মহর্ষি পতঞ্জলি তাঁর যোগসূত্র বইটিতে চারটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন - সংস্কার, বৃত্তি, জ্ঞান ও স্মৃতি। উনি বলছেন, 'অনুভূত বিষয় অসম্প্রমোষঃ স্মৃতিঃ' অর্থাৎ কোনো বিষয় অনুভূত হলে যে সংস্কার উৎপন্ন হয়, সেই সংস্কার উদ্বুদ্ধ হলে যে জ্ঞান হয়, তাকে স্মৃতি বলে। যে অবস্থায় সমস্ত বৃত্তি নিরুদ্ধ হয়ে কেবলমাত্র সংস্কার অবশিষ্ট থাকে, তাকেই যোগসূত্রে নিরুদ্ধ অবস্থা বলা হয়েছে। নিরুদ্ধভূমিতে চিত্ত সম্পূর্ণরূপে শান্ত, স্থির ও বৃত্তিহীন থাকে। এই অবস্থাকেই অসম্পরাজ্ঞত যোগ বা অসম্পরাজ্ঞত সমাধি বলে, যখন জ্ঞাতৃ-জ্ঞেয় ভেদ বিলুপ্ত হয়ে যায়।
তাহলে জ্ঞানের পথে হাঁটার গোড়ার বিষয় হলো সংস্কার আর বৃত্তি। আমাদের মা ঠাকুমারা এতকিছু না পড়েই সহজাত হিন্দু জীবনবোধের উত্তরাধিকারের কারণে কত সহজেই না বলতেন, "অমুকের কত জন্মের সংস্কার কে জানে বাপু, অত সহজে কি যায়?" এর পেছনে যে গভীর দর্শন লুকিয়ে আছে, সেটা হয়তো তাঁরা জানতেন না কিন্তু সংস্কার যে একটা storehouse of memories from past lives, সেটা তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন।
আমরা এক্ষুনি যা ভাবছি সেটা আমাদের সংস্কার থেকে উঠে আসছে। এই ভাবনাটাকেই বলে বৃত্তি। আবার, বৃত্তিই ঘুরে সংস্কারে গিয়ে জমা হচ্ছে এবং এই cycle গোলগোল ঘুরেই চলেছে। সংস্কার যেহেতু sub-conscious বা অবচেতনে গচ্ছিত থাকে, ফলে আত্মা যখন দেহ থেকে দেহান্তরে ভ্রমণ করেন, তখন তাঁর সাথে সাথে সূক্ষ্মশরীররূপী মনও জন্ম মৃত্যুর সাথে সাথে এক দেহ থেকে অন্য দেহে ভ্রমণ করে। ফলে তার অঙ্গরূপে সংস্কারও একই কারণে নতুন দেহে গিয়েও পুরানো বৃত্তি উৎপন্ন করতে থাকে। এই সংস্কারের ওপর আমাদের কোনো হাত নেই, আবার আছেও। কিভাবে?
বৃত্তি জমে জমে সংস্কার তৈরি হয় ঠিকই কিন্ত আমরা কি ভাববো বা না ভাববো, কিভাবে ভাববো বা না ভাববো, সেটা সম্পূর্ণভাবে আমাদেরই হাতে থাকে। হয়তো কেউ কোনো কিছু করলেন যেটা আমার মনঃপুত নয়। আমি দুরকমভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারি। হয় উত্তেজিত হয়ে তাকে গর্ধব, বুদ্ধিহীন ইত্যাদি বলে গালাগাল দিতে পারি অথবা সে যেমন তাকে তেমনভাবেই গ্রহণ করে শান্ত এবং অবিচলিত থাকতে পারি। আমি নিজের মনকে যেভাবে গড়ে তুলবো, সংস্কারের storehouse থেকে আমার মনে ঠিক সেই গোত্রের ভাবনাই প্রতিগ্রহিত হবে, অনেকটা যেমন AI এর ক্ষেত্রে হয়। হয়তো গুগুলে একবার কোনো একটা বিশেষ ব্র্যান্ডের বিস্কুট সার্চ করলাম, তারপর নিজে থেকেই কিছুদিন ধরে নানারকমের বিস্কুট search engine নিজেই throw up করতে থাকবে। আমাদের বৃত্তি যদি সদর্থক থাকে তাহলে সংস্কারের মধ্যে থেকে সদর্থক দিকটিই ওপরে উঠে আসতে থাকবে এবং নেতিবাচক দিকটি অব্যবহৃত থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে একেবারে মুছে যাবে।
অন্তর্মুখী হতে গেলে মনকে শান্ত করা অত্যন্ত জরুরি। মন যদি বিক্ষিপ্ত থাকে তাহলে নানা বিষয়ের পেছনে ছুটে ছুটে সে এমন রজঃ ও তমগুনের আধিক্য সৃষ্টি করে যে ইন্দ্রিয়াশক্তি বেড়ে গিয়ে অসংখ্য কামনা বাসনা তৈরি হয়। আর তার থেকেই না পাওয়ার যন্ত্রণা, অন্যের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ, জীবনের প্রতি তিক্ততা আর সবার শেষে সামগ্রিকভাবে একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়। এমনটা হলে অতীন্দ্রিয় বিষয়ের ব্যাপারে চিন্তা করার মতো ইচ্ছা বা ধৈর্য্য কোনোটাই আর থাকে না। যেখানে ভোগ সেখানে যোগ নেই। মন বুদ্ধি এবং অহঙ্কার - এই তিনটি অন্তঃকরণকেই যোগদর্শনে চিত্ত বলা হয়েছে। অচেতন প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত বলে চিত্তও অচেতন। চৈতন্য প্রতিবিম্বিত হওয়ায় চিত্ত চেতন বলে প্রতিভাত হয়।
পতঞ্জলি বলছেন 'যোগঃ চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ' অর্থাৎ চিত্তবৃত্তি নিরোধই যোগ। কেউ বলতেই পারেন যে যেহেতু যুজ্ ধাতু যোগ শব্দ নিষ্পন্ন, ফলে যোগ হলো সংযোগ, নিরোধ নয়। এখন, যুজ্ ধাতুর প্রয়োগ কেবল সংযোগ অর্থেই হয় না, সমাধি অর্থেও হয়। মহাত্মা পাণিনি বলেছেন, 'যুজ্ সমাধৌ', আচার্য ব্যাসদেবও বলেছেন, 'যোগঃ সমাধিরিতি'। সবসময় যে সবকিছুর ব্যুৎপত্তিগত অর্থই ধরতে হবে, এমন কোনো কথা নেই যেমন গো বলতে আমরা যেকোনো গমনশীল বস্তু না বুঝে কেবল গরুই তো বুঝি। এতগুলো কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হলো চিত্ত বৃত্তি নিরোধ, সমাধি তার by product মাত্র। ফলে আমরা বৃত্তিকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করি তার ওপরেই নির্ভর করে আমাদের সংস্কার আর সেখান থেকেই জ্ঞানের সূত্রপাত। ভগবান বলছেন 'জ্ঞানী ত্বাত্মৈব মে মতম্' (গীতা ৭/১৮), জ্ঞানী আমার আত্মস্বরূপ।
মনের মধ্যে একটা একাগ্রভূমি আছে যেখানে সত্ত্বগুণের প্রাধান্য থাকে এবং সেখানে ধ্যেয় বিষয়ক বৃত্তি ছাড়া অন্য সব বৃত্তি নিরুদ্ধ হয়। মনকে শান্ত করতে গেলে ধ্যেয়রূপী একটা শুদ্ধ অবলম্বন চাই। সেটি কিভাবে পাবো? না, সদগুরু দেবেন। আমাদের সনাতন সংস্কৃতিতে যুগে যুগে তাই হয়ে এসেছে, এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। পঞ্চদশীতে বিদ্যারণ্য স্বামী এর একটি সুন্দর চিত্রকল্প তৈরি করেছেন,
কুর্বতে কর্ম ভোগায়, কর্ম কর্ত্তুঞ্চভুঞ্জতে
নদ্যাং কীটা ইব, অবর্তাৎ আবর্তান্তরম্ আশু তে
ব্রজন্তো জন্মনো জন্ম, লভন্তে নৈব নির্বৃতিম্।
সৎকর্ম-পরিপাকাৎ তে, করুণানিধিনোদ্ধৃতাঃ।
প্রাপ্য তীর-তরুচ্ছায়াং, বিশ্রাম্যন্তি যথাসুখম্।।
অর্থাৎ, নদীর স্রোতের মধ্যে আপতিত অসহায় এক ক্ষুদ্র কীট যতবার স্বচেষ্টায় স্রোতের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে, ততই কোনও না কোনও ঘূর্ণাবর্ত তাকে গ্রাস করে, ফলে এক ঘূর্ণাবর্ত থেকে অন্য ঘূর্ণাবর্তে - ঘূর্ণির পরম্পরাচক্রে (vicious circle) সে ঘুরতে থাকে। অবশেষে এক শুভক্ষণে সে এক মহাপুরুষের দয়ার্দ্র দৃষ্টির সীমার মধ্যে এলে, পরমকরুণাময় ওই পুরুষ কীটটিকে ঘূর্ণাবর্ত থেকে তুলে তীরবর্তী এক বৃক্ষছায়ায় ছেড়ে দেন। (ভাবানুবাদ স্বামী সর্বাত্মানন্দ, রামকৃষ্ণ মিশন) এরপর সে কিভাবে জ্ঞানলাভের পথে চলবে, সেটা সম্পূর্ণরূপে তার নিজের ব্যাপার।
No comments:
Post a Comment