Tuesday, October 17, 2023

নবরাত্রি

সারা বছরের মধ্যে শুভতমকাল নবরাত্রির আজ তৃতীয় দিন - তৃতীয়া। বিজয়া দশমী অবধি দেবীপক্ষের এই অতি পূণ্য দিনগুলিতে এক একদিন মহাশক্তির এক একটি রূপ ধারণ করে মা দৈহিকভাবে ধরায় উপস্থিত হন, ফলে ধরাতলে এমন এক দিব্য আধ্যাত্মিক আভামন্ডল তৈরি হয়, যা বছরের অন্য কোনো সময় আর হয়না।

এই দৈবীবলয় অনুভব করতে হলে কিছু সংযম, কিছু নিয়ম পালন আর যথাসম্ভব বেশি জপ তপ সাধন ভজন করতে হয়, যাতে শরীর মন সবসময় একেবারে শুচিশুদ্ধ থাকে, মাতৃআরাধনায় লীন থাকে। আমরা অনেকেই হয়তো উত্তর ও পশ্চিম ভারতে ভক্তদের সারা রাত জেগে কীর্তন ইত্যাদি সহযোগে 'জাগরণ' করতে দেখেছি, রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুরী-হালুয়া প্রসাদ বিতরণ হতে দেখেছি, এই দশ দিন ওখানে আমিষ খাদ্য প্রায় পাওয়াই যায়না - খাদ্যাভ্যাসের বিতর্কে না ঢুকেও বলা চলে যে ওসব অঞ্চলে এই শুভকালের প্রস্তুতির একটা বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা আছে। 

আমরা হয়তো ৭৩ বর্ষীয় অতিব্যস্ত এবং অতিজনপ্রিয় এক শিবভক্তের কথা জানি যিনি গত ৪০ বছর ধরে প্রত্যেক নবরাত্রিতে দিনে কেবল একবার একটি ফল আর বাকি সময়ে কয়েক গেলাস নিম্বুপানি খেয়ে নিজেকে সার্বজনীন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন ও একান্তিক আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য প্রস্তুত রাখেন। এই যে নিজেকে মায়ের অমৃতস্পর্শের জন্য প্রস্তুত রাখা এবং বছরের পর বছর ধরে প্রস্তুত রাখা - কৃপাময়ী যদি কৃপা করে একবার অন্তর্দৃষ্টি দেন আমরা যেন তা অনুভব ও গ্রহণ করার মতন আধাররূপে তৈরি থাকতে পারি - এই প্রক্রিয়াটিও সাধনার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 

আমাদের বাঙালিদের মধ্যে হুল্লোড় বেশি, গভীরতা কম। আমাদের কাছে পুজোর প্রস্তুতি মানে নতুন কাপড় জামা কেনা, আড্ডা মারা, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠেলাঠেলি করে ঠাকুর দেখা, খাওয়া দাওয়া, মোটের ওপর মোচ্ছব করা আর নিয়ম করে অষ্টমীর অঞ্জলিটি দিয়ে কোনোমতে পুজোর ব্যাপারটা থেকে রেহাই পাওয়া। পুজো কিন্তু আসলে এর কোনোটাই নয়। কাকে পুজো করা হচ্ছে, কেন হচ্ছে আর এই পুজোর ফলে জীবনের ওপর কি প্রভাব পড়ে, এগুলো নিয়ে একটু ভাবা দরকার বৈকি। 

যেদিন আমরা বাহ্যিক পরিমণ্ডল থেকে একটু গুটিয়ে নিয়ে নিজেদের উৎপত্তি ও সদগতি নিয়ে ভাববো, সেদিন হয়তো আমরা থমকে দাঁড়াবো। সেদিন প্যান্ডেলের মাইকে চন্ডীপাঠে 'ইয়া দেবী সর্বভূতেষু' শুনলে আমাদের হয়তো মনে হবে সর্বভূতে কে থাকতে পারেন? যখন শুনবো তিনি ক্ষান্তিরূপেণ সংস্থিতা, জাতিরূপেণ সংস্থিতা, শান্তিরূপেণ সংস্থিতা, শ্রদ্ধারূপেণ সংস্থিতা, কান্তিরূপেণ সংস্থিতা, লক্ষ্মীরূপেণ সংস্থিতা, বৃত্তিরূপেণ সংস্থিতা, স্মৃতিরূপেণ সংস্থিতা, দয়ারূপেণ সংস্থিতা, তুষ্টিরূপেণ সংস্থিতা, মাতৃরূপেণ সংস্থিতা, আবার ভ্রান্তিরূপেণ সংস্থিতাও, তখন হয়তো বুঝবো যে দুর্গাপুজো নিয়ে আমাদের বাঙালিদের মনে যে ভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, সেটা আমাদের কর্মফলেরই কারণে, এটাই আমাদের প্রারব্ধ। 

দিনকে দিন জাতি হিসেবে আমরা যে পিছিয়ে যাচ্ছি - কটুভাষী, ঈর্ষাকাতর, অর্বাচীন, নিম্নমেধার উপাসক - এক পশ্চাদমুখী ধারা বইছে খোদ মাতৃসাধনার পীঠস্থানে - এর শেষ মায়ের কৃপাতেই হবে, আর তার জন্যই আমাদের নিজেদের তৈরি করতে হবে। নবরাত্রি হলো সেই শুভকাল, যখন মা স্বয়ং সশরীরে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হন। আসুন না, আমরা নিজেদের তাঁর পাদপদ্মে সমর্পণ করে শুদ্ধ হই। 

"ইন্দ্রিয়ানামধিষ্ঠাত্রী ভূতানাং চাখিলেষু ইয়া।
ভূতেষু সততং তসৈ ব্যাপ্তৈ দেব্যৈ নমো নমঃ।।
চিতিরূপেণ ইয়া কৃৎস্নমেতদ্‌ ব্যাপ্য স্থিতা জগত।
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।"

No comments:

Post a Comment