সংসদীয় গণতন্ত্রের নিজস্ব একটা মর্য্যাদা আছে কারণ সংসদে সরকারপক্ষ এবং বিরোধীপক্ষ উভয়ই কিন্তু জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি - জনপ্রতিনিধি হিসেবে ধারে ভারে কেউ কারো থেকে কম বা বেশি ক্ষমতাবান নন। দুপক্ষের সাংসদরাই একই শপথবাক্য পাঠ করেন, দুপক্ষই সংবিধানের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা রাখার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ, সেখানেও দুপক্ষের ভূমিকার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বাকি, সরকারপক্ষের কাজ শাসন করা আর বিরোধীপক্ষের কাজ ভুল ধরিয়ে দেওয়া - মিটে গেল। তাহলে একপক্ষের এত হীনমন্যতা কিসের?
খুবই খারাপ লাগে যখন দেখি নেহাত বিরোধিতার জন্য বিরোধীপক্ষের কেউ কেউ বিধিবদ্ধ দায়িত্ব পালনের মধ্যেও ক্ষুদ্র দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থকে টেনে এনে গণতান্ত্রিক পরম্পরাকে হেয় করছেন। এঁদের কখনো দেখি নতুন সংসদভবনের নির্মাণ আটকানোর জন্য বারেবারে আদালতে ছুটে যাচ্ছেন, তাতে জাতীয় প্রতীক প্রতিষ্ঠা করার সঙ্গে সঙ্গে সিংহের হিংস্রতা নিয়ে অকারণে বিতর্ক সৃষ্টি করে সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন, ভবন উদ্ঘাটনের দিন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান বয়কট করছেন, আর আজ যখন প্রথমবার নতুন সংসদে রাষ্ট্রীয় ধ্বজারোহন হলো, তখন রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা চিঠি লিখে জানিয়ে দিলেন তিনি আসতে পারবেন না, অন্যত্র দলীয় কার্য্যক্রমে ব্যস্ত।
এটা যদি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতো, খুশি হতাম কিন্তু বাস্তবিক তা নয়। এর আগেও স্বাধীনতা দিবসে এই একই ভদ্রলোক লালকেল্লার জাতীয় অনুষ্ঠানকে এড়িয়ে দলীয় অনুষ্ঠানে চলে গিয়েছিলেন। আমার মনে হয় প্রতিষ্ঠান ও পরম্পরার ওপর বারবার এই আঘাত আসলে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপরেই আঘাত। রাজনীতিকে যদি এত নিচু স্তরে নামিয়ে আনা হয় যেখানে সরকারি অনুষ্ঠানকে অন্য পক্ষের দলীয় অনুষ্ঠানের মতন তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা উপহাস বা অবজ্ঞা করা যেতে পারে, তাতে সংবিধানকে কতদূর শ্রদ্ধা বা তার প্রতি কতটা নিষ্ঠা প্রদর্শিত হয়, আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
আমি জানি না যে দলটি ৬০ বছর দেশের শাসনভার সামলেছেন, তাঁরা আজ এত বেসামাল কেন। এমনটা তো আগে ছিল না - তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরসিংহ রাও ভারতের পক্ষ রাখতে তৎকালীন বিরোধী নেতা শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীকে জাতিসংঘের জেনারেল এসেম্বলিতে পাঠিয়েছিলেন। সংবিধান প্রধান বিরোধীপক্ষকে যে ভূমিকা দিয়েছে তাঁরা যদি তা ঠিকমত পালন না করেন তাহলে সেই ভূমিকা যে তাঁরা অচিরেই হারিয়ে বসবেন, সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই কারণ গণতন্ত্রের ওই স্তরে শূন্যস্থান পূরণ হতে বেশিক্ষন সময় লাগে না।
বিরোধীপক্ষ হয়তো এই ভেবে খুশি হচ্ছেন যে সরকার অপদস্থ হচ্ছেন আর সরকারপক্ষ হয়তো এই ভেবে আনন্দিত যে দেশের সামনে বিরোধীদের নেতিবাচক ভূমিকা প্রকাশিত হচ্ছে কিন্তু আখেরে এতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে, সংসদ নামক মহান প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতি হচ্ছে, জনপ্রতিনিধিত্ব সম্পর্কেই প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিচ্ছে আর গণতান্ত্রিক পরম্পরার প্রতি সম্মান ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে এঁরা অনেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পর্ককেও একইভাবে তলানিতে এনে ফেলেছেন - এতটাই যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ৭৩তম জন্মদিনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতেও অনেকে অক্ষম। 'দোল দোল দুলুনি রাঙা মাথায় চিরুনি' করতে করতে কখন যে ক্ষতিটা মাত্রাছাড়া হয়ে যাবে, নিজেদের ক্ষুদ্র রাজনীতি নিয়ে মশগুল এই মানুষগুলো হয়তো আজ বুঝতেও পারছেন না।
No comments:
Post a Comment