Wednesday, April 19, 2023

প্রেম-আনন্দ


শ্রীচৈতন্যদেব নিজের হাতে যে আটটি শ্লোক লিখেছিলেন (মতান্তরে পাঁচটি), তার মধ্যে তৃতীয়টি হলো,
তৃণাদপি সুনীচেন তরোরপি সহিষ্ণুনা। 
অমানিনা মানদেন কীর্ত্তনীয়ঃ সদা হরিঃ॥
(যিনি নিজেকে ঘাসের চেয়েও ক্ষুদ্র মনে করেন, যিনি গাছের চেয়েও সহিষ্ণু হন, যিনি নিজে মানবোধশূন্য হয়ে অন্যকে সন্মান প্রদান করেন, তিনিই হরির নাম করার অধিকারী।)

গতকাল ইউটিউবে বৃন্দাবনবাসী শ্রীহিত প্রেমানন্দ গোবিন্দস্মরণজী মহারাজের একটি প্রবচন শুনছিলাম। ওনাকে চাক্ষুস দর্শন করার সৌভাগ্য এখনো আমার হয়নি কিন্তু উনি যে একজন সত্যিকারের মহাত্মা, সে বিষয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। শ্রীচৈতন্যদেব যা বর্ণনা করেছেন, মহারাজ যেন তার জীবন্ত প্রতিরূপ। কিছুদিন আগে বিরাট কোহলি আর অনুষ্কা শর্মা ওনার আশীর্বাদ নিতে যাওয়ার ফলে মহারাজ ইদানিং বহুচর্চিত কিন্তু বহুবছর ধরেই মানুষ রাত দেড়টা থেকে ওনার আশ্রমে ভিড় জমাতে শুরু করেন যাতে দিনের বেলায় নিজের চোখে তাঁকে কাছ থেকে দর্শন এবং শ্রবণ করতে পারেন। এমন রাধাময় সন্ত আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। 

যাইহোক, মহারাজ শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে উদ্ধৃত করে বলছিলেন যে অমৃতের পুকুরে তুমি নিজেই ডুব দাও বা পা পিছলে পরে যাও বা কেউ ঠেলেই ফেলে দিক, একবার অমৃত মুখে পড়লেই তুমি অমৃতময় হয়ে যাবে। ঠিক তেমনি, বিরক্ত হয়ে তাঁর নাম নাও বা অভ্যেসবশেই তাঁর নাম নাও বা ভক্তিভরে তাঁর নাম নাও, নাম নিয়েছ কি নাম তোমায় নিয়ে নেবে আর নাম তোমায় একবার নিলে তুমি যাই করো আর তাই করো, গতি তোমার ভগবানমুখীই হবে। উনি বলছিলেন, মাহাত্ম বোঝো আর নাই বোঝো, নাম করে যাও - যে অবস্থাতেই থাকো নাম ছেড়ো না, কেবল নাম করে যাও - একদিন ঠিকই বুঝবে নাম তোমার কি করলো। মা বলতেন 'জপাৎ সিদ্ধি'। এসব কথা শুনলেই মায়ের নির্দেশ মনে পড়ে।

প্রেমানন্দজীকে যখনই শুনি, যতবার শুনি, মনে হয় যেন ঠাকুর মাকে একশ বছর পর ফিরে আসার ব্যাপারে যা বলে গিয়েছিলেন, তাই যেন হয়েছে - only the form has changed! কি কঠিন তপস্যা, কি প্রচন্ড তপ‌ঃতেজ, কি সরল ভাষায় জটিল আধ্যাত্মিক সূত্রকে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা, কি বিনয়, কি মাতৃভাব, কি সখীভাব, অথচ ভক্তের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য কি দারুন চেষ্টা, সেখানে কি অদ্ভুত uncompromising দৃঢ়তা। গত দশ বছর ধরে দুটো কিডনিই খারাপ, দুদিন অন্তর ডায়ালিসিস হয় কিন্তু প্রবচন এবং দর্শনে কোনো ছেদ নেই। এই অবস্থাতেও রোজ ভোররাতে পরিক্রমায় বের হন, খুব ইচ্ছে আছে যথাশীঘ্রসম্ভব বৃন্দাবনে গিয়ে পরিক্রমা মার্গে দাঁড়িয়ে ওনাকে একবার দর্শন করার। আর কি গুরুভক্তি - আহা! তারও ভিডিও দেখেছি - আহা যদি এর এক দশমাংশও পেতাম!

৬নং শ্লোকে শ্রীচৈতন্যদেব আরো লিখেছিলেন,
নয়নং গলদশ্রুধারয়া বদনং গদগদরুদ্ধয়া গিয়া। 
পুলকৈর্নিচিতং বপুঃ কদা তব নামগ্রহণে ভবিষ্যতি॥
(হে নাথ! তোমার নাম গ্রহণে কবে আমার নয়ন-যুগল অশ্রুধারায় শোভিত হবে? বাক্য-নিঃসরণের সময়ে বদনে গদগদ-স্বর নির্গত হবে এবং আমার সমস্ত শরীর পুলকিত হবে?)
ভক্তরা শ্রীরাধিকার নাম করছেন, শ্রীকৃষ্ণের নাম করছেন আর মহারাজের চোখ বন্ধ, গাল বেয়ে জলের ধারা নেমেছে আর মাঝেমাঝে দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ছে - একটা ভিডিওতে এই দৃশ্য দেখার পর থেকে কেবলই ঠাকুরের বলা কথাগুলো মনে পড়ছে আর মনে হচ্ছে এ জীবনে এমন আনন্দ আমি কবে পাবো - কবে কেবলমাত্র 'মা' লেখা দেখেই বুকের ভেতরটা মায়ের জন্য এমন হু হু করে উঠবে?

No comments:

Post a Comment