পূজনীয় স্বামী সর্বপ্রিয়নন্দজী মহারাজের একটি বক্তৃতার একটি ছোট অংশ শুনলাম যেখানে হার্ভার্ডে পাঠরত কিছু ভারতীয় ছাত্রদের আচরণে ব্যথিত হয়ে উনি বলেছেন যে বিদেশে নিজের মাতৃভূমির বিরুদ্ধে অনভিপ্রেত বিক্ষোভ প্রদর্শন নিজেদের হীনমন্যতা থেকে আসে। সে তো বটেই। আমার মতে তার থেকেও বেশি আসে sense of entitlement অর্থাৎ প্রয়োজনাতিরিক্ত অধিকারবোধ থেকে। এটি মারাত্মক একটি মানসিক দুর্দশা, যা যে কোনো ব্যক্তি, পরিবার, ব্যবসা, জাতি, রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যকে একেবারে শেষ করে দিতে পারে। কবি দার্শনিক যুবরাজ দারা সিকোহ তৈরি থাকতেও ছোটভাই ঔরঙ্গজেব তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে সম্রাট হয়েছিল, আজ সাড়ে তিনশ বছর পরেও দেশসুদ্ধু লোক সেই খুনিকে ছিঃ ছিঃ করেন, তার নামাঙ্কিত রাস্তার নাম পাল্টে দেওয়া হয়। নেহেরুর পরিবার কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃত্বের জায়গাটিকে নিজেদের জন্মসিদ্ধ অধিকার বলে ধরে নিয়েছে, ফল কি হয়েছে তা লাগাতার নির্বাচনী বিপর্যয় এবং প্রতিদিন নেতা-কর্মীদের দল ছেড়ে চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে দেশ নতুন করে দেখছে। ছোটভাই অনিল আম্বানি বাবার তৈরি বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যকে ভুল অধিকারবোধের তাড়নায় অকারণে দুভাগ করেছিলেন, আজ প্রভাব প্রতিপত্তির নিরিখে বড়ভাই মুকেশ কোথায় আর তিনি কোথায়!
একই অবস্থা পাকিস্তানেরও। হিন্দু সভ্যতার চেয়ে বেশি উদার এবং সর্বব্যাপী ভাবধারা সারা বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই অথচ সেই সভ্যতার উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করে এই ভূমিরই কিছু কুসন্তান একটি অনধিকার অধিকারবোধের বশে মাতৃভূমি ভাগ করেছিলেন। তাদের সেই কৃত্তিম বিধ্বংসী sense of entitlement-এর জন্য কত লক্ষ মানুষের হত্যা হয়েছিল, কত লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়েছিলেন, কত শতসহস্র মা-বোনের সতীত্বনাশ করা হয়েছিল, কত অসহায় মানুষকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল ও কত নিরীহ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন, ইতিহাসের পাতায় তা রক্তাক্ষরে লেখা আছে। সারা বিশ্ব দেখছে আজ সেই পাকিস্তানের অস্তিত্ব কোন অন্ধগলিতে আটকে গেছে আর ভারত কত দ্রুত সারা পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম শক্তি এবং অগ্রগণ্য দেশ হয়ে উঠছে।
একই অবস্থা হবে দেশের ভেতরের সেই সব সমুদায়ের যাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ ও কর্তব্যবোধের বদলে মেকি অধিকারবোধের আধিক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদি দ্রুত বোধোদয় না ঘটে, আর কয়েকদশকের মধ্যে তাদের সমূহের অবস্থা সেটাই হবে, যা আজ পাকিস্তানের হয়েছে। প্রত্যেকের মনে রাখা উচিত যে শ্রীকৃষ্ণ কৌরবসভায় দৌত্য করতে গিয়ে পাণ্ডবদের জন্য শেষমেশ পাঁচটি মাত্র গ্রাম চেয়েছিলেন। দুর্যোধনের sense of entitlement ওটুকুও তাঁদের দিতে দেয়নি। শেষে কি হলো? পরিবার পরিজন বন্ধু মিত্র অমাত্য সব তো বধ হলোই, রাজ্যটিও খুইয়ে শেষে অপমানের চূড়ান্ত হয়ে নিজের প্রাণটিও তাঁকে খোয়াতে হয়েছিল।
এটাই ঈশ্বরের নিয়ম, যুগে যুগে এটাই হয়ে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও এটাই হবে। ভগবান বলছেন, ধর্মপথে থেকে জীবনধারণের জন্য যেটুকু তোমার প্রয়োজন, সেটুকুই তোমার প্রাপ্য। তারচেয়ে বেশি যদি কিছু পাও, তা কেবলমাত্র মানবকল্যাণে ব্যবহার করার জন্য। আর যা তোমার প্রাপ্য, তার চেয়ে বেশি কিছুর জন্য যদি লোভ করো বা অন্যায়ভাবে ভোগ করো, তাহলে সেটা অন্যের অধিকারহরণ। আমি সেটুকু তো কেড়ে নেবই, তোমার যা আসলে প্রাপ্য ছিল, শাস্তিস্বরূপ সেটাও কেড়ে নেব এবং অপরপক্ষকে দিয়ে দেবো।
The sun never sets on the British Empire! কি হলো তার শেষ পর্য্যন্ত? আমাদের চামড়া সাদা তাই আমরা কালোদের ওপর প্রভুত্ব করবো, আমরা তাদের হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা নিজস্ব শিক্ষা সংস্কৃতি ঐতিহ্য সব ভুলিয়ে দিয়ে আমাদের মতোই আধুনিক বস্তুবাদী করে তুলব, ইত্যাদি কত কিই না সেকালের সাহেবরা ভেবেছিলেন। আর্য অনার্যর মনগড়া কাহিনী আমদানি করে প্রায় ২০০ বছর ধরে ভারতীয়দের মধ্যে হীনমন্যতা গড়ে তোলার কত চেষ্টাই না তারা করেছিলেন। আজ বস্তুস্থিতি এই, ভাগ্যের ফেরে স্বাধীন ভারত এখন ইউনাইটেড কিংডমে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদেশি নিবেশক দেশ এবং সাহেবরা যদি ভারতীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোতে চাকরি না করেন, তাঁদের অনেকের বাড়িতেই হাঁড়ি চড়বে না।
আসলে চূড়ান্ত অধর্মের কিছু tell-tale signs আছে। ওই যে ভগবান বলেছেন না, "যখন যখন ধর্মের অধঃপতন আর অধর্মের উত্থান হয়, তখন তখন ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি প্রকট হৈ", ওটা দৈববচন, শুধুমাত্র কথার কথা নয়। যে প্রতীকের মধ্যে মহাদেবের দিব্যপ্রকাশকে মন্ত্রবলে আবাহন করে এনে শ্রদ্ধা-ভক্তির সাথে একজায়গায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, জোর করে তাঁর সেই মন্দির দখল করে, তাঁকে যখন হাত-পা ধোয়ার এবং কুলকুচি করার নোংরা জলের মধ্যে চুবিয়ে রাখা হয় এবং পরবর্তীকালে তিনি আবিষ্কৃত হওয়ার পরেও মেকি অধিকারবোধের বশবর্তী হয়ে একশ্রেণী জেদ ধরে বসে থাকে যে মহাদেবের ওই প্রাত্যহিক অবমাননা শ্রদ্ধালুদের সবাইকে মেনে নিতে হবে, তখন বুঝতে হবে যে জল মাথার ওপর উঠে গেছে। বাকি যা হবে সব ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হবে, যেমনটা দৈবইচ্ছায় এর আগেও অজস্রবার হয়েছে।
No comments:
Post a Comment