জয়রামবাটি গ্রামটির একটা বিশেষত্ব অবশ্যই যে এটি শ্রীশ্রীমায়ের জন্মভূমি, জগ্গজননি এই সাধারণ গ্রামটিকেই বেছে নিয়েছিলেন মর্তে মানবী শরীর ধারণ করে প্রকাশিত হওয়ার জন্য। যতদিন দেহে ছিলেন ততদিন এই গ্রামের প্রতি, গ্রামের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, তাঁর দরদ নানাভাবে প্রকাশ পেত। বস্তুত একমাত্র এইখানেই মা একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতেন। এ গ্রামে তিনি কারো পিসি কারো খুড়ি কারো বা মাসি। তিনি এ গ্রামের মেয়ে, এখানে তাঁকে একগলা ঘোমটা টেনে গরমে গলদঘর্ম হয়ে ভক্তদের প্রণাম গ্রহণ করার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ঠায় বসে থাকতে হতো না। মা মর্তলীলা সম্বরণ করেছেন ১৯২০তে আর সেইবছরেই জয়রামবাটিতে শুরু হয়ে গেছে মঠ এবং মিশনের কাজ। মায়ের জন্মস্থানে ওপর মাতৃমন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৯২৩শে।
মা যে এখনো এই গ্রামকে কেন্দ্র করে তাঁর মাতৃভাব সমানভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছেন, সেটাই এই গ্রামের এবং আশেপাশের অঞ্চলের সমকালীন বিশেষত্ব। প্রথমত, গত একশ বছর ধরে মা স্বয়ং এখানে নিত্যপূজা নিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, এতবছর ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষ এখানে এসে মাতৃসান্নিধ্য অনুভব করে কৃতার্থ হয়েছেন, হচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও হবেন। তৃতীয়ত, মা এখানে আছেন তাই গোটা অঞ্চলের অর্থনৈতিক কাঠামোটা এত মজবুত, নইলে এমন গ্রাম তো বাংলার বুকে কতই আছে, তারা কি আর এমন বর্ধিষ্ণু? চতুর্থত, মায়ের নামে মায়ের ছেলেরা বছরের পর বছর ধরে যে অক্লান্ত সেবাকাজ করে চলেছেন তাতে কত দুঃস্থ পরিবার রোজ খেয়ে পরে বাঁচছে - শিশুর নিত্যদিনের দুধ থেকে নিয়ে মহিলাদের কর্মসংস্থান অবধি, শিক্ষা থেকে নিয়ে স্বাস্থ্য অবধি - কত কিই না রামকৃষ্ণ সারদা মিশন সেবাশ্রম এবং পল্লীমঙ্গলের দ্বারা প্রতিদিন এই অঞ্চলে ঘটে চলেছে। পঞ্চমত, এই যে কামারপুকুর থেকে নিয়ে জয়রামবাটি অঞ্চলটি এবং তৎসংলগ্ন গ্রামগুলি যেমন সাতবেরিয়া, বেঙ্গাই, শিহড়, ফুলুই, দেশ্রা, পাণ্ডুগ্রাম, গার মন্দারণ ইত্যাদি যেখানে ঠাকুর এবং মায়ের পদরেণু এখনো প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে, গোটা এলাকা জুড়ে যে উন্নত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ, রেললাইন সম্প্রসারণ (গোঘাট অবধি রেল এসে গেছে, ২০২৫ সালের মধ্যে কামারপুকুর এবং জয়রামবাটিকে যোগ করার কাজও দেখলাম জোরকদমে চলছে) ইত্যাদি যে মহাযজ্ঞ, তা ওঁদের প্রত্যক্ষ যোগ ছাড়া সম্ভবই ছিল না।
ফলে যাঁদের মনে হয়তো এখনো প্রশ্ন আছে যে মা সত্যিসত্যিই জয়রামবাটিতে আছেন কিনা, তাঁরা একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন মায়েরই নামে যখন গত ১২৩ বছর ধরে এতকান্ড ঘটছে, সেখানে তাঁর নিজের ইচ্ছা ছাড়া কি করো পক্ষে একচুলও নড়া সম্ভব ছিল? মায়ের সবদিকে নজর, তাই নিজেই নিজের প্রয়োজনীয় কাজ কাউকে না কাউকে দিয়ে ঠিক করিয়ে নেন আর তাকে বুঝতেও দেননা। এখানে মায়ের কাছে যে যা আবদার করবে সে তাই পাবে। আজ ভোরে মা আমার বহুদিনের একটি সুপ্ত ইচ্ছাপূরণ করেছেন - আমি একেবারে এক হাত সামনে থেকে কোনো ফুল মালা ছাড়াই মায়ের দুটি রাঙ্গাচরণের পবিত্র পদচিহ্ন মন ভরে দেখতে পেয়েছি, আর মনে মনে মায়ের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে যতক্ষণ আমার মন চেয়েছে প্রার্থনা করতে পেরেছি,
কৃপাং কুরু মহাদেবি সুতেষু প্রণতেষু চ ।
চরণাশ্রয়দানেন কৃপাময়ি নমোহস্তু তে ।।
No comments:
Post a Comment