Thursday, May 4, 2023

আত্মবিস্মৃতি



পথের পাঁচালির সেই শেষের দিকের দৃশ্যটা কি কারো মনে পড়ে? হরিহর সর্বজয়া আর অপুকে নিয়ে একটা গরুর গাড়ি করে নিশ্চিন্দিপুরের বাপ ঠাকুরদার ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন চিরকালের জন্য, আর তাঁদের সেই ফাঁকা ভিটায় ধীরে ধীরে একটা সাপ ঢুকছে, মনে পড়ে? 

রোজগারের তাগিদে বাঙালির গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দেওয়ার প্রবণতা বইটি প্রকাশের সময়, অর্থাৎ ১৯২৯ সালে যেমন সত্যি ছিল, চলচিত্র আকারে আবির্ভূত হওয়ার সময়, অর্থাৎ ১৯৫৫ সালেও ঠিক তেমনই সত্যি ছিল আর আজ, ২০২৩ সালেও অবিকল তেমনই সত্যি আছে। 

যে সব শহুরে বাবুদের এখনো পারিবারিক কৃষি জমি আছে এবং পূর্ব সংস্কারের কারণে নিজেদের জীবদ্দশায় মন শক্ত করে বেচতে পারছেন না, তাঁরা অন্তত একটুকু নিশ্চিত করেছেন যে তাঁদের ছেলেমেয়েরা কৃষিকে যেন অশ্রদ্ধা করতে শেখে এবং মা বসুন্ধরাকে কেবল commercial investment বলেই মানে। এই প্রজন্মটি যেদিন চোখ বুজবেন সেইদিনই ওই জমি বিক্রি হয়ে যাবে। 

মজার ব্যাপার হলো বর্তমান প্রজন্ম বুঝবেও না কি মহান উত্তরাধিকার তারা হেলায় হারালো, কারণ ছোটবেলা থেকেই তো তাদের brainwash করা হয়েছে যে কৃষক হওয়া কোনো career optionই নয়। ভেবে দেখবেন বাঙালি রিক্সাচালকরা অধিকাংশই গ্রামহীন জমিহীন বস্তিবাসী অথচ বিহারী রিক্সাচালকদের কিন্তু গাঁওদেহাত থাকে, সেখানে তাঁদের পরিবার থাকে, ক্ষেতখামারও থাকে। 

ছোট পারিবারিক ব্যবসার ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা খাটে। কতজন বাঙালি চান যে তাঁর রক্ত জল করে তিল তিল করে গড়ে তোলা ছোট্ট ব্যবসাটি, যা চিরকাল তাঁর সংসারকে চালিয়ে নিয়ে এসেছে, সেটিকে তাঁর সন্তান চালাক? আমার সন্তান ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার চার্টার্ড একাউন্টেন্ট উকিল ইত্যাদি হবে - আমার মতন self-employed হবে কোন দুঃখে? আরে ছোঃ! 

সন্তান অন্যের glorified গোলাম হোক বহুত আচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই নিজের ছোট enterprise-এর মালিক যেন না হয় - হায় রে বাঙালি! এই যে কৃষিকে অবহেলা করতে শেখানো, নিজ উদ্যোগকে অবহেলার চোখে দেখতে শেখানো, মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে জীবনের মূল্যকে কেবলমাত্র টাকার বাটখারায় ওজন করতে শেখানো - colonial slave mindset-এর শিকার বাঙালি বাপ মায়েরা যে কি মারাত্মক virus সমাজের বুকে inject করেছেন, তাঁদের কোনো ধারণাই নেই। 

এবং এটি যে কেবল আজকের বাবা মায়ের generation করছেন তা নয়, গত একশ-সোয়াশ বছর ধরেই misplaced হীনমন্যতার শিকার বাঙালিরা ক্রমাগত এই কান্ডটি ঘটিয়ে চলেছেন। সুযোগ পেলে যে কোনো হরিয়ানার জাট IAS অফিসারকে কোনোদিন জিজ্ঞেস করে দেখবেন, তাঁরা বলবেন তাঁদের আটা আর ডাল গ্রামের ক্ষেত থেকে আসে, কোনো তাউ বা চাচা সেই পারিবারিক ক্ষেতিবাড়ি সামলান। 

একই ব্যাপার কোনো ইউপি বা পাঞ্জাব বা বিহার অথবা উড়িষ্যার সরকারি এবং বেসরকারি উচ্চআধিকারিকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যদি এঁদের মধ্যে কারো গ্রামে পারিবারিক মুদিখানা থাকে বা কাঠকল বা রাইসমিল, কোনোদিন শুনবেন না সে সব তাঁরা লাটে উঠিয়ে দিয়েছেন। যত সমস্যা আমাদের আর তামিল ব্রাহ্মণদের - এঁরা যেন যতক্ষণ না মাটির সাথে নাড়ির বাঁধনটা কাটতে পারছেন, ততক্ষণ স্বস্তি পান না! 

ইদানিং, অত্যধিক রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে পিতৃপুরুষের অন্নদাত্রী কৃষিজমিকে বন্ধ্যা করে দিয়ে কিছু পাঞ্জাবি পরিবারও সব বেচেবুচে দিয়ে টরন্টো বা ব্রিসবেনের প্লেনে উঠে পড়ছেন, এঁদেরও বাঙালির ছোঁয়াচে রোগ লেগেছে। আগেও পাঞ্জাবিরা বিদেশ যেতেন পয়সা রোজগার করতে, কিন্তু সেটা পরিবার পিছু এক আধ জন। 

এখন তো সেই একশ বছর আগের হরিহরের মতন এঁরাও কৃষিসংস্কৃতি ভুলে, নিজেদের স্বনির্ভরতার মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে, সমূলে উৎপাটিত হয়ে, হিথ্রো বিমানবন্দরে ঝাড়ু দেওয়া বা নিউইয়র্কে অন্যের ট্যাক্সি চালানোকে বেশি সন্মানজনক বলে মনে করছেন। কেন সারা দেশের মধ্যে খালি বাংলা আর পাঞ্জাব ভাগ হয়েছিল, তার কারণ আমি আমাদের দুজাতের মানসিকতার মধ্যেই খুঁজে পাই। 

আমরা দুই জাতই আমাদের নিজস্বতাকে জলাঞ্জলি দিতে একটুও দ্বিধাবোধ করি না, ফলে নিজেদের ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট মাত্রায় sense of pride নেই, যা অন্যান্য ভারতীয়দের আছে। তামিল ব্রাহ্মণ সন্তান সংস্কৃত মন্ত্র জানে না, এ হতেই পারে না, ফলে আমাদের মতোই চাকরিপ্রিয় হওয়া স্বত্তেও ওঁদের ভিতটা টলে যায়নি, আত্মসন্মানবোধটুকু অক্ষুন্ন আছে।

আমরা আসলে সব খুইয়েছি। যখন কোনো পাঞ্জাবিকে গুরবাণী ভুলে আকন্ঠ পান করতে দেখি বা বাঙালিকে ঘর্মাক্তকলেবরে বাসে পাদুটো জায়গামত না রাখতে পারে ঝগড়া করতে দেখি, এঁদের দুজনের মধ্যে কোনো পার্থক্য আমার নজরে আসে না। দুটোই এক। দুটোই আত্মবিস্মৃতির বিভিন্ন পর্যায়।

No comments:

Post a Comment