক, তারপর সর্বপ্রকার ভোগের বন্ধন থেকে কি করে মুক্ত হতে পারবে, তা বলে দে"। এই হলো শাশ্বত ভারতবর্ষের শিক্ষা - ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ - in that order. কাঁঠাল ভাঙার আগে হাতে তেল না মাখলে বা পাঁকাল মাছ ধরার আগে হাতে ছাই না মাখলেই বিপদ। জীবন কোন মানক অনুযায়ী চলবে? না, ধর্ম। ওটা হলো shield, স্বার্থপরতা বা লোকঠকানি কাজ করতে গেলেই মনের মধ্যে অঙ্কুশ মারবে, হাত চেপে ধরবে, নিজের ওপর ধিক্কার জন্মাবে। ঠাকুর বলেছিলেন স্বাত্ত্বিকের সংসার হবে শিবের সংসার। পন্ডিত ভীমসেন জোশির একটি বিখ্যাত ভজন আছে 'যো ভজে হরি কো সদা', ওখানে একটি স্তবক আছে - দিল কে দর্পন কো সমাহকর দূর কর অভিমান কো / খাক হো গুরু কে কদম কি তো প্রভু মিল যায়েগা। এই হলো শিবের সংসার। অহংকার থাকলেই বাসনা থাকবে, আর বাসনা থাকলেই অশান্তি থাকবে তাই শান্তি পেতে গেলে সবার আগে মনের মধ্যেকার অহংবোধ নাশ করো।
আমি কিছু নই, সব তুমি। আমার কিছু নেই, সব তোমার। আমি খাচ্ছি না, তুমি খাচ্ছ। আমি পরছি না, তুমি পরছো। ভোগ যা কিছু হচ্ছে সে সব তোমার ইচ্ছায় হচ্ছে, আমার বলে কিছু নেই। তোমার মধ্যে আমি আছি তাই আলাদা করে 'আমি' বলে কেউ নেই। খাক মানে বিভূতি, আশীর্বাদ। যিনি মানুষের শরীর-মন-বুদ্ধি দিয়ে আত্মাবিষ্কার করতে এই জগতে পাঠিয়েছেন তিনিই সদগুরু জুটিয়ে দেবেন আর সেই গুরু শিখিয়ে দেবেন ভোগের বন্ধন থেকে কি করে মুক্ত হতে পারা যায়। একবার বাসনা মুক্ত হতে পারলেই কেল্লা ফতে - 'প্রভু মিল যায়েগা'। এই হলো ভারতের সনাতন সংস্কৃতি, ত্যাগের সংস্কৃতি, ত্যাগের মাধ্যমে যোগের সংস্কৃতি। কি ত্যাগ? 'আমি' ত্যাগ। কার সাথে যোগ? সবার সাথে কারণ 'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম'। আমাদের সমসাময়িক বাকি প্রাচীন সভ্যতাগুলির এই বৈশিষ্ট্য না থাকার কারণেই তারা আজ বিধ্বস্ত। আমরা আছি কারণ আমাদের ধর্মবোধ সনাতন, শাশ্বত, শুদ্ধ। যেদিন ত্যাগ থাকবে না সেদিন হিন্দুসভ্যতাও থাকবে না। এটা বাকিরা জানেন, তাই তারা বারবার আমাদের সভ্যতার মূলে আঘাত করার চেষ্টা করেন কিন্তু অসফল হন। যতই তারা লোভ দেখিয়ে আমাদের ভোগের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চান না কেন, আমরা সে সব অভিজ্ঞতা উপভোগ করেটোরে, একসময় তার অসারতা উপলব্ধি করে ঠিক টুক করে সরে আসি। এটাই আমাদের সভ্যতার শক্তি। কত ism তো এলো গেল, উপনিষদ কিন্তু তার জায়গাতে সেই থেকেই গেল। ফলে ইহকালের সম্পদ আর পরকালের সুখ আমাদের অনেককেই খুব বেশিদিন প্রলোভিত করতে পারেনা। আবার কিছু লোককে করেও। তাদের জন্যই আজ দেশে এত সমস্যা।
ভারত পুণ্যভূমি, ধর্মভূমি। গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন আশ্রমের মাধ্যমে ঋষিরা প্রমান করে গেছেন যে সারা ভারতবর্ষ একটা বৃহৎ সাধনপিঠও বটে। আধুনিক ভারতকে পথ দেখাবার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণদেবের চেয়ে বড় সদগুরু তো আর কেউ নেই, তাই তাঁর কথাতেই ফিরে যেতে হয়। ঠাকুর বলছেন,
"সংসারে থাকবে না তো কোথায় যাবে?
আমি দেখছি যেখানে থাকি, রামের অযোধ্যায় আছি।
এই জগৎসংসার রামের অযোধ্যা। রামচন্দ্র গুরুর কাছে জ্ঞানলাভ করবার পর বললেন, আমি সংসারত্যাগ করব। দশরথ তাঁকে বুঝাবার জন্য বশিষ্ঠকে পাঠালেন।
বশিষ্ঠ দেখলেন, রামের তীব্র বৈরাগ্য। তখন বললেন,
“রাম, আগে আমার সঙ্গে বিচার কর, তারপর সংসারত্যাগ করো। আচ্ছা, জিজ্ঞাসা করি, সংসার কি ঈশ্বর ছাড়া? তা যদি হয় তুমি ত্যাগ কর।” রাম দেখলেন, ঈশ্বরই জীবজগৎ সব হয়েছেন। তাঁর সত্তাতে সমস্ত সত্য বলে বোধ হচ্ছে। তখন রামচন্দ্র চুপ করে রইলেন।
“সংসারে কাম, ক্রোধ এই সবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, নানা বাসনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, আসক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়।
যুদ্ধ কেল্লা থেকে হলেই সুবিধা।
গৃহ থেকে যুদ্ধই ভাল; — খাওয়া মেলে, ধর্মপত্নী অনেকরকম সাহায্য করে।
কলিতে অন্নগত প্রাণ — অন্নের জন্য সাত জায়গায় ঘুরার চেয়ে এক জায়গাই ভাল।
গৃহে, কেল্লার ভিতর থেকে যেন যুদ্ধ করা।
“আর সংসারে থাকো ঝড়ের এঁটো পাত হয়ে।
ঝড়ের এঁটো পাতাকে কখনও ঘরের ভিতরে লয়ে যায়, কখনও আঁস্তাকুড়ে। হাওয়া যেদিকে যায়, পাতাও সেইদিকে যায়। কখনও ভাল জায়গায়, কখনও মন্দ জায়গায়!
তোমাকে এখন সংসারে ফেলেছেন, ভাল, এখন সেই স্থানেই থাকো — আবার যখন সেখান থেকে তুলে ওর চেয়ে ভাল জায়গায় লয়ে ফেলবেন, তখন যা হয় হবে।”
“সংসারে রেখেছেন তা কি করবে? সমস্ত তাঁকে সমর্পণ করো — তাঁকে আত্মসমর্পণ করো। তাহলে আর কোন গোল থাকবে না। তখন দেখবে, তিনিই সব করছেন। সবই রামের ইচ্ছা।”
No comments:
Post a Comment