Tuesday, December 13, 2022

একটু ঘুরে আসি

বয়সের সাথে সাথে মানুষের মন বোধহয় আরো বেশি নরম হয়ে পড়ে, আরো বেশি সংবেদনশীল, আরো আবেগপ্রবণ, মানসিকভাবে অনেক বেশি vulnerable - অন্ততঃ নিজের ক্ষেত্রে আমি সেটাই লক্ষ্য করছি। অজস্র শোক পেয়েছি জীবনে, অনেক আঘাত, তবে সে সবে খুব যে একটা প্রভাবিত হয়েছি এতকাল, তেমনটা কিন্তু নয়। হয়তো ছোটবেলা থেকেই দুঃখকষ্ট সয়ে সয়ে সহ্যশক্তি অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছিল, যে কোনো অবস্থাতেই একা লড়াই করার মানসিকতা, ঘুরে দাঁড়াবার অদম্য ইচ্ছাশক্তি ইত্যাদির ফলে কম বয়সে আঘাত কাটিয়ে ওঠাও সহজতর ছিল। এতদিন অতি নিকটজনের বিচ্ছেদও আমায় এতটা দিশাহারা করে দিতে পারেনি, চট করে সামলে উঠেছি। এবার আর যেন পেরে উঠছি না। কত চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই শোকের বৃত্ত থেকে বেরোতে পারছি না। ঘুরে ফিরে বারেবারে বুকের ফাঁকা জায়গাটায় এক একটা ঢেউ ধাক্কা মারছে আর ভেতরটা পুরো হায় হায় করে উঠছে। একজন শ্রদ্ধেয় মহারাজ কথামৃতকার শ্রীমকে quote করে গতকাল তাঁর পোস্টে লিখেছিলেন 'ত্যাগের পথে বিঘ্ন, স্নেহ। স্নেহতেই সংসার চলছে। সংসারই স্নেহ। এইটি ঈশ্বরের চাতুরী। এ দিয়ে তিনি জগৎকে বেঁধে রেখেছেন।' পড়ার পর থেকে আমি ভাবছিলাম যে এ একেবারে সত্যি কথা, এ কথায় তো কোনো ভুল নেই। খালি মুশকিল হলো, যখন কিছুই পড়িনি, মায়া কি জানতাম না, তখন মন অনেক শক্ত এবং নির্দয় ছিল আর এখন যখন কিছু কিছু পড়া হয়েছে, অহংকার সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে, তখন মনটা যেন মাখা সন্দেশের মতন নরম তুলতুলে হয়ে গেছে যাতে স্নেহের অন্ত নেই - এবার কি করি? এখন কারো কষ্ট দেখলে বা কষ্টের কথা শুনলে ঝপ করে চোখে জল এসে যায়, কাউকে কোনো দুস্থের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে দেখলে চোখ ভিজে যায়, এমনকি রেডিওতে দুঃখের গল্প শুনলেও কান্না পায়, কিসের মায়া আর কিসের কি? যাইহোক, আমার আর এই বাড়িভর্তি স্মৃতির আবহাওয়ার মধ্যে থাকতে ভালো লাগছে না তাই আগামীকাল আমি আর গিন্নি দিন কয়েকের জন্য পালাচ্ছি। গতকাল শেষকৃত্য করতে নিয়ে যাওয়ার আগে লাড্ডুকে একটা সেন্ট মাখিয়ে দিয়েছিলাম। আজ সকালে ওই ঘরের দরজাটা খুলতেই সেই সেন্টের গন্ধটা ধক করে নাকে এসে লাগলো। আসলে ওই গন্ধটা থেকে পালাচ্ছি। পালাচ্ছি সকাল আর বিকেলের চায়ের সাথে বিস্কুটের প্যাকেটের প্রথম চারটে বিস্কুট থেকেও, যেগুলোকে আমরা বলতাম লাড্ডুট্যাক্স। পালাচ্ছি নিজেদের থেকে, নিজেদের যন্ত্রণাদায়ক familiar living space থেকে আর নিজেদের এতদিনের অভ্যেস থেকে - যে অভ্যেসের বশে এখনো ভুল করে বেশি ভাত ফুটিয়ে ফেলা হচ্ছে বা ভুল করে ওর জলের পাত্র ভরে দেওয়া হচ্ছে। অনেকগুলো নাম ছিল ছেলেটার - গুবলেট, পায়ে-পায়ে, লাড্ডুলিং, লেডো, গাবলু, আর ও সবেতেই বাঁই বাঁই করে লেজ নাড়িয়ে সারা দিতো। আমি লবির সোফাটায় বসে বই পড়ছি, ও পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে আর ওর দোদুল্যমান লেজটা সোফার গায়ে লেগে লেগে ক্রমাগত ফট ফট করে আওয়াজ করছে - পালাচ্ছি সেই আওয়াজ থেকেও।

No comments:

Post a Comment