Blog Archive

Sunday, May 29, 2022

ষোড়শীরূপে শ্রীশ্রীমা

আজ ১৪ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। এই মুহূর্তে জ্যৈষ্ঠ কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথি চলছে, আর কিছুক্ষন পর ১৪.৫৬ মিঃ অমাবস্যা পড়ে যাবে। একে সাবিত্রী চতুর্দশীও বলে। আজই রাতে ফলহারিনী কালীপূজা। জ্যৈষ্ঠমাসে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল ইত্যাদি নানারকমের মরসুমি ফল পাওয়া যায়। সাধক তাঁর ইষ্টদেবীকে বিভিন্ন ফল দিয়ে প্রসাদ নিবেদন করে থাকেন। একদিকে ফলহারিণী মা সাধকের কর্মফল হরণ করেন। অপর দিকে কর্মফল হরণ করে সাধককে তাঁর অভীষ্টফল, মোক্ষফল প্রদান করেন।

এই সেই বিশেষ রাত যেদিন ১২৮০ বঙ্গাব্দে, আজ থেকে ১৪৯ বছর আগে, ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেব শ্রীশ্রীমাকে দশ মহাবিদ্যার অন্যতম দেবী ষোড়শী রূপে ষোড়শোপাচারে পূজা করেছিলেন। মায়ের নিজের বর্ণনা অনুযায়ী ঠাকুরের এক জ্ঞাতিভাইয়ের ছেলে দিনু আর ভাগ্নে হৃদয় দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ঘরে পুজোর সব আয়োজন করে দিয়েছিলেন। মা চৌকির উত্তর পাশে গঙ্গাজলের জালার দিকে মুখ করে বসেছিলেন আর ঠাকুর উত্তর-পূর্বদিকে মুখ করে পশ্চিমদিকের দরজার কাছে বসেছিলেন। ঠাকুর প্রথমে মায়ের গায়ে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিলেন। তারপর মায়ের পায়ে আলতা পরিয়ে দিলেন, সিঁদুর দিলেন, কাপড় পরিয়ে দিলেন, পান মিষ্টি খাওয়ালেন। সব দরজা বন্ধ ছিল আর মায়ের ডান পাশে সব পূজার জিনিষপত্র ছিল। পুজোয় বসে বিধিপূর্বক আচমন ইত্যাদি করার পর ঠাকুর ৺দেবী ত্রিপুরসুন্দরীর কাছে প্রার্থনা করলেন, "হে বালে, হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মাতঃ ত্রিপুরসুন্দরী, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত কর মা, এঁর শরীরমনকে পবিত্র করে এঁতে আবির্ভূতা হয়ে সর্বকল্যাণ সাধন কর!" 

যে মুহূর্তে এই শব্দগুলি মায়ের কানে গেল, তাঁর বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্ত হলো এবং তিনি গভীর সমাধিতে ডুবে গেলেন। তারপরেই ঠাকুরও অর্ধবাহ্যদশায় মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে সম্পূর্ণ সমাধিমগ্ন। পূজকও সমাধিস্থ, সামনে পুজিতা দেবীও সমাধিস্থা - এইভাবে আত্মস্বরূপে পূর্ণভাবে মিলিত ও একীভূত হয়ে কতক্ষণ যে কেটে গেল কে জানে। খানিকটা বাহ্যজ্ঞান ফিরে আসার পর ঠাকুর শ্রীশ্রীমায়ের পাদপদ্মে নিজের সারা জীবনের সাধনার ফল ও জপের মালা অর্পণ করে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বললেন, "হে সর্বমঙ্গলের মঙ্গলস্বরূপে, হে সর্বকর্ম নিষ্পন্নকারিণী, হে শরণদায়িনী, ত্রিনয়নী, শিবগেহিনি গৌরি, হে নারায়ণি, তোমাকে প্রণাম করি।" পূজা শেষ হলো। মা কোনোমতে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন, তখনো সম্পূর্ণরূপে তাঁর বাহ্যজ্ঞান ফেরেনি।

এই কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে মাত্র কিছুদিন আগে, স্বয়ং শিব সশরীরে পূজা করেছেন তাঁর শক্তিকে - ভাবা যায়? অনন্দলহরী স্ত্রোত্রের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে,
তনিয়াংসং পাংশুন তব চরণপঙ্কেরুহভবং  
বিরিঞ্চি সঞ্চিবন বিরচয়তি লোকানবিকলম ।
বহতোনং শৌরীঃ কথমপি সহস্রেন শিরসং
হরঃসংক্ষু দৈনয়ং ভজতি ভসিতো দ্ধুলনবিধিম ।।
অর্থাৎ, জননী তোমার চরণপদ্ম হইতে উদ্ভূত ধূলির কনা মাত্র কুড়াইয়া লইয়া ব্রহ্মা যথাযতভাবে এই জগৎ প্রপঞ্চ সৃষ্টি করেন, আর এই ধূলিকনাকেই সহস্র শিরের দ্বারা বিষ্ণু অনন্তরূপে কোনো প্রকারে বহন করেন। আর প্রলয়সময়ে তাহাকেই  (ধূলিকনাকেই) চূর্ণ করিয়া শিব স্বীয় অঙ্গে বিভূতিলেপন ক্রিয়ায় নিরত হন।
ঠাকুর পরে বলেছিলেন, “ও সারদা – সরস্বতী – জ্ঞান দিতে এসেছে। রূপ থাকলে পাছে অশুদ্ধ মনে দেখে লোকের অকল্যাণ হয়, তাই এবার রূপ ঢেকে এসেছে। ও জ্ঞানদায়িনী, মহাবুদ্ধিমতী। ও কি যে সে ! ও আমার শক্তি!” 

ত্রিপুর, অর্থাৎ তিনটি পুর, বা তিনটি অবস্থা। যিনি পরাশক্তি, মহাদেবী ও মহাবিদ্যা অর্থাৎ সৃষ্টির কারণ, সৃষ্টির পালন এবং অবিদ্যার বিনাশের মূল শক্তি হয়ে বিরাজ করছেন, তিনিই ত্রিপুরসুন্দরী। সৃষ্টি আর স্থিতি তাঁতেই আধারিত। কালীরূপে সেই তিনিই রয়েছেন। তবে কালী অবিদ্যা বিনাশের প্রতীক। অর্থাৎ বিলীন বা সমাধি। তাই ঠাকুর শূন্য থেকে শুরু করে পূর্ণের দিকে গেলেন। 'যে মা স্বয়ং মন্দিরে আছেন', সেই ভবতারিণী মহাকালীকে 'সমাধিমন্দির' থেকে নামিয়ে প্রতিষ্ঠা করছেন জীবন আর জাগরণের অলিন্দে। দায়ভার সঁপে দিচ্ছেন। 'কলকাতার লোকগুলো যেন পোকার মতো কিলবিল করছে। তুমি তাদের দেখো।' এই দায় কালী রূপটি নিতে পারেন না। এই দায় নিতে পারেন একমাত্র ষোড়শী ত্রিপুরসুন্দরী। তাই তাঁকেই শ্রীশ্রীমায়ের মূর্তিমতী বিদ্যারূপিণী মানবীশরীরে উদ্ভোদিত করলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।

এর অনেকবছর পর আর এক ফলহারিণী পূজার দিনে ঠাকুরের মাতৃউদ্দীপনের কথা মাষ্টারমশাই শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতেএইভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন:
'আজ জৈষ্ঠ কৃষ্ণা চতুর্দশী। সাবিত্রী চতুর্দশী। আবার অমাবস্যা ও ফলহারিণী-পূজা। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে নিজ মন্দিরে বসিয়া আছেন। ভক্তেরা তাঁহাকে দর্শন করিতে আসিতেছেন। সোমবার, ইংরেজী ৪ঠা জুন, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ।

মাস্টার পূর্বদিন রবিবারে আসিয়াছেন। ওই রাত্রে কাত্যায়নীপূজা। ঠাকুর প্রেমাবিষ্ট হইয়া নাটমন্দিরে মার সম্মুখে দাঁড়াইয়া, বলিতেছেন, 
“মা, তুমিই ব্রজের কাত্যায়নী:
তুমি স্বর্গ, তুমি মর্ত মা, তুমি সে পাতাল।
তোমা হতে হরি ব্রহ্মা, দ্বাদশ গোপাল।
দশ মহাবিদ্যা মাতা দশ অবতার।
এবার কোনরূপে আমায় করিতে হবে পার।”
ঠাকুর গান করিতেছেন ও মার সঙ্গে কথা কহিতেছেন। প্রেমে একেবারে মাতোয়ারা! নিজের ঘরে আসিয়া চৌকির উপর বসিলেন।'

জয় জয় গুরুমাতা জগৎ-জননী ।
রামকৃষ্ণ ভক্তিদাত্রী চৈতন্যদায়িনী ।।

No comments:

Post a Comment