বোধ আর বুদ্ধি এক নয়। বোধ বললেই আমার জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইনদুটি মনে পড়ে - ' স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়- ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!' বোধ মানে চেতনা, অন্যভাবে দেখলে উপলব্ধি। বুদ্ধি কম বেশি সমস্ত প্রাণীকুলেরই আছে কিন্তু বোধকে আত্মবোধে উন্নীত করার ক্ষমতা একমাত্র মানুষের আছে বলেই জানি, হয়তো ভবিষ্যতে গবেষকরা অন্য খোঁজও করতে পারেন।
গাছের স্নায়ুতন্ত্র নেই, অথচ বেদনাবোধ আছে, এমনটা জগদীশচন্দ্র হাতে কলমে প্রমান করে দেখিয়েছিলেন। স্নায়ুতন্ত্র নেই মানে বুদ্ধি নেই অথচ বোধ আছে। মস্তিষ্ক না থাকলে অনুভূতি আসে কিভাবে এই মুহূর্তে সেই প্রসঙ্গে না ঢুকেও, এক্ষেত্রে বোধ আর দুঃখ বা সুখের অনুভূতি সমার্থক, সব ক্ষেত্রে যদিও নয়। কেবল মানুষই একমাত্র অদ্ভুত জীব যার গঠনতন্ত্রে সমস্ত রকমের সিস্টেম inbuilt থাকা স্বত্তেও, বাস্তবে দেখা যায় অনেকের মধ্যেই বুদ্ধি আছে কিন্তু বোধের উন্মেষ নেই।
এ কিন্তু এক মারাত্মক বস্তু - মানুষকে অসম্পূর্ণ মানুষ করে তোলে। বুদ্ধি একটি বৃত্তি, যা rationally চিন্তা করে কোনো নির্ণয়ে পৌঁছতে সাহায্য করে। বুদ্ধির দুটি দিক আছে : ১. আমানতি, অর্থাৎ অতীতের অভিজ্ঞতা বা অর্জিত জ্ঞান থেকে নিষ্কর্ষ টেনে আনার ক্ষমতা আর ২. বিশ্লেষাত্মক, অর্থাৎ বর্তমান পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করে অতীতের অভিজ্ঞতা বা অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে এখন কি করণীয়, সেই নির্ণয়ে সহায়ক হওয়া। বুদ্ধি knowledge ভিত্তিক আর বোধ super knowledge বা conciousness ভিত্তিক - দুটো সম্পুর্ন পৃথক বস্তু। বুদ্ধি সমকালীন আর বোধ চিরকালীন।
গাছ বন্ধুদের থেকে আলাদা হয়ে গেলে দুঃখ পায়, নির্জীব হয়ে যায়, আবার অনেকগুলো বন্ধু গাছের সান্নিধ্য পেলে আনন্দে চাঙ্গা হয়ে ওঠে, সেটা যাঁরা বাগান করেন তাঁরা রোজই উপলব্ধি করেন। কেন হয়? মস্তিষ্ক নেই, স্নায়ুতন্ত্র নেই, বুদ্ধি নেই কিন্তু চেতনা আছে - সে চেতন স্বত্তা, ফলে তার মধ্যে বোধ কাজ করে। সেই বোধ বা conciousness এর স্তর কি এমন যে তা তার আত্মবোধ জাগাতে সক্ষম? না। ওটা গোটা চেতন জগতে একমাত্র মানুষের জন্যেই তুলে রাখা আছে।
কিন্তু মানুষ কি তার সদ্ব্যবহার করে? অধিকাংশই করে না। কারণ? সে সেই বর্তমানে বাঁচতে চায় যার কোনো অস্তিত্ব নেই। ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বর্তমান যে ক্রমাগত অতীত হয়ে যাচ্ছে, সেই বোধ তার প্রবৃত্তির নিচে চাপা পড়ে থাকে, ফলে সে এমন এক অনিত্যকে ধরে বাঁচতে চায়, বোধের জগতে যার কোনো relevence নেই। রামপ্রসাদ বলছেন, 'প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জায়া, তার নিবৃত্তিরে সঙ্গে লবি', কিন্তু কে আর নিবৃত্তি চায়? আজকাল তো অনেক সাধু সন্ন্যাসীরা তীব্র বৈরাগ্যের তাড়নায় গৃহত্যাগ করেও পরবর্তীকালে আনুষ্ঠানিক দায়িত্বপালন করতে গিয়ে জাগতিক প্রবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ছেন দেখছি।
অলীক সুখের খোঁজে আমাদের বুদ্ধি আমাদের দিয়ে এমন খাটান খাটিয়ে নেয়, যে যখন বেলাশেষে আমরা realise করি 'এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়', তখন আর নতুন করে বোধের রাস্তায় হাঁটার মতন শারীরিক বা মানসিক রেস্ত অবশিষ্টই থাকে না। বস্তুতঃ, কেবল বুদ্ধির কথা শুনে চললে বেদনা ছাড়া আর কিছু জোটে না - সে বেদনা নিজেরও হতে পারে আবার অপরের ওপর চাপিয়েও দেওয়া যেতে পারে। অবশ্য ঈশ্বরের কৃপা হলে 'আমি জীবনের উদ্দেশ্যকে বুঝতে না পেরে বৃথা সময় নষ্ট করছি' এই বেদনাও বুদ্ধির মাধ্যমেই মনকে পীড়া দেয়।
মজার ব্যাপার হলো এইরকমই কোনো এক বেদনা থেকে বোধের উদয় হয় - জীবনে যত বেশি বেদনা তত বেশি উপলব্ধি, যত বেশি উপলব্ধি তত বেশি নিবৃত্তি, যত বেশি নিবৃত্তি তত বেশি অহঙ্কারের ক্ষরণ আর আর তত বেশি ইন্দ্রিয়ের বাঁধা ভেঙে চেতনার উদয় - যে চেতনা চিরকালীন প্রেম আর চিরকালীন আনন্দ, অর্থাৎ সত্যের দিকে নিয়ে যায়। তাই রবীন্দ্রনাথ সৎ-চিৎ-আনন্দস্বরূপের কাছে এই বৌদ্ধিক প্রার্থনা করছেন,
আরো বেদনা আরো বেদনা,
প্রভু, দাও মোরে আরো চেতনা।
দ্বার ছুটায়ে বাধা টুটায়ে
মোরে করো ত্রাণ মোরে করো ত্রাণ।
আরো প্রেমে আরো প্রেমে
মোর আমি ডুবে যাক নেমে।
সুধাধারে আপনারে
তুমি আরো আরো আরো করো দান ॥
No comments:
Post a Comment