Blog Archive

Wednesday, May 4, 2022

অক্ষয়তৃতীয়া ২

সবটাই হলো প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার খেলা। আমরা বাইরের প্রকৃতিকে নিজেদের বাসনা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছি, নিজেদের সাময়িক সুখের জন্য তাকে যথেচ্ছ শোষণ করেছি, দোহন করেছি, ধ্বংস করেছি, যার ফলে সসাগরা বসুন্ধরা আজ সুস্থ বসবাসের প্রায় অযোগ্য হয়ে উঠেছেন। একমুঠো মাটি তৈরি করার মুরোদ নেই অথচ রাসায়নিক সার ব্যবহার করে করে সেই মাটিকেই বন্ধ্যা বানাতে আমাদের জুড়ি নেই। সূর্যের আল্ট্রা ভায়োলেট বিকিরণ থেকে রক্ষা করার জন্য ভগবান যে ট্রাইঅক্সিজেনের আবরণ দিয়ে পৃথিবীকে ঢেকে দিয়েছিলেন, তার আমরা এমন দুর্দশা করেছি যে মানুষের বেঁচে থাকাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। যে জল জীবনদায়ী অমৃত হিসেবে প্রকৃতির বদান্য, সেই জলের আমরা এমন দুরাবস্থা করেছি যে আগামী বিশ্বযুদ্ধ নাকি স্বচ্ছ পানীয় জলের দখলদারির জন্য হবে বলে শোনা যায়। কারণ একটাই - লোভ। আত্মবিস্মৃতির কারণে আমরা অনেকেই নিজেদের পরিচয় এই শরীরের ঊর্ধ্বে কিছু ভেবে উঠতে পারিনি এবং মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মাত্র কয়েক দশকের জীবিতকালের সুখের জন্য চিরকালের অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়াতেও দ্বিধা করিনি। আমরা একশ্রেণীর মানুষ এক বিধ্বংসী আসুরিক ভোগবাদীর দল এবং আজকের পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলও বটে। 

এর একেবারে উল্টো অবস্থানে আছেন শাশ্বত ভারতের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিরা, যাঁরা অন্তরের আসুরিক প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন যাতে বাইরের প্রকৃতি অবিকৃত সুজলা সুফলা থাকেন, সেখানে যেন সমস্ত জীব জগৎ জুড়ে এক অবিচ্ছিন্ন, অর্থপূর্ণ এবং পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক চিরকাল বিরাজ করে। তাঁরা বলতেন সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া, সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত, ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি (বৃহদারন্যক উপনিষদ ১/৪/১৪)। তাঁদের মননে সর্বে বলতে শুধু সমস্ত মানবজাতি নয়, সর্বে বলতে এই গোটা  বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত জড় ও চেতন বস্তু, ঈশ্বরের গোটা সৃষ্টিসমূহ। তাঁরা ভোগ নয়, ত্যাগে বিশ্বাসী ছিলেন, লোভ নয়, অল্পেতে সন্তুষ্ট ছিলেন, পূর্ববর্ণিত অবৈদিক সংস্কৃতির দলের চেয়ে একেবারে বিপরীতধর্মী পথের পথিক ছিলেন তাঁরা। তাঁরা নির্লোভ ছিলেন।

আসলে নির্লোভ মানেই তো নির্দোষ। যত গভীরভাবে 'সমগ্র সৃষ্টি একই শক্তির প্রকাশ'রূপী অবধারণা অন্তঃস্থ করা যাবে, তত মনের মধ্যে বিশ্বজনীন একাত্মতার বোধ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে আর নিজেকে শুধু শরীর বা মন নয়, সেই অখন্ড অনন্ত দৈবীশক্তির বিশালতা ও ব্যাপকতার সাথে সম্পৃক্ত ভাবাও সম্ভব হবে। তখন কে কাকে দোহন করবে? শ্রীশ্রীমা একজনকে বলেছিলেন, "যদি শান্তি চাও মা, কারাে দোষ দেখােনা, দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ। কেউ পর নয় মা, জগৎ তােমার"। সত্যি সত্যিই কেউ যে আর পর নন, কিছুই তো পর নয়, সব আপন, সবাই যে আপনার। একমাত্র মনের আসুরিক প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেই যে এই মানবিক একাত্মতাবোধ জাগতে পারে, এই আসল কথাটা আমাদের পূর্বপুরুষ বুঝতে পেরেছিলেন। যদি বিজাতীয় ভোগবাদী নির্মমতা আর নির্দয়তার দোষ আমাদের অনেকের বোধ-বুদ্ধি দূষিত না করে দিত, হয়তো আজও আমরা সবাই নির্দোষই থাকতাম।

অবশ্য এক অর্থে আমরা কেউই আসলে নির্দোষ নই। নির্দোষ হলে কর্মফলের বোঝা মাথায় করে প্রারব্ধ ভোগার জন্য বারেবারে শরীরধারণ করতে হতো না, তারতম্যটি কেবল মাত্রার এবং মানের। এবং এই তারতম্যের জন্যই কিন্তু আমরা কেউ মানুষেতর, কেউ মানুষ, কেউ বা দেবতা। প্রারব্ধ যাই থাকুক না কেন, নিজেদের যাপনের মাধ্যমে আমরা দোষের ঢিপি আরো উঁচু করবো না সমস্ত দোষ যাতে স্খলন হয়, অন্তত ঈশ্বরের কাছে এমন প্রার্থনাটুকু করার মতন নিজেকে যেন উপযুক্ত বিবেচনা করতে পারি, সেটা একমাত্র আমাদেরই বিবেচ্য। অর্থাৎ আমরা বাইরের প্রকৃতি নিয়ে মাথা ঘামাবো না অন্তরের প্রকৃতি নিয়ে মাথা ঘামাবো, তার ওপর নির্ভর করে আমরা কোন দলের - বেশিদের দলে না কমদের দলে।

আমাদের আর পশুদের মধ্যে যদি একটি মূল পার্থক্য থেকে থাকে, সেটি হলো চেতনা। আমরা সত্য আর মিথ্যা, সৎ আর অসৎ, ন্যায় আর অন্যায়, ধর্ম আর অধর্ম বিচার করতে পারি, তারা পারেনা। আরো একটা বড় পার্থক্য আছে। আমরা স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বিবেকের মাথা খেয়ে অসৎকেও অনায়াসে আপন করে নিতে পারি, সে বেচারারা পারেনা। পশুদের মধ্যে প্রাণরক্ষার তাগিদে আক্রমণ প্রতি-আক্রমণ অবশ্যই আছে কিন্তু কোনো ছল কপট নেই। ফলে, আমাদের মনে আমরা বিষ ধারণ করবো না অমৃত নাকি কিছু কিছু মাত্রায় দুটোই, সেই মন্থনের প্রক্রিয়া কিন্তু আমাদেরই হাতে। ঠাকুর ছিপ ফেলে মাছধরা খুব অপছন্দ করতেন কারণ তাতে খাবারের লোভ দেখিয়ে একটি প্রাণীকে প্রতারণা করে তার প্রাণহরণ করা হয়। এই পছন্দ অপছন্দগুলোই আমাদের নিয়ন্ত্রিত মনের ফসল, যা আমাদের মানুষ করে তোলে, ক্রমাগত আমাদের ধর্মাশ্রয়ী জীবন যাপনের দিকে এগিয়ে দেয়।

ভাগবতে রাজা পরীক্ষিৎ শুকদেবকে জিজ্ঞেস করছেন, 'হে মহাভাগ, মানুষ পাপকাজ থেকে কিভাবে বিরত থাকতে পারে আর নিজের পাপকর্মজনিত বিভিন্ন ভয়ানক যন্ত্রণাদায়ক নরকভোগ থেকে কিভাবে নিষ্কৃতি পেতে পারে?' (এই যে উন্নয়নের নামে যথেচ্ছাচারের ফলে উষ্ণায়নের ফলস্বরূপ আর্কটিক আইস গলে গলে সমুদ্রের জলস্তর বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছিয়েছে যে বহু দ্বীপপুঞ্জভিত্তিক দেশের চিরতরে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে এবং সেইসব দেশের নাগরিকরা অনিশ্চয়তা আর প্রবল আতঙ্কে রোজ দিনযাপন করছেন, এটাই তো নরক - জীবন্ত নরক।) তখন শুকদেব উত্তর দিচ্ছেন, 'অগ্নি যেমন বৃহৎ বেণুগুল্মকে দগ্ধ করে, তেমনি শ্রদ্ধাযুক্ত  ব্যক্তিগণও তপস্যা, ব্রহ্মচর্য, শম, দম, ত্যাগ, সত্য, শৌচ, যম, নিয়ম ইত্যাদি সহায় করিয়া বুদ্ধি ও বাক্যকৃত সমূহ পাপ বিনষ্ট করিতে সমর্থ হয়'। শম মানে শান্তি, দম মানে সংযম, যম মানে অহিংসা আর নিয়ম মানে নিয়ন্ত্রণ। অন্তে সেই নিয়ন্ত্রণেই ফেরা। ওটাই যে মূল।

No comments:

Post a Comment