আজ দেবীপক্ষের দ্বিতীয়া - মা আসছেন। মায়ের স্বরূপ বর্ণনা করে ঋষি মার্কণ্ডেয় অর্গলাস্তোত্রমের প্রথম দিকে বলছেন,
শ্লোক ১
"হে দেবী চামূণ্ডা, তোমার জয় হোক। হে দেবী, তুমি জীবের দুঃখনাশকারিণী; তুমি সর্বভূতে অবস্থিতা; আবার তুমিই প্রলয়ের অন্ধকার স্বরূপিণী কালরাত্রি। তোমায় নমস্কার করি।"
শ্লোক ২
"হে দেবী, তুমি সর্বোৎকৃষ্টা জয়যুক্তা দেবী জয়ন্তী; তুমি জন্মমৃত্যুবিনাশিনী মোক্ষপ্রদায়িনী দেবী মঙ্গলা; তুমি সর্বসংহারকারিণী কালী; তুমি সুখদায়িনী ভদ্রকালী; আবার তুমিই প্রলয়কালে ব্রহ্মা প্রমুখের মাথার খুলি হস্তে নৃত্যরতা কপালিনী। তুমি দুর্গা, কারণ বহু কষ্ট স্বীকার করে তবে তোমায় লাভ করা যায়; তুমি চৈতন্যময়ী শিবা; তুমি করুণাময়ী ক্ষমা; তুমি বিশ্বধারিণী ধাত্রী; তুমি দেবগণের পোষণকর্ত্রী স্বাহা ও পিতৃগণের পোষণকর্ত্রী স্বধা। তোমায় নমস্কার করি।"
এ দুটি শ্লোক থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে জগজ্জননী মহামায়াই যে ব্রহ্মের শক্তিস্বরূপিণী অক্ষয়রূপ, তা মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি প্রত্যক্ষভাবে জেনেছেন। তাই সেই ঋষিই যখন পরবর্তী শ্লোকগুলিতে বারেবারে মায়ের কাছে প্রার্থনা করছেন, "রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি", অর্থাৎ আমায় রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও আর আমার শত্রু নাশ করো, তখন তিনি স্বয়ং মোক্ষদায়িত্রীর কাছে সামান্য কোনো সাময়িক জাগতিক সুখ প্রার্থনা করে সময় নষ্ট করছেন, এমনটি কি কল্পনা করা সম্ভব?
মিশনে দুর্গাপূজার সময় ওই যে বিখ্যাত গানটি গাওয়া হয় না, "একবার বিরাজ গো মা হৃদি কমলাসনে। তোমার ভুবন-ভরা রূপটি একবার দেখে লই মা নয়নে।।" - যাঁরা শুনেছেন তাঁরা বুঝবেন এখানে যখন 'রূপং দেহি' বলা হচ্ছে তখন সেটা মোটেও 'আমায় রূপ দাও' হতে পারেনা; মা, তোমার ভুবন-ভরা রূপটি যেন সদা সর্বদা হৃদয়ে দেখতে পাই, জগন্মাতার কাছে সেই কৃপাই প্রার্থনা করা হচ্ছে। আমার শারীরিক রূপ নিয়ে কি হবে, ও তো অস্থায়ী। আজ লোকে আহা আহা করছে, কালের নিয়মেই একদিন চামড়া কুঁচকে যাবে, দাঁত পড়ে যাবে, চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে যাবে, শরীর নড়বড় করবে - ও ছাইপাঁশ চেয়ে লাভ কি? চাইতে হলে এমন জিনিস চাও যা জন্মজন্মান্তরেও ফুরাবে না, যা ধীরে ধীরে বাহ্যিক বাঁধন কেটে অভ্যন্তরীণ অনন্তের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এরপর বলছেন 'জয়ং দেহি' - জয় দাও। শত্রুতা মিত্রতা সবই তো সাময়িক, যতক্ষণ শরীর আছে ততক্ষণ জয়-পরাজয়, যেই শরীর গেল অমনি সব শেষ। জয় আর ভোগেচ্ছা তো একে অপরের পরিপূরক - ভোগও কেবলই জাগতিক। তাহলে কিসের ওপর জয় প্রার্থনা করছেন ঋষি? চোদ্দটি ইন্দ্রিয়ের ওপর জয়। এই যে আমাদের পাঁচটি অনিয়ন্ত্রিত কর্মেন্দ্রিয় : বাক্ পাণি পাদ পায়ু উপস্থ, পাঁচটি নিয়ন্ত্রণহীন জ্ঞানেন্দ্রিয় : চক্ষু কর্ণ নাসিকা জিহ্বা ত্বক, আর চারটি অন্তরিন্দ্রিয় : মন বুদ্ধি অহঙ্কার চিত্ত - এদের ওপর জয় চাই। যতক্ষণ এরা আমার বশে নেই, ততক্ষণ এরাই আমায় চালনা করবে আর বাসনায় বাসনায় জর্জরিত করে বারেবারে ভোগের চোরাবালিতে নিয়ে যাবে; আমার আর মনুষ্য জীবনের আসল উদ্দেশ্য সাধন করা সম্ভব হবে না। মা, তুমি কৃপা না করলে এই ভয়ঙ্কর চোদ্দ শত্রুর বিরুদ্ধে জয়যুক্ত হওয়া আমার পক্ষে সম্ভবই নয়, তুমিই আমায় এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় প্রদান করো মা।
কর্ণ-কুন্তী সংবাদের একেবারে শেষ পংক্তিটি মনে আছে? কর্ণ জানেন তাঁর মা আসলে তাঁর কাছে কি চাইতে এসেছেন, তাই মহাবীর তাঁর গর্ভধারিণীর কাছে কেবল এটুকুই প্রার্থনা করছেন যেন তিনি তাঁর যোদ্ধার ধর্ম পালন করতে করতেই মরতে পারেন, তিনি যেন কখনো স্বধৰ্মচ্যুত না হন। কর্ণ বলছেন,
"শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে
জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি,
বীরের সদ্গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।"
জয়, যশ আর রাজ্য - এই তিনটির লোভই তো কুন্তী দেখিয়েছিলেন কর্ণকে - তোমার পাঁচ ভাই তোমায় মাথায় করে রাখবে, তুমি সূতপুত্র নও, পাণ্ডবকূলশ্রেষ্ঠ বলে পরিচিত হবে, তুমি সসাগরা পৃথিবীর সম্রাট হবে, তোমার নাম যশ কীর্তি অমর হয়ে থাকবে পৃথিবীর বুকে - কর্ণ সে সব হেলায় ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন। আসল যশ হলো ঠিক ঠিক ধৰ্ম পালন করতে পারার যশ - আমি সমস্ত প্রলোভনকে জয় করে আমার রাজধর্ম, বন্ধুধর্ম, স্বধর্ম ইত্যাদি সব ধৰ্ম ঠিক ঠিক পালন করতে পেরেছি - তার যশ। তাই "যশো দেহি"।
শেষে ঋষি বলছেন, "দ্বিষো জহি" - শত্রু নাশ করো মা। আমাদের আসল শত্রু তো বাইরে নেই, সবই ভেতরে। ষড়রিপু অর্থাৎ কাম ক্রোধ লোভ মোহ অহংকার আর ঈর্ষা - এই হলো আমাদের প্রত্যেকের ছয়টি আসল শত্রু। আমাদের যা কিছু দুর্গতি, সব এই রিপুগুলোর জন্যই, এগুলোই আমাদের ক্রমাগত আঘাত করে করে এমন একটা অন্ধকূপে আটকে ফেলে যে আমরা আর আমাদের অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করতে পারিনা। আমরা ভুলে যাই যে আমরা potentially Divine, আমরা অমৃতের পুত্র, যাকে আমরা হিংসা করছি বা যার ওপর রাগ করছি সেও আমারই অংশ, আলাদা কেউ নয়। আমার যা কিছু কর্মফল, সব বাসনা থেকে উদ্ভূত আর তার পেছনে ক্রমাগত ইন্ধন যোগায় এই ষড়রিপু। মা আমার অন্তরের শত্রু নাশ করো, কৃপা করে আমায় নির্বাসনা দাও, আমি যেন এই জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি, তার উপায় করো মাগো।
No comments:
Post a Comment