আর খানিকক্ষণ পরেই মায়ের বাড়ি ছেড়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো। মাকে প্রাণভরে দেখে নিলাম, যাতে মনের মধ্যে এই ছবিটা থেকে যায়। আমি গতবার যখন মাকে দেখেছিলাম উনি তুঁতে রঙের বেনারসি শাড়ি পড়েছিলেন, চোখ বুজলে এতদিন ওঁকে ওই ভাবেই দেখতে পেতাম। আজ দেখলাম ইঁটের রঙের সিল্কের শাড়ি পরে আছেন, গলায় মুক্তোর মালা। এবার মা এই রূপে মনে ধরা থাকবেন বহুদিন।
খুব কষ্ট হচ্ছে ফিরে যেতে কিন্ত উপায় নেই। ভোর চারটের মঙ্গলারতি, সংক্ষিপ্ত বেদমন্ত্র এবং গীতাপাঠ আর তারপর প্রয়োন্ধকার মন্দিরে আলোকোজ্জ্বল মায়ের সামনে বসে এক অখন্ড শান্তির পরিমণ্ডলে জপ এবং ধ্যান - মন এক সেকেন্ডে শান্ত হয়ে যায়। আমি যেমন মাকে দেখছি, মাও তো আমায় দেখছেন - গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
প্রতিদিন প্রসাদ তো যা পেয়েছি তা পেয়েছি - অনবদ্য। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো রোজ তিনবেলা হয় মায়ের অন্নভোগের প্রসাদী ভাত আর পায়েস, অথবা শীতলভোগের লুচির টুকরো আর প্রসাদী ফল - কে দেবে? আর ঘুরতে ফিরতে যখন ইচ্ছে এখানে মাকে যে দেখা যায় - মা সমাধিস্থ হয়ে বসে আছেন, অজস্র মানুষের প্রণাম নিচ্ছেন, পুজো নিচ্ছেন, অশান্ত ক্ষিপ্ত মানুষ হন্তদন্ত হয়ে মন্দিরে ঢুকে মায়ের কৃপায় খানিকক্ষণ পর একেবারে শান্ত অবস্থায় ধীরপায়ে প্রশান্ত মুখমন্ডল নিয়ে বেরিয়ে আসছেন - এ আর অন্য কোথায় রোজ রোজ চোখের সামনে দেখতে পাবো?
সেই সাথে মহারাজদের স্নেহ - প্রোগ্রাম চলাকালীন অত মানুষের ভিড়ের মধ্যে হটাৎ করে চুপচাপ দুপ্যাকেট চিনেবাদাম হাতে গুঁজে দিয়ে যাওয়া বা কানে কানে বলে যাওয়া যে অফিস ঘরে ফ্লাস্কে চা করে রাখা আছে আর disposable cup ও রাখা আছে, আমার চা খেতে ইচ্ছে করলেই যেন আমি টুক করে গিয়ে খেয়ে আসি। এই যে একটা ভাব যে আমরা সবাই মায়ের ছেলে আর মাই হচ্ছেন আমাদের সকলের common binding factor, আমরা গেরুয়া পরি বা নাই পরি, সবাই মায়ের নামে একজায়গায় একাট্টা হয়েছি, এটাই আসল ব্যাপার।
এই জায়গার আসল মজা এটাই - যেন লাগাতার মায়ের নামকীর্তন চলছে - একমাত্র মাকে ঘিরেই সবার existence, যা কিছু সব মায়ের নামেই হচ্ছে। আর বিশ্বাস, প্রগাঢ় বিশ্বাস, যে মা চাইলে যে কোনো আপাত অসম্ভব কাজও সম্ভব হয়, তিনিই করিয়ে নেন। এই অনুভূতিটা বিশেষ করে জয়রামবাটি মঠেই পাওয়া যায় কারণ যিনি হয়তো রেগে গিয়ে কাউকে বকছেন তিনি মায়ের কোনো কাজ ঠিকমতন করা হয়নি বলেই বকছেন আর যিনি বকুনি শুনছেন তিনিও মায়ের কোনো কাজে ঠিকমতো মনোযোগী হননি বলেই বকুনি শুনছেন, দুজনেরই ব্যক্তিগত কোনো বিষয় নেই। এইখানে সংসারীর সংসার আর সাধুদের সংসারের তফাৎ - এটাই টানে। তাই মায়ের আপন সংসার ছেড়ে যেতে বোধহয় প্রতিবারই এত কষ্ট হয়। জয় মা।
জয়রামবাটি থেকে গোঘাট স্টেশনে আসার পথে কামারপুকুরে ঠাকুরকে দর্শন করে এলাম। যুগির শিবমন্দিরে, ঠাকুরের মন্দিরে, রঘুবীরের মন্দিরে আর ঠাকুরের শোবার ঘরের বারান্দায় একসাথে পুজো হচ্ছে, দেখলাম অনলাইন ডাইরেক্ট লাইভও হচ্ছে। ঠাকুর কামারপুকুরে সদাই গভীর সমাধিমগ্ন, আঁখিদ্বয় অর্ধনিমিলিত, এক অপূর্ব দিব্য রূপ তাঁর। একদম কাছ থেকে দর্শন করলাম, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলাম, সুখনো প্রসাদ নিলাম, এখন ট্রেনে বাড়ির পথে। ঠাকুরের ওই মুখটা আমায় অসম্ভব টানে। নিজের জন্মস্থানে ঠাকুরের যে রূপ, তেমনটা বুঝি আর কোথাও নেই। দেখলাম ঠাকুরের পোঁতা আঁটির আমগাছটা ফলে ফলে একেবারে ভরে আছে, এমন যে বাঁশ দিয়ে ডালগুলোকে ঠ্যাকা দিয়ে রাখতে হয়েছে। বেশ খানিকক্ষণ ওটির তলায় দাঁড়িয়ে তার ছায়া মাখলাম সারা শরীরে। ঠাকুরের প্রিয় মোদকের দোকান থেকে ২০০ গ্রাম সাদা বোঁদে কিনেছি, মা আর ঠাকুরকে তাঁদের প্রিয় মিষ্টি আজ ভোগে দেবো। জয় মা, জয় ঠাকুর।
পুঃ : আমি জানতাম না যে আজ কামারপুকুরের শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরের ৭৩তম প্রতিষ্ঠা দিবস। না জেনেই এই খুশির দিনে ঠিক হাজির হয়ে গিয়েছিলাম!
No comments:
Post a Comment