আমরা দিনরাত যা কিছুই খুঁজে মরি না কেন - নাম যশ টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি প্রভাব প্রতিপত্তি সন্মান ভালোবাসা প্রেম সুখ ব্যঞ্জন বিলাস ইত্যাদি, দিনের শেষে হিসেব করলে দেখা যাবে আসলে আমরা কেবল একটাই জিনিস খুঁজছিলাম, আর তা হলো শান্তি। আমরা অনেকেই হয়তো মনে করি যে একমাত্র সুখে থাকলেই বুঝি মানুষ শান্তিতে থাকে, শান্ত থাকে। আদপেই কি তাই? সুখ কি, সেটাই তো বোধহয় মানবসভ্যতার আজ অবধি সবচেয়ে বড় unresolved mystery আর শান্তি ও সুখের corelation নিয়েও তো সেই আবহমান কাল থেকে চর্চার শেষ নেই।
কল্পনা করা যাক একটা বড় আলো ঝলমলে খোলামেলা বইয়ের ঘর, তার জানলাগুলোয় আধুনিক আওয়াজ নিরোধক কাঁচ লাগানো, ২৩°তে এসি চলছে, নরম আরামদায়ক কেদারায় বসে একজন স্বচ্ছল accomplished ব্যক্তি তাঁর প্রিয় উপন্যাসিকের সাম্প্রতিকতম রচনাটি পড়ছেন। বিরক্ত করার কেউ নেই, কোনো বাইরের চাপও নেই, ফ্লাস্কে গরম দার্জিলিং ফার্স্ট ফ্লাশ চা রাখা আছে, ইচ্ছেমত চুমুক দেওয়া যায় আর চোখ তুলে তাকালেই জানালাগুলো দিয়ে কেবল নয়নসুখকর সবুজের সমারোহ - ইনি সুখী, শান্ত না শান্তিতে আছেন? সুখের সমস্ত condition fulfilled, অশান্ত হবার মতনও কোনো distraction নেই, তাহলে এটাকেই কি শান্তিতে থাকা বলে?
এবার ধরা যাক উপন্যাসটি পড়তে পড়তে কোনো এক জায়গায় তাঁর জীবনের সাথে মিলে যাওয়া কোনো পুরানো স্মৃতি জেগে উঠলো এবং subconscious-এ ঘাপটি মেরে বসে থাকা সেই স্মৃতি বিশেষ যন্ত্রণাদায়ক। যেই সে কথা মনে পড়লো অমনি আগের-পরের নানান ঘটনা, নানারকমের emotions একের পর এক ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ে তাঁর মনকে বিক্ষিপ্ত করে তুললো। যিনি কিছুক্ষন আগেও নির্বিঘ্নে একমনে পছন্দের বই পড়ছিলেন, তিনি এখন বই সরিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়েছেন, মন তাঁর ভাবনাগুলোকে যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে নিয়ে গিয়ে ফেলছে, তিনি মনে মনে একটা topic থেকে অনায়াসে অন্য topic এ ভেসে চলে যাচ্ছেন এবং কে কবে অপমান করেছে, কে ঠকিয়েছে, কে use করেছে, কে betray করেছে - সব এক এক করে তাঁর মনের পর্দায় উঠে আসছে আর রাগে দুঃখে অভিমানে ঘৃণায় ভেতরটা যেন একেবারে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে।
ঘরটা এখনো নিঃশব্দ, ঠান্ডা, আরামদায়ক, চা-টা এখনো দার্জিলিং ফার্স্ট ফ্লাশ, হটাৎ করে অসহ্য মোবাইলটাও বেজে ওঠেনি, কেউ দরজায় ধাক্কাও দেয়নি, বাহ্যিকভাবে অ-সুখের কোনো কারণই ঘটেনি, তবু সুখের অনুভূতিটা গায়েব হয়ে গেল কিভাবে? আসলে সুখ এবং দুঃখ একটা বিশেষ জিনিসের ওপর নির্ভরশীল - অহং। অহং মানে আমি, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সত্যিকারের আমি নয়, আয়নায় যাকে দেখা যায়, সেই আমিটা। সেই আমিটা কখনো সুখী কখনো অসুখী, কখনো শান্ত কখনো অশান্ত তার কারণ তার মন তাকে চালায়, সে মনকে চালায় না। তার গোটা living experienceটাই শরীর-মন নির্ভর, ফলে সে external storage এবং internal storageএর input দ্বারা খুবই প্রভাবিত। তাহলে মানসিক শান্তি আসলে কি?
শান্তি হলো মনের ওপর সম্পুর্ন নিয়ন্ত্রণ আসার পর যে অবস্থা হয়, সেটা - যাতে জীবনের গতিপ্রকৃতিকে কেবল এই শরীর-মনরূপী পর্দার ওপর reflected চলচিত্র বলে মনে হয় আর নিজেকে কেবল সেই চলচিত্রের দর্শক। এতে কি হয়, ইচ্ছে মতন switch on switch off করা যায় - বাইরে ঝড় উঠলেও ভেতরটা শান্তই থাকে, আর জীবনের ওঠাপড়া মানসিক অবস্থার ওপর কোনো permanent দাগ কাটে না। যে কেউই কি এইরকম নিরভিমানি, নিস্পৃহ এবং নিরাসক্ত হতে পারেন? হ্যাঁ পারেন, তবে একাগ্রচিত্ত হয়ে অভ্যাস করতে হয় আর ইষ্টের কাছে "আমার অহংকার ধ্বংস করো প্রভু", প্রতিনিয়ত এই ultimate of all কৃপাটির জন্য একেবারে মন প্রাণ দিয়ে sincerely প্রার্থনা করতে হয়।
একেবারে সোজাসুজি তো মানুষ হাঁটতেও পারেনা - প্রথমে পেট ঘষটে ঘষটে চলে, তারপর পিঠ তুলতে গিয়ে পেটের উপর পড়ে যায়, তারপর হামাগুড়ি, তারপর কোনোমতে এক দু সেকেন্ডের জন্য পিঠ বেঁকিয়ে উঠে দাঁড়িয়েই ধপ করে পড়ে যাওয়া, তারপর কোনোমতে নড়তে নড়তে এক-দু মিনিট সোজা হয়ে দাঁড়ানো, তারপর প্রথম step এবং পড়া, আবার ওঠা আর আবার পড়া, আবার ওঠা, দুপা হাঁটা আর পড়া, এমন করতে করতে একদিন অল্প কিছুটা distance হেঁটে যাওয়া এবং টলমল করতে করতে ধীরে ধীরে steady হয়ে গিয়ে অবশেষে গড়গড় করে হাঁটা। নিজের অহংকে বর্জন করাও ঠিক এই ক্রম ধরেই হয় কারণ ওটাও নিজের অন্তরের দিকে হাঁটতে শেখা। হয়তো সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, হঠাৎ পা পিছলে পড়ে পাটাই মচকে গেল বা ভেঙে গেল। তখন আবার গুরুরূপী ডাক্তারবদ্যি, সেরে গেলে আবার হাঁটি হাঁটি পা পা। এমনটাও হয়।
অনেকসময়ই দেখা যায় যে এই মেকি অহং আমাদের কেমন জানি অস্বাভাবিক করে তোলে। হয়তো প্রখর গরমে আরামদায়ক বাতানুকূল গাড়ি করে যাচ্ছি, বাইরে রাস্তায় ঘর্মাক্ত কলেবরে হেঁটে চলা মানুষদের জন্য মনকষ্ট হওয়ার বদলে নিজেকে কেমন যেন কেউকেটা মনে করে আত্মপ্রসাদ লাভ হচ্ছে - কি অদ্ভুত! আবার, হয়তো কোনো ফাংশনে গেছি, সামনের সিটে বসতে গেছি, কেউ এসে বললেন ওই row টা ভিআইপিদের জন্য reserved, আপনি পেছনে গিয়ে বসুন - ব্যস অমনি অপমানে গা জ্বলে উঠলো - কি, আমাকে পেছনে বসতে বলা, জানিস আমি কে? একটি শিশুর কিন্তু এইধরণের কোনো hangover থাকে না, যত সে বড় হয় তত এইসব aquired আবর্জনাগুলো জড় হয়, আর তত তার অহংকার বাড়তে বাড়তে শেষে একেবারে পৈশাচিক আকার ধারণ করে।
অহংকার ত্যাগ করতে গেলে আবার শিশু অবস্থায় ফিরে যাওয়া ছাড়া গতি নেই, তবেই শান্তি পাওয়া যাবে। তার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো আবার মায়ের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরতাকে নিজের জীবনে ফিরিয়ে আনা। প্রত্যেকে শিশুই তো নিজে থেকে কোনকিছুরই সুরাহা করতে অক্ষম হওয়ায় এতটুকু অসুবিধা হলেই কেঁদে ওঠে, তা সে পেটব্যথাই হোক বা খিদে পাওয়া, ঢেঁকুর না ওঠাই হোক বা কাপড় ভিজিয়ে ফেলা। তারপর তার মা নিজে থেকেই বুঝে নেন অসুবিধাটা কোথায় এবং সমাধানও তৎক্ষণাৎ হয়ে যায়। শিশু মায়ের কোলে যখন নিশ্চিন্তে ঘুমায়, সে জানে তার একবার ট্যাঁটুকু করাই যথেষ্ট, আপনেআপ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে - তার জন্য না তো সমস্যা কি তা বোঝার প্রয়োজন আছে, না বোঝানোর জন্য ভাষা আর না সমাধানের উপায় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার।
শিশুর একমাত্র একটাই কাজ - ট্যাঁ করে উঠে মাকে একবার জানান মাত্র দেওয়া যে ওনাকে তার প্রয়োজন - ব্যস, ঝামেলা শেষ। এই যে সম্পুর্ন মাতৃনির্ভরতা, এই যে অভিমানশুন্যতা আর এই যে নিরবিচ্ছিন্ন বিশ্বাস, এটাই হলো মাকে কাছে পাওয়ার একমাত্র চাবিকাঠি। মা তুমি জানো আর তোমার কাজ জানে, আমি বাপু মুক্তকচ্ছ। বস্তুত জগৎজননী মহামায়া যে জগৎপ্রসবিনীও, মহাশক্তির রূপই তো মাতৃশক্তি, তাই এই মা আমার সত্যিকারের মা, চিরকালের মা, অনন্তরূপিনী মা, কেবল এক শরীরের গর্ভধারিণী মা নন। আমার ইহকাল পরকালের ভার তোমার মাগো, আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, যেমন বাজাও তেমন বাজি, যেমন রাখো তেমনি থাকি, বাঁদিকে ফিরিয়ে রাখলে বাঁদিক ফিরেই নিশ্চিন্তে ঘুমাই, ডানদিকে ফিরিয়ে দিলেও তাই, আবার চিৎ করে শুইয়ে দিলেও তাইই।
মায়ের পায়ে নিজের অহংকে সঁপে দিতে পারলে দুটো জিনিস হয় - ১. ধীরে ধীরে 'আমার সন্মান' 'আমার অভিমান' থেকে unneccesary appendages ঝরে গিয়ে কেবল 'আমার মা'টুকু রয়ে যায়, আর ২. মায়ের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ার সাথে সাথে proportionately নিজের কাজ কখন যেন মায়ের কাজ হয়ে ওঠে। নির্ভরতা মানে কিন্তু নিষ্ক্রিয়তা নয়, নিশ্চিন্ততা - কারণ জানি যে মায়ের কাজ মা নিজেই ঠিক করিয়ে নেবেন, আমার এই শরীর-মন উপলক্ষ মাত্র। আর মায়ের কাজ যেহেতু সর্বদা নির্ভুল ও কল্যাণকারী, ফলে আমার ভুল পথে যাওয়ার তো আর কোনো যো নেই। এতে সুবিধা এই যে প্রথমত যে কোনো কাজের একটা greater sense of purpose তৈরি হয়ে যায় যা personal egoকে মাথা চাড়া দিতে দেয়না আর দ্বিতীয়ত মন ধীরে ধীরে শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর হতে থাকে, কোনো অধর্ম সে আর সইতে পারে না। জীবনে শান্তি পাওয়ার জন্য এ দুটোই কিন্তু খুব জরুরি।
সমস্ত উপনিষদেই প্রতিটি শান্তিমন্ত্রের শেষে তিনবার ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ বলা আছে। এই প্রার্থনার উদ্দেশ্য হলো আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক - এই ত্রিবিধ বিঘ্নেরই যেন বিনাশ হয় কারণ নির্বিঘ্ন উদ্বেগশূন্য আনন্দময় জীবনই আসলে শান্তিময় জীবন। তারই পরম আশ্বাস দিয়ে উপনিষদ বলছেন,
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে ।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ।।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।
অর্থাৎ,
পূর্ণ হতে পূর্ণ শুধু আসে
পূর্ণ ছিলাম পূর্ণ তাই আছি
এ পূর্ণের হবেনা যে ক্ষয়
এ অনাদি অজর অব্যয়
তোমার অমৃত দিয়ে
পূর্ণ হোক এ মানব
শান্তির অক্ষয় বারিধারায়
ধন্য হোক ধরা।
[ভাবানুবাদ : শ্রীমতি অনিন্দিতা গঙ্গোপাধ্যায়]
No comments:
Post a Comment