আজ বিশ্বজুড়ে ভগবান গৌতম বুদ্ধের ২৫৬৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। বুদ্ধ মানে উদ্বোধিত, যাঁর মধ্যে শাশ্বত বোধ জাগরিত হয়েছে অর্থাৎ যিনি সাধনাবলে পরম জ্ঞান লাভ করেছেন। এই পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে যুগে যুগে অনেক বুদ্ধ এসেছেন, মানুষকে মুক্তির উপায় বলে গেছেন, গৌতম বুদ্ধ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য একজন দেবপুরুষ। পালিকা স্নেহময়ী সৎমা মহাপজাপতি গোতমীর পুত্র বলে গৌতম, পিতৃদত্ত নাম সিদ্ধার্থ। কেবল তাঁর পরম্পরাতেই তাঁর আগে আরো ২৭জন বুদ্ধ এসেছিলেন, তিনি ২৮তম এবং পরবর্তীতে যিনি আসবেন তাঁর নাম হবে আর্যমিত্র বুদ্ধ। আর অন্যান্য হিন্দু মতাবলম্বীদের কাছে গৌতম বুদ্ধ হলেন বিষ্ণুর একজন অবতার।
গৌতম বুদ্ধ অবশ্য নিজেকে তথাগত বলেই সাধারণত উল্লেখ করতেন - একভাবে দেখলে মানে দাঁড়ায় 'যে প্রকারে গত বা আগত/নির্গত/নিশ্চল' আর অন্যভাবে দেখলে 'তথা অর্থাৎ পরম অবস্থা, গত অর্থাৎ প্রাপ্ত'। লক্ষণীয়রূপে সম্বোধনটি বিশেষ্য নয়, বিশেষণপদ। তাঁর অনেকগুলি উপদেশের মধ্যে এমন পাঁচটি ব্যাপার ভগবান বুদ্ধ খুব জোর দিয়ে বারেবারে বলে গেছেন, যেগুলি যে কোনো মানুষের পক্ষেই ধর্মআধারিত জীবনযাপন করার জন্য একেবারে ন্যূনতম আবশ্যিক শর্ত:
মিথ্যে কথা বলবে না
চুরি করবে না
মাদকাসক্ত হবে না
ব্যভিচার করবে না
হিংসা করবে না
আর বলেছিলেন দুধরণের সম্যক প্রজ্ঞা আর তিন ধরণের সম্যক শীলের কথা, যেগুলির প্রত্যেকটিই মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করার সহজপাঠ। কিন্তু আমার কাছে ওঁর সবচেয়ে আকর্ষণীয় শিক্ষা হলো সম্যক সমাধি সংক্রান্ত। সম্যক সমাধি হলো তিন ধরণের:
সম্যক প্রযত্ন - ব্যায়াম, ইন্দ্রিয় সংযম, কুচিন্তা ত্যাগ এবং সৎ চিন্তার চেষ্টা ও তাকে স্থায়ী করার চেষ্টা;
সম্যক স্মৃতি - কায়া, বেদনা, চিত্ত ও মনের চলনের সঠিক স্থিতিগুলি ও তাদের ক্ষণবিধ্বংসী চরিত্রকে সর্বদা স্মরণে রাখা;
সম্যক সমাধি - চিত্তের একাগ্রতা।
(দর্শন দিগদর্শন- রাহুল সাংকৃত্যায়ন)
স্বামী বিবেকানন্দ ভগবান বুদ্ধ সম্পর্কে ১৯শে মার্চ ১৮৯৪ সালে ডেট্রয়েটে একটি দারুন বক্তৃতা করেছিলেন, যেটি ডেট্রয়েটে ট্রিব্যুন পত্রিকায় পরেরদিন প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি বলেছিলেন,
"...এক এক ধর্মে আমরা এক এক প্রকার সাধনার বিশেষ বিকাশ দেখিতে পাই। বৌদ্ধধর্মে নিষ্কাম কর্মের ভাবটাই বেশী প্রবল। আপনারা বৌদ্ধধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের সম্বন্ধ-বিষয়ে ভুল বুঝিবেন না, এদেশে অনেকেই ঐরূপ করিয়া থাকে। তাহারা মনে করে, বৌদ্ধধর্ম সনাতনধর্মের সহিত সংযোগহীন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধর্ম; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা নহে, ইহা আমাদের সনাতনধর্মেরই সম্প্রদায়বিশেষ।...
"অনেকের পক্ষে একজন ঈশ্বরে বিশ্বাস করিতে পারিলে সাধনপথ খুব সহজ হইয়া থাকে। কিন্তু বুদ্ধের জীবনালোচনায় স্পষ্ট প্রতীত হয় যে, যদি কোনও ব্যক্তি আদৌ ঈশ্বরে বিশ্বাসী না হয়, তাহার যদি কোন দার্শনিক মতে বিশ্বাস না থাকে, সে যদি কোন সম্প্রদায়ভুক্ত না হয়, অথবা কোন মন্দিরাদিতেও না যায়, তথাপি সে সেই চরমাবস্থা লাভ করিতে সমর্থ।...
"তিনি এমন এক ধর্ম প্রচার করিলেন, যাহাতে সকাম ভাবের লেশমাত্র ছিল না, আর তিনি দর্শন ও ঈশ্বর সম্বন্ধে নানাবিধ মতবাদ আলোচনা করিতে চাহিতেন না; ঐ বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন। অনেক অনেক সময় তাঁহাকে ঈশ্বর আছেন কি না জিজ্ঞাসা করিলে তিনি উত্তর দিতেন, ‘ও-সব আমি কিছু জানি না।’ মানবের প্রকৃত কর্তব্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিতেন, ‘নিজে ভালো কাজ করো এবং ভালো হও।’...
"একবার তাঁহার নিকট পাঁচজন ব্রাহ্মণ আসিয়া তাঁহাকে তাঁহাদের তর্কের মীমাংসা করিয়া দিতে বলিলেন।... (তাঁরা) ঈশ্বরের স্বরূপ ও তৎপ্রাপ্তির উপায় সম্বন্ধে নিজ নিজ শাস্ত্রের দোহাই দিয়া ভিন্ন ভিন্ন অভিপ্রায় প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তিনি প্রত্যেকের কথা বেশ মনোযোগ দিয়া শুনিয়া প্রত্যেককে এক এক করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আচ্ছা, আপনাদের কাহারও শাস্ত্রে কি এ কথা বলে যে, ঈশ্বর ক্রোধী হিংসাপরায়ণ বা অপবিত্র?’ ব্রাহ্মণেরা সকলেই বলিলেন, ‘না, ভগবান, সকল শাস্ত্রেই বলে ঈশ্বর শুদ্ধ ও কল্যাণময়।’ ভগবান বুদ্ধ বলিলেন, ‘বন্ধুগণ, তবে আপনারা কেন প্রথমে শুদ্ধ, পবিত্র ও কল্যাণকারী হইবার চেষ্টা করুন না, যাহাতে আপনারা ঈশ্বর কি বস্তু জানিতে পারেন?’
"অবশ্য আমি তাঁহার সকল মত সমর্থন করি না। আমার নিজের জন্যই আমি দার্শনিক বিচারের যথেষ্ট আবশ্যকতা বোধ করি। অনেক বিষয়ে তাঁহার সহিত আমার সম্পূর্ণ মতভেদ আছে বলিয়াই যে আমি তাঁহার চরিত্রের, তাঁহার ভাবের সৌন্দর্য দেখিব না, ইহার কি কোন অর্থ আছে? জগতের আচার্যগণের মধ্যে একমাত্র তাঁহারই কার্যে কোনরূপ বাহিরের অভিসন্ধি ছিল না। অন্যান্য মহাপুরুষগণ সকলেই নিজদিগকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া ঘোষণা করিয়া গিয়াছেন, আর ইহাও বলিয়া গিয়াছেন, ‘আমাকে যাহারা বিশ্বাস করিবে, তাহারা স্বর্গে যাইবে।’ কিন্তু ভগবান বুদ্ধ শেষ নিঃশ্বাসের সহিত কী বলিয়াছিলেন? তিনি বলিয়াছিলেন, ‘কেহই তোমাকে মুক্ত হইতে সাহায্য করিতে পারে না, নিজের সাহায্য নিজে করো, নিজের চেষ্টা দ্বারা নিজের মুক্তিসাধন করো।’
"নিজের সম্বন্ধে তিনি বলিয়াছেন, ‘বুদ্ধ-শব্দের অর্থ আকাশের ন্যায় অনন্তজ্ঞানসম্পন্ন। আমি গৌতম, সেই অবস্থা লাভ করিয়াছি; তোমরাও যদি উহার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা কর, তোমরাও উহা লাভ করিবে।’ তিনি সর্ববিধ কামনা ও অভিসন্ধিবর্জিত ছিলেন, সুতরাং তিনি স্বর্গগমনের বা ঐশ্বর্যের আকাঙ্ক্ষা করিতেন না। তিনি রাজসিংহাসনের আশা ও সর্ববিধ সুখ জলাঞ্জলি দিয়া ভারতের পথে পথে ভ্রমণ করিয়া ভিক্ষাবৃত্তি দ্বারা উদরপূরণ করিতেন এবং সমুদ্রের মত বিশাল হৃদয় লইয়া নরনারী ও অন্যান্য জীবজন্তুর কল্যাণ যাহাতে হয়, তাহাই প্রচার করিতেন।
"জগতের মধ্যে তিনিই একমাত্র মহাপুরুষ, যিনি যজ্ঞে পশুহত্যা-নিবারণের উদ্দেশ্যে পশুগণের পরিবর্তে নিজ জীবন বিসর্জনের জন্য সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন। তিনি একবার জনৈক রাজাকে বলিয়াছিলেন, ‘যদি যজ্ঞে ছাগশিশু হত্যা করিলে আপনার স্বর্গগমনের সহায়তা হয়, তবে নরহত্যা করিলে তাহাতে তো আরও অধিক উপকার হইবে, অতএব যজ্ঞস্থলে আমায় বধ করুন।’ রাজা এই কথা শুনিয়া বিস্মিত হইয়াছিলেন। অথচ এই মহাপুরষ সর্ববিধ অভিসন্ধিবর্জিত ছিলেন। তিনি কর্মযোগীর আদর্শ; আর তিনি যে উচ্চাবস্থায় আরোহণ করিয়াছিলেন, তাহাতেই বেশ বুঝা যায়, কর্ম দ্বারা আমরাও আধ্যাত্মিকতার চরম শিখরে আরোহণ করিতে পারি।..."
No comments:
Post a Comment