মান্না দের অনবদ্য কণ্ঠে সাধক রামপ্রসাদের লেখা একটি কালীকীর্তন শুনছিলাম, 'কে জানে কালী কেমন? ষড়দরশনে না পায় দরশন ৷৷ মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন ।' বড় সুন্দর, বড়ই সুন্দর এই গান। যোগের দিকটা ছেড়ে আমার কেবল মনে হলো সত্যিই তো, মা কালী আসলে দেখতে কেমন? তিনি কালো না নীল, তাঁর গলায় মুন্ডমালা না জবার মালা, তাঁর হাত দুটি না চারটি, তাঁর পরণে লাল বেনারসি না তিনি বস্ত্রহীনা, তাঁর পায়ে কি মল থাকে আর সেগুলি কি ঝম ঝম করে বাজে, ইত্যাদি।
কালী কেমন জানতে গেলে তো সাধনায় অনেক দূর যেতে হবে, যেটা তাঁরই কৃপা ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি দেখতে কেমন, সেটি তো যাঁর যাঁর তাঁর তাঁর বিষয়। রামপ্রসাদের কাছে তিনি ছোট একটি মেয়ে হয়ে এসেছিলেন, যিনি তাঁকে বেড়া বাঁধতে সাহায্য করতেন। শ্রীশ্রীমায়ের কাছে তিনি এক আদিবাসী যুবতী কন্যা হয়ে এসেছিলেন, যিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে অসুস্থতা চলে যায় আর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তিনি মাতৃরূপা, বোধে সদাজাগ্রতা, একাধারে জননী এবং জগ্গজননী। ভাবছিলাম আমাকে যদি মা কালী কোনোদিন কৃপা করে দর্শন দেন, কি রূপে তিনি আমার সামনে আসবেন, বা বলা ভালো কোন রূপে আমি তাঁকে দেখতে চাইবো, এইসব আরকি।
যতক্ষণে এইসব ভাবছি ততক্ষণে রামপ্রসাদী শেষ হয়ে আমার হেডফোনে শ্রীমৎ স্বামী সর্বজ্ঞানন্দজি মহারাজের গাওয়া অন্য গান বাজতে শুরু করেছে,
'দেবী প্রসন্নবদনে করুণাবতারে দিব্যোজ্জ্বলদ্যুতিময়ী ত্রিজগজ্জনিত্রি।'
ব্যাস, যেই দেবীর এই অপূর্ব বর্ণনা কানে গেল, ঝপ করে ১৯১৩ সালে ব্রহ্মচারী গণেন্দ্রনাথের তোলা শ্রীশ্রীমায়ের সেই ছবিটা মনের মধ্যে বিদ্যুতের মতন জ্বলে উঠলো, যেখানে জয়রামবাটিতে পুরানো বাড়ির দাওয়ায় তিনটি কাঠের খুঁটির মাঝামাঝি জায়গায় তিনি বসে আছেন, পাদুটি উঠোনে পাতা, তার পায়ের দুই তর্জনীতে দুটি লোহার আঙ্গট, হাতদুটি কোলের উপর জোড় করা, দুহাতে ঠাকুরের উপহার দেওয়া গঙ্গাপাড়ে সীতামাঈর হাতে দেখা ছিলেকাটা বালাজোড়া, পরণে সরু লালপেড়ে সাদা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা, গলায় দুছড়া রুদ্রাক্ষের জপমালা, মুখে স্মিত হাসি, দাওয়ায় মায়ের পেছনদিকে একটা খুঁটের ওপর গোটাকয়েক ধানের বস্তা।
এই তো আমার মা কালীর সত্যিকারের রূপ, কল্পনা নয়, একেবারে জলজ্যান্ত, যাঁর পাদপদ্মে মাতৃময় শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সমস্ত সাধনার ফল, মায় নিজের জপমালাটি পর্য্যন্ত নিবেদন করেছিলেন! জ্ঞানপথে এঁকে বুঝতে গেলে মুলাধার থেকে সহস্ররার পর্য্যন্ত উঠতেই হবে আর সহজে পেতে গেলে একবার সর্বশক্তি দিয়ে 'মা' বলে ডাকলেই হলো, কিছুতেই দূরে দূরে থাকতে পারবেন না, একেবারে দুহাত বাড়িয়ে আগলাতে চলে আসবেন। আহা, কি সুন্দরই না গানটা! তিনি ত্রিজগতের জননী, তাঁর শরীর থেকে এক দিব্য উজ্জ্বল দ্যুতি নির্গত হয়ে চারপাশে এক জ্যোতিবলয় সৃষ্টি করেছে (যা ওই ছবির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেও স্পষ্ট দেখা যায়), তিনি করুণার প্রতিমূর্তি আর শ্রীমুখমন্ডল জুড়ে যেন এক অপার্থিব প্রসন্নতা। আমার মন জানে কালী কেমন।
মা আসলেই শক্তির বিভিন্ন রূপ ধারণ করে বিভিন্ন সময়ে হাতেগোনা কয়েকজন ভক্তকে কৃপাদর্শন দিয়েছেন, এটা কোনো কল্পনার বিষয় নয়, যদিও তিনি নিজের দৈবী স্বরূপকে ঢেকে রাখতে প্রাণপন চেষ্টা করতেন। এমনই একটি ঘটনা একবার শারদীয় দুর্গোৎসবের সময়কার। মা সেবার পুজোর ঠিক আগে বিষ্ণুপুরের সেনবাড়ি হয়ে কলকাতা যাত্রা করবেন। সঙ্গে বাঁকুড়ার বিভূতি ঘোষ, ডাক্তার মহারাজ প্রমুখ। এমন সময় সেন বাড়িরই অধীরেশ্বর নামের এক কিশোর বায়না ধরলে মায়ের সাথে কলকাতা যাবে। সে কখনো কলকাতার দুর্গাপ্রতিমা দেখেনি, এবারে প্রাণভরে দেখতে চায়। নানাভাবে ছেলেকে বোঝানো-ভোলানোর চেষ্টা হল। বাড়ির কর্তারা নানারকম সুখাদ্যের লোভ দেখালেন। তাতেও কাজ না হলে কড়া ধমক দেওয়া হলো কিন্তু অধীরেশ্বর একেবারেই নাছোড়বান্দা। তখন মা নিজেই তাকে অন্য একটি ঘরে নিয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরে মা বেরিয়ে এলে সবাই তো থ। যে কিনা তিষ্ঠোতে দিচ্ছিল না কাউকে, এরই মধ্যে একেবারে সুবোধ বালক হয়ে গেছে! মা হেসে বললেন, “ছেলেমানুষকে কি বকতে আছে? ওরা তো বায়না করবেই… আদর করে ভোলাতে হয়।” এর বেশ কয়েক বছর পর, মা তখন আর নশ্বর দেহে নেই, এক দুর্গাপুজোয় আবার সেই অধীরেশ্বর বিভূতিবাবুর গৃহে এসেছেন। তাঁকে প্রতিমা দর্শনের জন্য ডাকা হলে তিনি বললেন, “জ্যাঠামশাই, আমি আর দুর্গাপ্রতিমা দর্শন করি না। শ্রীশ্রীমা যে জ্যান্ত দুর্গা দর্শন করিয়েছিলেন, সে মূর্তির পর আর কোনো মূর্তিই মনে ধরে না।”
No comments:
Post a Comment