আজ চতুর্থী - মৃন্ময়ী মূর্তিতে মা হয় অধিকাংশ পূজাস্থলে ইতিমধ্যেই এসে পৌঁছিয়েছেন অথবা আজ পৌঁছবেন। আজ আর আগামীকাল বাড়ি বা আবাসনের পুজোগুলোতে মাকে খুব করে সাজানো গোজানো হবে, তারপর ষষ্ঠীতে সকালে কল্পারম্ভ আর বিকেলে বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের পর মা তাঁর চিন্ময়ীরূপ ধারণ করবেন।
এই তো মাত্র শতখানেক বছর আগেও এই মহাশক্তি জগজ্জননী মহামাঈ মানুষের শরীর ধারণ করে বহুবছর প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনে ছিলেন, তাই স্বামীজী শ্রীশ্রীমাকে বলতেন জ্যান্ত দুর্গা। এখনও মা সূক্ষ্মশরীরে বিদ্যমানা, তাই বেলুড় মঠে দুর্গা পূজার সংকল্প মায়ের নামেই করা হয়। মা এখন ইষ্টরূপে ভক্তের হৃদয়ে বাস করেন।
শ্রীশ্রীমায়ের কথা বইটির ১৯০ পৃষ্ঠায় স্বামীজী আর মায়ের একটি অসাধারণ সরস কথোপকথনের উল্লেখ আছে, যার গভীরতা সীমাহীন। স্বামীজী একদিন মাকে বলছেন, "মা, আমার আজকাল সব উড়ে যাচ্ছে।" মা হেঁসে বললেন, "দেখো দেখো, আমাকে কিন্তু উড়িয়ে দিও না!" তখন স্বামীজী মহাব্যস্ত হয়ে উত্তর দিচ্ছেন, "মা, তোমাকে উড়িয়ে দিলে থাকি কোথায়? যে জ্ঞানে গুরুপাদপদ্ম উড়িয়ে দেয় সে তো অজ্ঞান। গুরুপাদপদ্ম উড়িয়ে দিলে জ্ঞান দাঁড়ায় কোথায়?"
এটি তো কেবল একজন শিষ্য ও গুরুপত্নীর মধ্যে কথোপকথন নয়, এক ব্রহ্মজ্ঞ মহর্ষি এবং পরমাপ্রকৃতির মধ্যে, ভক্ত আর ভগবানের মধ্যে আর শিষ্য ও সদগুরুর মধ্যে চিরকালীন সম্বন্ধের একটি অনবদ্য দলিল, যার প্রত্যেকটি শব্দের মধ্যে গভীর দর্শন লুকিয়ে রয়েছে।
স্বামীজী বলছেন, মা, আজকাল সব উড়ে যাচ্ছে - এর অর্থ কি? বোধের এমন এক সীমায় স্বামীজী তখন অবস্থান করছেন যে এই শরীর, এই পার্থিব জগৎ, মায়ার বন্ধন ইত্যাদি কোনো কিছুই আর তাঁকে ধরে রাখতে পারছে না, তিনি যে সত্যি সত্যিই অজড় অমর আত্মা, এই ব্রহ্মজ্ঞান তাঁর মধ্যে মূর্তরূপ ধারণ করে তখন সর্বক্ষণ বিরাজমান।
স্বামীজীর 'বাঙাল' শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর লেখা 'স্বামী শিষ্য সংবাদ' আর মানসকন্যা সিস্টার নিবেদিতার লেখা 'The Master, as I saw Him' বইগুলোতে তাঁর এই ধরণের ইন্দ্রিয়াতীত নানা অনুভূতির বর্ণনা রয়েছে। ঠাকুরের মধ্যেও আমরা ঘনঘন 'এই আছি এই নেই' ভাব দেখেছি, মহারাজ এবং ঠাকুরের অন্যান্য সন্তানদের মধ্যেও দেখেছি - আত্মজ্ঞানীদের যে এমনটা হয়, তা শাস্ত্রেও বর্ণিত।
যাইহোক, গুরুর কৃপায় যে তাঁর আত্মদর্শন হয়েছে, স্বামীজী মাকে সেটাই বলছেন। আর মা কি বলছেন? সেটা আরো মারাত্মক - দেখো, আমায় কিন্তু উড়িয়ে দিও না! ঠাকুর নয় কিন্তু, 'আমি'! এই আমি কে? স্বামী অভেদানন্দজি তাঁর মাতৃস্তোত্রে যাঁর সম্পর্কে বলছেন, "শরণাগত-সেবকতোষকরীং, প্রণমামি পরাং জননীং জগতাম্" অর্থাৎ, শরণাগত সেবকের তুষ্টিবিধানকারিণী এই পরমা জগজ্জননীকে প্রণাম করি। শরণাগতি - এটি ছেড়ো না বাপু, এটি ছাড়লেই সর্বনাশ! তোমার এই যে তুরীয় অবস্থা, সেটি আমারই দেওয়া, আমিই 'জননীং জগতাম্' - ভুল করে আমাকেই যেন আবার উড়িয়ে বোসো না।
এরপর স্বামীজীর যে উত্তর, সেটা classic - স্বামীজী তো ততক্ষনে বুঝে ফেলেছেন আবেগের বশে কার সামনে কি কথা বলে ফেলেছেন, তিনি একেবারে শশব্যস্ত, সামান্য যে অহংবোধটুকু শরীরধারণ করার জন্য প্রয়োজন হয়, সেটুকুকেও যেন সম্পূর্ণভাবে মায়ের পায়ে অর্পণ করে দিয়ে বলছেন, মা, তোমা ছাড়া আমার আর আলাদা অস্তিত্ব কোথায়? তুমি আছো তাই আমি আছি, তোমায় উড়িয়ে দিলে যে আমার অস্তিত্বটুকুও উড়ে যায়।
তারপরেই স্বামীজী নিজের মনের গোপন কথাটি মায়ের সামনে তুলে ধরছেন। মা, তুমিই আমার গুরু, তুমি ঠাকুর নামক ব্রহ্মাগ্নির দাহিকাশক্তি, তুমি কৃপা করে আমায় আত্মজ্ঞান দিয়েছো - সেই তোমাকেই যদি অস্বীকার করি, তাহলে তো সে আমার অজ্ঞান। গুরু আর ইষ্ট এক, গুরু বিনা জ্ঞান নেই, আমার যা কিছু realisation হয়েছে সব তোমার দয়ায় - 'তাং সারদাং ভক্তিবিজ্ঞানদাত্রীং, দয়াস্বরূপাং প্রণমামি নিত্যম্' - তুমি সারদা, সরস্বতী, ভক্তিবিজ্ঞান-দায়িনী, দয়াস্বরূপিনী, তোমায় নিত্য প্রণাম করি।
ওই বইটিরই পরের পাতায় মায়ের আর একটি কথা লিপিবিদ্ধ আছে, যা স্বামীজী আর মায়ের মধ্যে এই বার্তালাপকে sum up করে। মা বলছেন, "জ্ঞান হলে ঈশ্বর-টীশ্বর সব উড়ে যায়। 'মা' 'মা' শেষে দেখে। মা আমার জগৎ জুড়ে। সব এক হয়ে দাঁড়ায়। এই তো সোজা কথাটা।" আহা, এই সোজা কথাটাকে উপলব্ধি করা যে আসলে কত কঠিন, মহামাঈর অহেতুকি কৃপা না হলে যে সমগ্র জীবজগৎকে জগৎপ্রসবিনীরূপে দেখা সম্ভবই নয়, আর সেটাই যে আসল জ্ঞান, তা আর আমরা বুঝি কই? বুঝলে, মায়ের কাছে নির্বাসনা আর শরণাগতি প্রার্থনা করার এটাই কিন্তু সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
No comments:
Post a Comment