মানুষই নাম দেয়, আবার মানুষই সেই নামের বশ হয়ে পড়ে। বাইরের খোসাটার যে নাম, ভাবে ভেতরের শাঁসটারও বুঝি তাই নাম। যেমন কাঁঠালের খোসাটার তো কোনো ব্যবহার নেই, ভেতরের কোয়াগুলোই আসল, কিন্তু যেহেতু ওই খোসাটা না থাকলে কাঁঠালই থাকে না, আমরা কাঁঠালের কথা ভাবলেই একটা ভোঁতাকাঁটাদার মোটাখোসাওলা ভারী ঝুলন্ত লম্বাটে ফলের কথাই ভাবি, ভেতরের কোয়ার কথা ভাবি কই? কলার খোসা ছাড়িয়েই খাই কিন্তু কলা বলতেই যে ছবিটা মনে ভেসে ওঠে সেটা কি হলদে বা সবজে খোসাওলা ফলের না ভেতরের সাদা শাঁসটির?
আমরাও আমাদের খোসা দিয়েই পরিচিত হই, ওটার নামই আমাদের নাম হয়ে ওঠে। ওটার ভেতরে যিনি আছেন, যাঁকে খোসাটা ধরে রেখেছে, তিনি নাম-রূপের পারে, তিনি অনাদি, অব্যক্ত, অসীম। অস্ত্র তাঁকে কাটতে পারে না, আগুন তাঁকে পোড়াতে পারে না, জল তাঁকে ভেজাতে পারে না, হওয়া তাঁকে শুকাতে পারে না - নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ। ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ॥ জানি, কিন্তু মানি কই?
ঠিক যেমন কাঁঠালের খোসাকে বাদ দিয়ে কাঁঠালের কথা ভাবা যায় না, সেরকমই আমরা আমাদের শরীরকে দেওয়া নামকে বাদ দিয়ে ভেতরের আমিত্বকেও ভাবতে পারি না, ফলে আমরা নিজেদের এই বাইরের শরীরটিকে খোসার জায়গায় ভুল করে গোটা ফল হিসেবেই ভেবে বসি। যতক্ষণ কাঁঠালের খোসা থাকে ততক্ষণ যেমন ভেতরের কোয়া দেখা যায় না, তেমনই যতক্ষন শরীরবোধ প্রবল থাকে ততক্ষণ তার ভেতরটা দেখার ইচ্ছাই হয় না। শরীরবোধ মানে অহংকার, শারীরিক চাহিদা, জাগতিক বাসনা, ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধি ইত্যাদির সংমিশ্রণ।
তবে গাছে কাঁঠাল রেখে দিলে যেমন বাড়তে বাড়তে একসময় পেকে এত ভারী হয়ে যায় যে বোঁটা থেকে খসে মাটিতে পড়ে ছেতড়ে যায়, ঠিক সেইরকমই ভোগ যখন পর্য্যাপ্ত পর্যায়ে পৌঁছায় তখন হটাৎ একদিন মনে হয়, সবই তো হলো, অতঃ কিম্? কার পক্ষে কোন পর্য্যায়ের ভোগ সম্পুর্ন হলে তা পর্য্যাপ্ত হয়, সেটা অবশ্য তাঁর নিজস্ব ব্যাপার তবে কোনো না কোনো এক মনুষ্যজন্মে সবার মনেই এই প্রশ্নটি উঠবেই উঠবে, নইলে তিনি মানুষের শরীর পেতেন না। মানুষের শরীর পেলে কি হয়? একমাত্র মানুষই নিজের খোসা নিজে ছাড়াতে পারে।
ভেতরে যিনি আছেন, যিনি এক শরীর থেকে অন্য শরীরে যাওয়ার সময় সাথে সাথেই যান, তিনি নামহীন। খোসা যখন বোঝে সে কেবল খোসা তখন সে ভেতরের শাঁসের জন্য একটা আলাদা নাম খোঁজে আর তার একটি রূপও কল্পনা করে নেয় কারণ খোসা তার ভেতরে থাকা শাঁসকে দেখতে পায়না। এই নাম কল্পিত, এই রূপও কল্পিত, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত ক্ষমতা অসীম কারণ যাঁকে উদ্দেশ্য করে এই নাম-রূপের কল্পনা, তিনি নিজেই যে অসীম। তবে তিনি যেহেতু জানেন যে আমরা নিজেদের মতো করে তাঁকেই ডাকছি, তাঁরই দর্শনের প্রতীক্ষায় বসে আছি, ফলে আমাদের কল্পনায় তিনি যেমনই হোক না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না, তিনি ঠিকই সারা দেন।
এইখানেই নাম জপের মাহাত্ম। নাম মানেই তিনি। আর তিনি মানেই আমি। এটা এমন একটা একমুখী রাস্তা যার তিনটি স্তর আর তিনটি বাঁক - প্রথমে তিনি প্রভু আমি ভৃত্য, তারপর তিনি আর আমি পরমাত্মীয়, তারপর তিনিই আমি আর আমিই তিনি; একবার একটি বাঁক পেরিয়ে গেলে আর পেছন ফিরে আগের রাস্তাটা দেখা যায় না। তবে শুরুটা বড্ড গোলমেলে। প্রথমত, যে নামটা জপ করছি সেটা কোনো প্রিয় শরীরের নাম নয়, তাই তার সাথে কোনো ভৌতিক বন্ধন নেই। দ্বিতীয়ত, যাঁর নাম জপ করছি তাঁকে আমি দেখিনি, তাঁর কন্ঠস্বর শুনিনি, তাঁর সম্পর্কে কল্পনা ব্যতিরেকে আর কোনো মানবিন্দু নেই। তৃতীয়ত, এই অচেনা অজানা অস্তিত্বের নাম ধরে লাগাতার ডেকে যাওয়ার সময় আমি নিশ্চিত নই যে এর পরিণতি কি হবে।
এইখানে দুটি বিষয় খুব সাহায্য করে - গুরু এবং ইষ্ট। আর সেই ইষ্ট যদি অবতাররূপ গ্রহণ করে ধরায় অবতীর্ণ হয়ে থাকেন, তাহলে তো সাধকের সামনে একেবারে জলজ্যান্ত মানবিন্দু আছে, কল্পনার কোনো অবকাশই নেই। এ যে কি সুবিধার বিষয়, যাঁরা অনুভব করেছেন, তাঁরা সবাই জানেন। যিনি নাম-রূপহীন, তিনি স্বয়ং সশরীরে বর্তমান, তাঁর নির্দেশ লেখা আছে - পড়া যায়, তাঁকে চোখ খুলে ছবিতে দেখা যায়, আবার চোখ বন্ধ করে হৃদয়েও দেখা যায় আর তাঁর সাক্ষাৎ কায়িক ও বৌদ্ধিক প্রতিনিধি আমার গুরুদেব, যাঁকে সত্যি সত্যিই দেখেছি, ছুঁয়েছি, কথা বলেছি, যিনি আমাকে কৃপা করে কানে ইষ্টনাম শুনিয়েছেন এবং সেইসাথে আমার আধ্যাত্মপথের ভারও নিয়েছেন।
দুটো জিনিস আছে যার ওপর নির্ভর করে এগোতে পারলে এই যাত্রা সহজ হয়। এক, ভরসা আর দুই, অধ্যবসায়। নিজের ওপর ভরসা - ঠিক পথ বেছে নিয়েছি এবং শরীররূপী জীবনে যখন সফলতা পেয়েছি তখন আধ্যাত্মিক জীবনেও সফলতা পাবো। গুরুর ওপর ভরসা - যিনি নিজে ব্রহ্মজ্ঞানী, যিনি নিজে আত্মোপলব্ধি করেছেন, তিনি কৃপা করে আমায় যে মহামন্ত্র দিয়েছেন সেটি ভয়ঙ্কর শক্তিশালী এবং তার ফল ফলবেই। তাছাড়া, ভুল করলে গুরুমহারাজ ঠিকই শুধরে দেবেন, তা তিনি শরীরে থাকুন বা নাই থাকুন। নামের ওপর ভরসা - নিরন্তর নামজপ করতে থাকলে তিনি একদিন না একদিন সারা দিতে বাধ্য হবেন কারণ এটি কোনো কল্পিত নাম নয়, তাঁর সত্যিকারের নাম। আর দ্বিতীয় হলো অধ্যবসায় - ওটি না থাকলে যেমন শরীররূপী জীবনেও জাগতিক নিরিখে সফল হতে পারতাম না, আধ্যাত্মিক জীবনেও সফল হতে পারবো না। জীবনে যদি কিছু পেতে হয়, লেগে থাকতেই হবে। জীবন যেন পদ্মফুলের পাপড়ির মতন - ধীরে ধীরে পরতে পরতে খোলে আর শেষে একটা গোটা ফুল হয়ে মায়ের পদপ্রান্তে নিবেদিত হয়।
সবার ওপর হলো দৈবকৃপা। স্থির বিশ্বাস - আমি ঠাকুরকে যেমন দেখছি, ঠাকুরও তেমনি আমায় দেখছেন। আমি যেমন ঠাকুরের জন্য হৃদয়ে সহস্র শতদলবিশিষ্ট পদ্মাসন পেতে রেখেছি, যার ওপরে তিনি ইষ্টরূপে উপবেশন করে আছেন, তেমনি তাঁর হৃদয়েও আমার জন্য জায়গা নির্ধারিত আছে। তিনি যখন কৃপা করে গুরুকে পাঠিয়ে তাঁর পূণ্যনাম আমার কান অবধি পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, সেই নাম যাতে আমি আত্মসাৎ করতে পারি, নিশ্চয় তাঁর সেই আশীর্বাদও অবশ্যই আমার ওপর আছে। তাঁর সবটুকু কৃপাতে আমার জন্মগত অধিকার এবং তা আমি আদায় করেই ছাড়বো, তাতে যত জন্মই লাগে লাগুক, কুছ পরোয়া নেহি। দৈবকৃপা ছাড়া মায়াকে উপেক্ষা করার আর কোনো উপায় নেই। আর মায়ার পাল্লায় পড়লেই সে আবার টেনে নিয়ে সেই খোসার ওপরেই ফেলবে - আবার সেই শরীর, আবার সেই নাম, আবার সেই ইন্দ্রিয়ের হাতছানি, আবার শুরু থেকে শুরু।
No comments:
Post a Comment