দুদিকে যেন দুটো সমান্তরাল জগৎ - বাইরে আর ভেতরে, শরীরে আর মনে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আর বোধগ্রাহ্য অবস্থার। দুদিকেই জীবনধারণ, তবে আপাতদৃষ্টিতে দুরকমের মনে হলেও, আসলে হয়তো নিরবিচ্ছিন্ন। সামনে যা দেখছি, শুনছি, চাখছি, অনুভব করছি তা তো সত্যি বটেই, সেসবের জন্য ভেতরে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, সেটাও তো একইরকমের সত্যি, অস্বীকার করার উপায় নেই।
বাড়ির বাইরে দুটো লোক তারস্বরে চিৎকার করে ঝগড়া করছে, ইচ্ছে না থাকলেও তাদের বৃত্তান্ত শুনতে হচ্ছে, যা পড়ছি তাতে মনোনিবেশ করায় ব্যাঘাত ঘটছে, বিরক্ত হচ্ছি, মনে হচ্ছে বাইরে গিয়ে বলি বাবারা, একটু অন্যত্র গিয়ে চেঁচান - সবটাই তো সত্যিকারের experience। আমি তো চাইলেও আর নিজেকে পারিপার্শ্বিক থেকে সম্পূর্ণভাবে insulate করে ফেলতে পারছি না, যে কোনো কিছুই আর মনকে effect করে না, তাই সবটাই আমার নিজস্ব সত্যিকারের অনুভূতি। ঝগড়া হচ্ছে বাড়ির বাইরে, ঝগড়া করছে অন্য কেউ আর প্রভাবিত হচ্ছি আমি - যার সঙ্গে সেই ব্যক্তিদ্বয় বা ঘটনার কোনো সম্পর্কই নেই - এটাকে মিথ্যা বলে এড়িয়ে যাই কিভাবে?
আবার, মন্দিরে গেছি, চোখের সামনে চাঁদোয়ার তলায় ফুলমালাশোভিত ঠাকুরকে দেখতে পাচ্ছি, প্রণাম করছি, তাঁর সামনে বসে আছি যাতে তাঁর নজর পড়ে আমার ওপর, চোখ বন্ধ করে তাঁর কথা চিন্তা করছি, একসময় নিজের ওপর তাঁর দৃষ্টি যেন feel করতে পারছি, এক গভীর প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে আমার মন - এটা যেমন সত্যি তেমনি ধ্যানে বসে আমি নিজের শরীরের বাইরে থেকে নিজেরই বুকের মধ্যে সেই ঠাকুরকে পদ্মাসনে বসা দেখছি - ভেতর বাইরে সব একাকার হয়ে যাচ্ছে - এও তো সত্যিকারের অনুভব। তবে এই দুটি ঘটনার মধ্যে একটা মূল পার্থক্য আছে - ঝগড়া আমার মনকে কষ্ট দিচ্ছে আর ঠাকুরের দর্শন বা ধ্যান আমায় আনন্দ দিচ্ছে। আর সাথে সাথে কোন অভিজ্ঞতাটি আমি চাইছি আর কোনটি চাইছি না, অর্থাৎ আমার বাইরের অভিজ্ঞতাকে নিয়ে ভেতরে যে reaction তৈরি হয় সেটার acceptance ও rejection যেন মনের মধ্যে একটা অদৃশ্য ফিল্টারে ছেঁকে একেবারে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এর আর একটা দিক আছে। ইন্দ্রিয় দিয়ে যা কিছু আমরা শুষে নিচ্ছি, তা আদৌ প্রয়োজনীয় কিনা, হলেও কতটা, সেই প্রশ্ন মনকে বারেবারে নাড়া দেয়। কত rubbish ঢুকে মনকে clog করে দিচ্ছে, ভাবলে আশ্চর্য্য হতে হয় বৈকি। বাইরে ঝগড়া হচ্ছে দেখছি, শুনছি কিন্তু মনের ভেতরে গ্রহণ করেছি না - এই অবস্থায় পৌঁছনোর তীব্র ইচ্ছা তখন তৈরি হয়। অর্থাৎ যেটা আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় সেটা আমি ইচ্ছা করলেই বাইরের দরজায় আটকে দিতে পারি আর যেটা প্রয়োজনীয়, কেবল সেটুকুকেই ভেতরে ঢুকতে দিতে পারি, এই ক্ষমতা যাতে তৈরি হয়, সেই দিকে নজর ঘুরে যায়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যেখানে যা ঘটেছে সবই সত্যি, কিন্তু সব সত্যিতে তো আর আমার কাজ নেই, আমি শুধু সেটুকুই নেবো যেটুকু আমার কাজে লাগবে।
এইখানে আবার তৃতীয় প্রশ্নটি জাগে - হ্যাঁগা, সেই কাজটি কি? সেটা নির্ভর করে আমি এই জীবনটাকে কোন দিকে নিয়ে যেতে চাই, তার ওপর। মাষ্টারমশাই সংসারী ছিলেন তাই ঠাকুর মাস্টারমশাইকে সংসারে থেকে তিনটি কাজ করতে বলেছিলেন - সাধুসঙ্গ, নির্জনবাস আর বিচার। সাধুসঙ্গ মানে সাধুর সঙ্গে সুখদুঃখের গুলতানি করা নয়, সাধুর ভাব গ্রহণ করা। নির্জনবাস মানে me time, সেটা হিমালয়ের বনে গিয়েও হতে পারে অথবা ঘরের কোণে - আসল নির্জনতা তো মনে। আর বিচার মানে হলো সৎ আর অসৎ-এর মধ্যে কি সৎ বুঝে নিয়ে তার ওপর বিশ্বাস অর্থাৎ ইষ্টের ওপর সম্পুর্ন নির্ভরতা - আমি যন্ত্র তিনি যন্ত্রী, এই ভাবকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে হৃদয়ঙ্গম করা। এখন, আমি যদি আমার জীবনটাকে ঠাকুরের দেখানো পথে চালিত করতে চাই তাহলে আমার জীবনে প্রয়োজন একরকম হবে আর যদি রাস্তায় বেরিয়ে ঝগড়া শুনতে চাই এবং ফোড়ন কেটে তাতে আরো ইন্ধন জোগাতে চাই, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই অন্যরকম হবে। প্রয়োজন যেহেতু আমার, কাজও যেহেতু আমি করবো, ফলে দায়ও আমার।
এর একটা চতুর্থ dimension ও আছে - আমি চাইলেই যে course control করতে পারবো, তার স্থিরতা কি? হ্যাঁ, এইটা একটা মস্ত বড় সমস্যা বটে। আমার ক্ষেত্রে যেমন, কত চাইছি বৈষয়িক বিষয় একেবারে ঝেড়ে ফেলে ঝামেলামুক্ত হতে কিন্তু হচ্ছি কই? কারণ আগের আগের জন্মে যেসব জট পাকিয়ে রেখে এসেছি সেসব তো আমাকেই খুলতে হবে, তাই না? একে বলে প্রারব্ধ। এক্ষেত্রে একমাত্র উপায় হলো মায়ের কৃপা - ক্রমাগত প্রার্থনা আর পীড়াপীড়িতে বিরক্ত হয়ে মা যদি একবার ছুট দিয়ে দেন, ব্যাস, কেল্লা ফতে। তবে এ এক মারাত্মক আবদার কিন্তু, বহুজন্মের তপস্যার ফলে কেউ কেউ সন্ন্যাসী হন, আর তাঁদের মধ্যেও এমন blissful state of existence মাত্র কয়েকজনের কপালেই জোটে। এমন বেয়াড়া আবদার বাপের কাছে করলে লাঠিপেটা খেতে হতে পারে। সেই জন্যই তো মায়ের কাছে যত বাজে আবদার - সাধনভজন কিছু নেই তবু ওই শান্ত অবস্থা চাই!
এইবার ভেতর আর বাইরের মূল বিষয়। একবার স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে পায়েস খেতে দেওয়া হয়েছে, তাতে মহারাজ একটি চুল দেখতে পেয়ে খুব রেগে গেছেন। যেই জানতে পেরেছেন যে তাঁরই শিষ্য সুয্যি মহারাজ অর্থাৎ স্বামী নির্বাণানন্দজী সেটি রেঁধেছেন, রাগের চোটে রান্নাঘরে গিয়ে তাঁকে খুব করে মারছেন আর তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই মার খাচ্ছেন। স্বামী প্রেমানন্দজী গোলযোগ শুনে দেখতে এসে সুয্যি মহারাজকে বলছেন, "ওরে সুয্যি দাঁড়িয়ে আছিস কেন, পালা পালা"। সুয্যি মহারাজ যে উত্তরটি দিয়েছিলেন, সেটি এই ক্ষেত্রে শেষ কথা - "যেখান থেকে পালাবার ছিল পালিয়েই তো এসেছি, আর কোথায় পালাবো?"। ব্যাস, এই একটা কথাতেই জীবনের direction কি হওয়া উচিত তা যেন একেবারে জলের মতন স্বচ্ছ হয়ে যায়।
ভেবে দেখলে মায়ের কাছে যে কৃপা চাইছি সেটি আসলে শরণাগতি। সাধুর ভাব কি? শরণাগত, যাতে বাকি দুনিয়াদারী সব অপ্রাসঙ্গিক। নির্জন মন কেমন? শরণাগত, যেখানে দুনিয়াদারী ঢুকতে পারেনা। আর বিশ্বাস? সেও শরণাগতি - সব ছেড়ে তোমার আশ্রয়ে এসেছি, তুমি যেমন রাখবে তেমন থাকবো, যেখানে রাখবে সেখানে থাকবো আর আমি তোমায় ভুলে গেলেও তুমি আমায় ভুলো না। রাজা মহারাজ কেন শিষ্যকে মেরেছিলেন? গুরু বা ইষ্টকে কোনো কিছু নিবেদন করার আগে নিজেকে যেভাবে মন প্রাণ দিয়ে প্রস্তুত করতে হয়, সুয্যি মহারাজ সেদিন সেটি ভুলে গিয়েছিলেন। গুরু কিন্তু তাঁকে ভোলেননি। ভক্তের ওপর নিজের অধিকার তাই জোর করে কায়েম করেছিলেন। নিজের শরীর যাওয়ার ঠিক আগে রাজা মহারাজ তাঁর এই শিষ্যকে আশীর্বাদ করেছিলেন এই জীবনেই তাঁর ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হবে। পরবর্তীকালে গুরুর কৃপায় পরম পূজনীয় শ্রীমৎ স্বামী নির্বাণানন্দজী মহারাজের সত্যিসত্যিই তাই হয়েছিল।
No comments:
Post a Comment