সৌরভ গাঙ্গুলির কিশোরী কন্যার নাম করে ইনস্টাগ্রামে দেওয়া খুসওয়ান্ত সিংয়ের একটি উদ্ধৃতি হটাৎ করেই খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে সৌরভ টুইট করেছেন যে ওটি ওঁর কন্যার নয়, তার এখনো এসব বিষয় বোঝার মতন বয়স হয়নি এবং তাকে বিতর্কের বাইরে রাখাই উচিত। কন্যার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে উনি পিতার উপযুক্ত কর্তব্য করেছেন, এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু বিতর্কের পেছনে এতটাই নোংরা এক অবক্ষয়ি রাজনীতি আছে, যে সর্বস্তরের অভিভাবকের পক্ষে সেটির উদ্দেশ্য এড়ানো সম্ভব নয়।
খুসওয়ান্তের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতি বিদ্বেষ সর্বজনবিদিত। উনি চিরকাল ওঁর বিভিন্ন লেখায় এবং ২০০৩এর এই উদ্ধৃত বইতেও, ওনার কল্পনায় যা সঙ্ঘের দৃষ্টিতে এক আদর্শ ভারতের চিত্র হওয়া উচিত, সেই সম্পর্কে পাঠককে ভয় দেখিয়ে এসেছেন। ভারতের পূর্বগরিমার প্রতি সঙ্ঘের শ্রদ্ধা ও সাংস্কৃতিক রাষ্ট্র্ববাদের প্রতি বিশ্বাসকে ওনার মনে হতো পশ্চাদগামী। যেমন উনি কল্পনা করতেন যে দেশে সঙ্ঘের প্রভাব বিস্তৃত হলে এলোপ্যাথিক ডাক্তারের বদলে হয়তো মানুষ বৈদ্য দেখাতে বাধ্য হবেন ইত্যাদি, যেটি সানার নাম করে দেওয়া উদ্ধৃতির মধ্যেও আছে। ভদ্রলোক ২০১৪ মার্চ মাসে মারা যান, ফলে প্রথমবার বিজেপির বিপুল জয় এবং ২০১৯শে দ্বিতীয়বার বিপুলতর জয় উনি দেখে যেতে পারেননি। একজন সঙ্ঘপ্রচারক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যে ওঁর ভারতবর্ষ সারা বিশ্বের মধ্যে এলোপ্যাথিক ওষুধ রপ্তানিতে আজ অন্যতম প্রধান শক্তি, সেটাও ভদ্রলোক দেখে যেতে পারেননি।
যাইহোক, প্রশ্নটা খুসওয়ান্ত সিংকে নিয়ে নয়, প্রশ্নটা হলো এক মারাত্মক মানসিকতাকে নিয়ে, যা সুপরিকল্পিতভাবে কোনো কিশোর-কিশোরীর অপরিণত নিষ্পাপ মনে বৈচারিক চেতনা গড়ে ওঠার আগেই তাকে বিষিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। যেহেতু সানার নাম করে পোস্ট করা হয়েছে, তাই উদাহরণস্বরূপ ওর বয়সীদের প্রতিনিধি হিসেবে ওর নাম করেই বলছি যে আমি নিশ্চিত সানা গাঙ্গুলি সঙ্ঘের দীর্ঘ ৯৪ বছর ধরে মানুষ গড়ার ইতিহাস জানে না, জানে না অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে যুক্তফ্রন্ট হয়ে বামফ্রন্টের মেকি বামপন্থার ইতিহাস, জানে না idea of India আর idea of Bharat-এর মধ্যে মূল বৈচারিক পার্থক্য কোথায়। এই বয়সে, এবং যে বিত্তশালী পরিবেশে ও বড় হচ্ছে, তাতে ওর এতসব জানার কথাও নয়। তাহলে হটাৎ কেন ওর নামে এই পোস্টটা দেওয়া হলো? কারণ একজন বিখ্যাত কিশোরীর নাম ভাঙিয়ে catch them young নামক রাজনৈতিক কালসর্প অবচেতনের লোহার বর্ম ভেদ করে যথাস্থানে পৌঁছবার ফন্দি এঁটেছে। যে মন দেশের পক্ষে ভালো মন্দ বিচার করার মতন পরিণতই নয়, তাতে রং লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা তাকে সারা জীবনের মতন অযৌক্তিক করে দেবে, তার নাকের ওপর রঙিন চশমাটা একদম চিরস্থায়ী করে দেবে।
আপাতদৃষ্টিতে অপরিণত মন বিষানোর কাজটা হয়তো সোজা কিন্তু এর ফল বড় মারাত্মক। সেই কারণেই আজ যখন সারা দেশে ডানপন্থার জয়জয়কার, যে বাঙালির হাত ধরে আধুনিক ভারতে এই মতবাদের হাতেখড়ি, জাতীয়স্তরে তার নীতি নির্ধারণের জায়গায় আজ আর সেই বাঙালির অস্তিত্বই নেই। কারণ বাঙালির প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ডানপন্থীদের সম্পর্কে ঠিক সেই ভুল কথাগুলোই বোঝানো হয়েছে যা খুসওয়ান্ত সিং লিখেছেন। সানা গাঙ্গুলি একটি বাচ্চা মেয়ে হলেও, বিখ্যাত ব্যক্তির সন্তান বলেই এত হৈচৈ হচ্ছে। নাহলে কোনো অনামা বাচ্চা নিজের খেয়ালে কোথায় কি লিখলো না লিখলো বা বললো না বললো, তা নিয়ে কেউ মাথাই ঘামাত না।
সব কিশোর-কিশোরী কিন্তু সানার মতন বিখ্যাত নয়। তারা নিজেদের মধ্যে কি আলোচনা করছে তা হয়তো তাদের অভিভাবকরাও খেয়াল করেছেন না। নীরবে সারা দেশ জুড়ে ভবিষ্যতের বিদ্বেষের রাজনীতির বীজ বোনা হয়ে চলেছে, অথচ আমরা বাবা-মায়েরা হয়তো জানতেই পারছি না। আমাদের সন্তান যেন সুস্থ চেতনার অধিকারী হয়, তারা বড় হয়ে যেন নিরপেক্ষভাবে যে কোনো বিষয়কে স্বচ্ছ দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে নিজের হিতে, সমাজের হিতে সঠিক নির্ণয় নিতে পারে, অভিভাবক হিসেবে সেটাই তো আমরা চাই। এটা প্রত্যেক শিশুর অধিকারও বটে।
আজ হটাৎ যখন যাদবপুরে আজাদীর স্লোগান শুনি তখন আমাদের মধ্যে অনেকেরই মনে হয় এরা কোন বিকৃত শিক্ষাব্যবস্থার শিকার? এদের দুর্বিনীত অভব্য অছাত্রসুলভ আচরণ অভিভাবকদের অনেককেই বিস্মিত করে। এগুলো কিন্তু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নিজেদের সন্তানের প্রতি আমাদের আরো বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। ওদের ওপর কোনো কিছুই চাপিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। চারদিকে বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা আর নিয়মিতভাবে জল আর সার দেওয়া, এটুকুই তো যথেষ্ট। বাকি মহীরুহ তার ব্যাপ্তিকে নিজের বীজের মধ্যেই লুকিয়ে নিয়ে এসেছে, সে ঠিক তার মতন করে বেড়ে উঠে একদিন সবাইকে ফুল দেবে, ফল দেবে, প্রয়োজনে ছায়াও দেবে।
No comments:
Post a Comment