Blog Archive

Thursday, May 5, 2022

কর্মফল

তিনি নিজের ইচ্ছাতেই নির্গুণ থেকে সগুণ হন, তাঁর ইচ্ছাতেই জগৎ সৃষ্টি হয়, তাঁর ইচ্ছাতেই জীবের জন্ম এবং মৃত্যুর কালচক্র চলতে থাকে এবং তাঁর ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটি পাতারও নড়বার যো নেই, এমনটাই তো বিভিন্ন শাস্ত্রে শোনা যায়। তাহলে আমাদের পাপ এবং পুণ্যের জিম্মেদারও নিশ্চয় তিনি। খামোখা আমরা কর্মফল ভোগ করি কোন দুঃখে! অন্ততঃ যুক্তির দিক দিয়ে তাই তো হওয়া উচিৎ। ইচ্ছাধারীর ইচ্ছামাত্র যখন জীব সৃষ্টি হচ্ছে, তখন ইচ্ছাপ্রসূতদের কর্মকাণ্ডের দায় তো তাঁরই ওপর বর্তায়, এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?

দুটি মানব মানবী পরস্পর পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলেন, তাঁদের প্রেম গভীর হলো, তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন, তাঁদের প্রেম সর্বাত্মক হওয়ার কারণে পরস্পরের মন এবং দেহ দুটিই সংযুক্ত হলো এবং ফলত জৈবিক কারণেই একদিন সন্তান উৎপন্ন হলো। সেই সন্তান এই দম্পতির প্রেমের মূর্ত প্রকাশ হলেও পক্ষান্তরে তাঁদের ইচ্ছার ফসলও তো বটে। এইবার সেই সন্তানকে তাঁরা সযত্নে লালন পালন করলেন, নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিলেন, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিলেন, ভালো মানুষ হতে শেখালেন। ক্রমে সন্তান বড় হলেন, কর্মক্ষম হলেন, তাঁর নিজস্ব পরিবার গড়ে উঠলো, পিতা-মাতা বৃদ্ধ হলেন, অশক্ত হলেন, সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হলেন। এইবার সন্তান কর্মক্ষেত্রে এমন একটি পরিস্থিতির শিকার হলেন যেখানে তাঁকে বেশ কিছু অধস্তন কর্মচারীকে বিনা দোষে ছাঁটাই করতে হলো। তিনি জানেন যে তাঁর নির্ণয়ের কারণে এতগুলো পরিবার পথে বসবে, সেই পরিবারগুলির নিষ্পাপ শিশুদের দুর্দশা হবে। কিন্তু তাও তিনি নিরুপায় কারণ নিজের পরিবারের আর্থিক সুরক্ষার জন্য নিজের চাকরিটি বাঁচানো তাঁর কাছে ভীষণ জরুরি এবং সেই কারণেই তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অবাধ্য হতে পারলেন না। তিনি এও জানেন যে তিনি যদি বেঁকে বসেন তাতেও আখেরে কারো লাভ হবে না - তাঁর জায়গায় অন্য কাউকে দিয়ে কর্তৃপক্ষ ছাঁটাই ঠিকই করিয়ে নেবেন। এখন প্রথম প্রশ্ন হলো, সন্তান যেহেতু পিতা-মাতার ইচ্ছার ফসল, তাহলে সন্তানের কর্মফলের দায় তাঁদের নেওয়া উচিত - কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা কি যুক্তিযুক্ত? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, সন্তান যা করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন, তার কারণ তাঁর বৃদ্ধ, অশক্ত পিতা-মাতাকে এবং পরিবারকে সুখে স্বস্তিতে রাখা ধর্মত তাঁর দায়িত্ব এবং তিনি চাইলেই হুট করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেই দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেন না - সেক্ষেত্রে কর্মফল কার? আর তৃতীয় প্রশ্ন হলো, যাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে, তাঁদের দুর্ভোগ কি ঈশ্বরের ইচ্ছায় হচ্ছে নাকি তাঁদের নিজেদের প্রারব্ধের ফলে?

যুবাবস্থায় শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দজীর অন্যতম প্রিয় জার্মান দার্শনিক ইমেন্যুয়েল কান্ট তাঁর বিখ্যাত Groundwork of the Metaphysic of Morals বইতে categorical imperative থিওরি অনুযায়ী কর্মকে চারটি মুখ্য পর্য্যায় ভাগ করেছেন:
১. Act as if the maxims of your action were to become through your will a universal law of nature.
২. Act in such a way that you treat humanity, whether in your own person or in the person of any other, never merely as a means to an end, but always at the same time as an end.
৩. Thus the third practical principle follows [from the first two] as the ultimate condition of their harmony with practical reason: the idea of the will of every rational being as a universally legislating will.
৪. Act according to maxims of a universally legislating member of a merely possible Kingdom of Ends.
এই সূত্র ধরেই উনি perfect duty আর imperfect duty তত্বের অবতারণা করেছিলেন, যেখানে যে কোনো কৃতকর্মের বিশ্বজনীন মান্যতা পেতে গেলে তার ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে একটা সার্বজনীন প্রয়োগযোগ্যতা থাকতে হবে। সম্ভবত ওনার এই hypothetical Kingdom of Ends হলো সেই মানসিক স্থিতি যেখান 'all people should consider themselves never solely as means but always as ends.' কান্টসাহেবের থিওরির স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে  নানান মত থাকতে পারে এবং আছেও, কিন্তু তাঁর duty for duty's sake বক্তব্য যে পাশ্চাত্যকে এককালে কর্তব্যের দিশা দেখিয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের সংস্কৃতিতে কিন্তু কর্ম সম্পর্কে কোনো অস্পষ্টতা কোনোকালেই ছিল না, তা সে ঈশ্বরবিশ্বাসী মতবাদসমূহেই হোক বা মীমাংসাসূত্রধারী নিরীস্বরবাদীদেরই হোক।

তুমি যদি ব্যক্তিগত ফললাভের আশায় কোনো কাজ করো, অর্থাৎ যা করছো তার পেছনে যদি তোমার ব্যক্তিগত কোনো ভোগেচ্ছা কাজ করে, তাহলে বাপু তার কর্মফলও সব তোমার, অতএব জন্মজন্মান্তর ধরে সব ভোগান্তিও তোমার। অর্থাৎ বাসনা থাকলেই জন্মান্তর থাকবে। আর যদি নিষ্কাম হয়ে কোনো কাজ করো, অর্থাৎ অনাসক্ত হয়ে, ফলাকাঙ্খাহীন হয়ে, কেবল কর্তব্যবোধের খাতিরে কিছু করো, তাহলে তার দায় বাপু তোমার নয়। এই হলো সাধারণ নিয়ম। আর জ্ঞান-বিজ্ঞানপথে সকাম কর্মের উদ্দেশ্য হলো সাময়িক জাগতিক শারীরিক ও মানসিক সুখ আর নিষ্কাম কর্মের উদ্দেশ্য হলো সরাসরি ঈশ্বরের সাথে যোগস্থাপন কারণ মানুষ তখন নিজেকে সৃষ্টজীব হিসেবে বুঝতে পেরে এটাও বোঝে যে তার সব কর্ম ঈশ্বরের দ্বারাই পরিচালিত, সে নিমিত্তমাত্র, অর্থাৎ যন্ত্রীর হাতের যন্ত্র। একেই যজ্ঞার্থ কর্ম বলে অর্থাৎ যে কাজ ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যজ্ঞরূপে কার্য্যকারী করা হয়। আর নিঃস্পৃহতারূপ অগ্নিতে কর্মফলরূপ হবি অর্পণ করে নিজে দায়মুক্ত হয়ে ঈশ্বরের সাথে সংযুক্ত হয়ে যাওয়ার নামই মুক্তি।

'অনিত্যাশুচিদুঃখানাত্মসু নিত্যশুচিসুখাত্মখ্যাতিরবিদ্যা।' 
(যোগসূত্র : ২/৫) ।।
বিবেকখ্যাতিরবিপ্লবা হানোপায়ঃ। 
(যোগসূত্র ২/২৬) ।।
‘ইত্যেষ মোক্ষস্য মার্গো হানস্যোপায় ইত্যি’। (যোগভাষ্য ২/২৬)।।
অর্থাৎ :
অনিত্যকে নিত্য, অশুচিকে শুচি, দুঃখকে সুখ এবং অনাত্মাকে আত্মাবোধ করা বা খ্যাতিই হলো অবিদ্যা (যোগসূত্র ২/৫)।।  
সত্যজ্ঞান প্রদায়িনী বিবেকপ্রসূত প্রজ্ঞাই অবিদ্যা ত্যাগের প্রধান উপায়। (যোগসূত্র ২/২৬)।।  
এই অবিদ্যা থেকে পরিত্রাণই মোক্ষ বা মুক্তির উপায়। (যোগভাষ্য ২/২৬)।।

মহাভারতে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন,
'বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে।
তস্মাদ্ যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্।।'  
(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ২/৫০)
বলছেন যে নিষ্কাম কর্মযোগী ঐহিক জীবনেই পাপ ও পুণ্য উভয় হতে মুক্ত হন। সুতরাং তুমি নিষ্কাম কর্মযোগের অনুষ্ঠান করো। কর্মফল নিজের নয় বলে আবার হেলাফেলা করে কাজ করো না যেন। সমস্ত কাজ ভীষণ নিপুনতার সাথে করবে কারণ যে কোনো কাজে নৈপুণ্য অর্জনের নামই হলো যোগ। 
যোগসূত্রকার মহর্ষি পতঞ্জলি আবার যোগের লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছেন- 'যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ'
অর্থাৎ : চিত্তবৃত্তির নিরোধই যোগ। সেইজন্যই চিত্তশুদ্ধি, সংযম ও ধ্যানের আলোচনা ওনার শাস্ত্রে এত গুরুত্ব পেয়েছে। এসব নাহলেই যারপরনাই ক্লেশ উৎপন্ন হয়।
অবিদ্যাস্মিতারাগদ্বেষাভিনিবেশাঃক্লেশাঃ।’ 
(যোগসূত্র ২/৩)
অর্থাৎ : অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ এবং অভিনিবেশই পঞ্চপ্রকার ক্লেশের পঞ্চনাম।

যোগশাস্ত্র চারটি অঙ্গবিশিষ্ট - হেয়, হেয়হেতু, হান ও হানোপায়। হেয় হলো সংসার, হেয়হেতু হলো সংসার হেতু। এখানে হেতু বলতে প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ বোঝায়। হান হলো মোক্ষ বা কৈবল্য এবং হানোপায় হলো মোক্ষের বা কৈবল্যের উপায়। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
১. ‘হেয়ং দুঃখমনাগতম্’- (যোগসূত্র ২/১৬)
অর্থাৎ : সংসার দুঃখময় বলে তা পরিত্যাজ্য।
২. ‘দ্রষ্টদৃশ্যয়োঃ সংযোগো হেয়হেতুঃ’- (যোগসূত্র ২/১৭)
অর্থাৎ : পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ হলো হেয়-হেতু বা দুঃখের কারণ।
৩. ‘তদভাবাৎ সংযোগাভাবো হানং তদ্দৃশেঃ কৈবল্যম্’- (যোগসূত্র ২/২৫)
অর্থাৎ : পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগাভাব হলো হান বা কৈবল্য।
৪. ‘বিবেকখ্যাতিরবিপ্লবা হানোপায়ঃ’- (যোগসূত্র ২/২৬)
অর্থাৎ : সত্যজ্ঞান প্রদায়িনী বিবেকপ্রসূত প্রজ্ঞাই কৈবল্য লাভের প্রধান উপায়, যার কথা আগেই বলা হয়েছে।

এই কথাগুলিই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কত সহজভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন,
১৪। জলে নৌকা থাকে ক্ষতি নেই, কিন্তু নৌকার ভেতর যেন জল না ঢোকে, তা হলে ডুবে যাবে। সাধক সংসারে থাকুক ক্ষতি নেই কিন্তু সাধকের মনের ভেতর যেন সংসারভাব না থাকে।
১৫। সংসার কেমন? যেমন আমড়া - শাঁসের সঙ্গে খোঁজ নেই, কেবল আঁটি আর চামড়া; খেলে হয় অম্লশূল।
১৬। যেমন কাঁঠাল ভাঙতে গেলে লোকে আগে বেশ ক'রে হাতে তেল মেখে নেয় তা হলে আর হাতে কাঁঠালের আঠা লাগে না; তেমনি এই সংসাররূপ কাঁঠালকে যদি জ্ঞানরূপ তেল হাতে মেখে সম্ভোগ করা যায়, তা হলে কামিনীকাঞ্চনরূপ আঠার দাগ আর মনে লাগতে পারবে না।
১৭। সাপকে ধরতে গেলে তখনই তাকে দংশন ক'রে দেবে, কিন্তু যে ব্যক্তি ধুলোপড়া জানে, সে সাতটা সাপকে ধরে গলায় জড়িয়ে বেশ খেলা দেখাতে পারে; তেমনি বিবেকবৈরাগ্যরূপ ধুলোপড়া শিখে কেউ যদি সংসার করে, তাকে আর সাংসারিক মায়া-মমতায় আবদ্ধ করতে পারে না।
২। গুটিপোকা যেমন আপনারই নালে ঘর ক'রে আপনি বদ্ধ হয়, তেমনি সংসারী জীব আপনার কর্মে আপনি বদ্ধ হয়। যখন প্রজাপতি হয়, তখন কিন্তু ঘর কেটে বেরোয়, তেমনি বিবেক-বৈরাগ্য হলে বদ্ধজীব মুক্ত হয়ে যায়।
(শ্রীমৎ স্বামী ব্রহ্মানন্দজী সঙ্কলিত "শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপদেশ" - প্রথম চারটি উপদেশ 'সংসার ও সাধন' এবং শেষেরটি 'কর্মফল' অধ্যায় থেকে উদ্ধৃত)

No comments:

Post a Comment