শ্রীরামকৃষ্ণ মঠে স্বামীজীরচিত যে আরাত্রিক ভজনটি প্রতিদিন সন্ধ্যায় গাওয়া হয় তার নবম স্তবকে কিছু অদ্ভুত শব্দবন্ধ আছে, যেটি আসলে স্বামীজী প্ৰথমে দ্বিতীয় স্তবক হিসেবে লিখেছিলেন, পরে আগের স্তবকগুলি লিখে গানটি অনেকটাই পরিবর্তন করেন। রামকৃষ্ণ-অনুরাগীরা সকলেই এই ভজনটি by heart জানেন। অদ্ভুত এই কারণে বলছি কারণ যাঁর সম্পর্কে তিনি এই কথাগুলি লিখেছেন তাঁকে তিনি রক্ত-মাংসের শরীরে অন্তরঙ্গভাবে দেখেছেন, পাঁচ বছরের কিছু কম সময়ে লাগাতার তাঁর দিব্য সঙ্গ করেছেন, নানাভাবে তাঁকে পরীক্ষা করেছেন, তাঁর কাছ থেকে আধ্যাত্মিক শক্তি গ্রহণ করেছেন, তিনি যখন অসুস্থ তখন তাঁকে খাইয়ে দিয়েছেন, ক্ষত পরিষ্কার করে দিয়েছেন, রাতদিন সেবা করেছেন - কাউকে একেবারে যতদূর কাছ থেকে দেখা সম্ভব, ঠাকুরকে ততটাই কাছ থেকে দেখেছেন। আর দেখার মতন দেখেছেন বলেই স্বামীজী লিখেছেন,
নমো নমো প্রভু বাক্যমনাতীত
মনোবচনৈকাধার ।
জ্যোতির জ্যোতি উজল হৃদিকন্দর
তুমি তমোভঞ্জনহার ॥
অর্থাৎ, তোমায় বারবার প্রণাম করি প্রভু, তুমি একইসাথে বাক্য ও মনের অতীত আবার বাক্য ও মনের আধারও। হৃদয়ের মাঝে সদা প্রদৃপ্তমান যে জ্যোতি, তুমি সেই জ্যোতির জ্যোতি, তুমি অজ্ঞানতার অন্ধকার নাশ করো।
বাক্য মানে পূর্ণ অর্থজ্ঞাপক ও অন্বয়বিশিষ্ট পদসমষ্টি, যা বুদ্ধিনির্ভর, শরীরনির্ভর এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতি-নিৰ্ভর। মন মানে সূক্ষ্ম শরীর, যাকে সাহেবরা Soul বলেন, আমরা বলি মানস। এটি আত্মার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে এবং তাঁর সাথে সাথেই মৃত শরীর ত্যাগ করে কর্মফল অনুযায়ী বিভিন্ন স্তরের স্বর্গ ঘুরে অবশেষে আবার নতুন শরীর গ্রহণ করে। একমাত্র মুক্ত আত্মাই নির্ণয় করতে পারেন তিনি তাঁর মন রাখবেন না ত্যাগ করবেন, বাকি কারো পক্ষে সেটা সম্ভব নয়*। এই বাক্য ও মনের অতীত কে? নির্গুণ ব্রহ্ম। আবার বাক্য ও মনের আধার কি? না মায়া, শক্তি, সগুণ ব্রহ্ম। জীবের এই অন্নময় কোষ আর মনোময় কোষ তো মহামায়ার ভানুমতির খেল, ওতেই তো অহংকারের উৎপত্তি এবং ওর জন্যই তো যত রাজ্যের ভোগান্তি। তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়ালো? স্বামীজী ঠাকুরকে ব্রহ্ম এবং শক্তি, পুরুষ এবং প্রকৃতি, নির্গুণ এবং সগুণ - একাধারে দুটোই বলে বর্ণনা করছেন যা আসলে দুই নয়, একই - ঠাকুরের কথা অনুযায়ী যেমন আগুন আর তার দাহিকাশক্তি, সমুদ্র আর তার ঢেউ - আপাতদৃষ্টিতে আলাদা অথচ এক এবং অবিভাজ্য।
এরপরে ঠাকুরকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন 'জ্যোতির জ্যোতি'। কবীরের দোহায় আছে,
কবীরা সকলী বৌলে বাণী সব ঘটমে ঘর ছান্না।
অনংত লুট হোত ঘট ভিতর ঘটকা মর্ম ন পায়া।।
অর্থাৎ,
কবীর অখন্ড কহিতেছেন বাণী
সকল ঘটে ব্যাপ্ত করিয়াছেন তিনি (তাঁহার) ঘর
ঘটের ভিতর অনন্তের হইতেছে লুট
ঘটের মর্ম না পাইলাম।
(কবীর, ক্ষিতিমোহন সেন)
আমাদের পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, মন বুদ্ধি অহংকার আনন্দ সবকিছুর দ্রষ্টা তো সেই একম অদ্বিতীয়ম আত্মা, যাঁকে বেদপড়া সাবেবরা বলেন Self আর আমরা বলি তুরীয়। জলভরা প্রত্যেকটি ঘটে অর্থাৎ জীবদেহে তো সেই একই সূর্য্যের প্রতিবিম্ব। ইনি অবিনশ্বর, অব্যক্ত, অচিন্ত্য ও অবিকারী। এঁর সম্পর্কে গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২৩ ও ২৪ নং শ্লোকে ভগবান বলছেন,
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ ।
ন চৈনং ক্লেদযন্ত্যাপো ন শোষযতি মারুতঃ ।।
অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশোষ্য এব চ ।
নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ ।।
অর্থাৎ, আত্মাকে অস্ত্রের দ্বারা ছিন্ন করা যায় না, আগুনে পোড়ান যায় না, জলে ভেজানো যায় না, অথবা হাওয়াতে শুকানোও যায় না। এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য ও অশোষণীয়। তিনি চিরস্থায়ী, সর্বব্যপ্ত, অপরিবর্তনীয়, অচল ও সনাতন।
এই আত্মা কে? না সেই এক অনাদি অনন্ত ব্রহ্ম। জীবের জীবনজ্যোতি আসলে কার জ্যোতি? সেই অদ্বৈত ব্রহ্মের। তাই তিনি হলেন জ্যোতির জ্যোতি। অর্থাৎ ঠাকুরই সাক্ষাৎ ব্রহ্ম, এই কথাটিই একটু অন্যভাবে বললেন স্বামীজী।
শেষে বলছেন, 'তুমি তমোভঞ্জনহার'। স্বামীজী ১৮৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর জাফনার বক্তৃতায় আত্মার প্রকাশ সম্পর্কে বলছেন, 'The difference is not in the soul, but in the manifestation. Between me and the smallest animal, the difference is only in manifestation, but as a principle he is the same as I am, he is my brother, he has the same soul as I have. This is the greatest principle that India has preached'. এখানে স্বামীজি মিশনারিদের তখনকার চালু বাক্য-ব্যবহার অনুযায়ী আত্মা অর্থেই soul শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যদিও আত্মা আর soul এক নয়। খানিকক্ষণ পরেই উনি বলছেন, 'And what are our relations with this Impersonal Being (ব্রহ্ম)? — that we are He. We and He are one. Every one is but a manifestation of that Impersonal, the basis of all being, and misery consists in thinking of ourselves as different from this Infinite, Impersonal Being; and liberation consists in knowing our unity with this wonderful Impersonality. ....It is only through the idea of the Impersonal God that you can have any system of ethics. In every nation the truth has been preached from the most ancient times — love your fellow-beings as yourselves — I mean, love human beings as yourselves. In India it has been preached, "love all beings as yourselves"; we make no distinction between men and animals'. যে মুহূর্তে আমি সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারবো যে আমি শরীর নই, মন নই, বুদ্ধি নই, আমিই ব্রহ্ম, 'অহং ব্রহ্মাস্মি'- অমনি আমার মন থেকে অজ্ঞানতার অন্ধকার মুছে যাবে, আমার স্বরূপ দর্শন হবে।
মানুষ হয়ে জন্মেছি, মাথার মধ্যে এত বুদ্ধি গিজগিজ করছে, এত পড়াশুনা করেছি, তাহলে এই সহজ সত্যটা ধারণা করতে পারছি না কেন? ঠাকুর বলছেন 'অহংকার'। বলছেন, "মানুষ আপনাকে চিনতে পারলে ভগবানকে চিনতে পারে। 'আমি কে' ভালরূপ বিচার করলে দেখতে পাওয়া যায়, 'আমি' বলে কোন জিনিস নেই। হাত, পা, রক্ত, মাংস ইত্যাদি - এর কোনটা 'আমি'? যেমন প্যাঁজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে কেবল খোসাই বেরোয়, সার কিছু থাকে না, সেইরূপ বিচার কল্লে 'আমি' বলে কিছুই পাইনে! শেষে যা থাকে, তাই আত্মা - চৈতন্য। 'আমার' 'আমিত্ব' দূর হলে ভগবান্ দেখা দেন।" স্বামীজী বলছেন অজ্ঞানতার কারণেই আমাদের বারবার পৃথিবীতে আসা, 'How did It (আত্মা) come down to earth? There is but one answer to that in our scriptures. Ignorance is the cause of all this bondage. It is through ignorance that we have become bound; knowledge will cure it by taking us to the other side. How will that knowledge come? Through love, Bhakti; by the worship of God, by loving all beings as the temples of God. He resides within them. Thus, with that intense love will come knowledge, and ignorance will disappear, the bonds will break, and the soul will be free'. এই পরম জ্ঞানলাভ একমাত্র ব্রহ্মকৃপা দ্বারাই সম্ভব আর সেই জন্য নিরন্তর প্রার্থনা করতে হয়। ঠাকুর স্বয়ং ব্রহ্ম, ফলে তাঁর কৃপা হলেই অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয়ে গিয়ে আমাদের হৃদয় জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হবে।
১৮৮৫ সালের ৭ই মার্চ শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করছেন, "আচ্ছা, কেউ কেউ যে আমাকে ঈশ্বরের অবতার বলে, তোর কি বোধ হয়?" উত্তরে নরেন্দ্রনাথ বললেন, "অন্যের মত শুনে আমি কিছু করব না; আমি নিজে যখন বুঝব, নিজের যখন বিশ্বাস হবে, তখনই বলব।" বহুবছর পর এই আরাত্রিক ভজনের মাধ্যমে ব্রহ্মজ্ঞানী স্বামী বিবেকানন্দজী মহারাজ সবাইকে শোনালেন তাঁর গুরুকে তিনি কি চোখে দেখেন। গুরু শব্দের অর্থ, যিনি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যান। এক্ষেত্রে অন্ধকার কী? অন্ধকার আমাদের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অজ্ঞতা, সংশয়, জিজ্ঞাসা, ইত্যাদি। এইসব যিনি অনায়াসে দূর করেন, তিনিই গুরু। তিনি নিজে যেহেতু জ্ঞানালোকিত, ফলে তিনি জ্যোতির্ময় হয়ে শিষ্যদের হৃদয়ও সেই পরমজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেন। তাই গুরুপ্রণাম মন্ত্রে বলা আছে,
অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ।।
অর্থাৎ, যিনি অজ্ঞান নামক অন্ধকার থেকে জ্ঞান নামক কাজলকাঠি ব্যবহার করে শিষ্যের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করেন, সেই গুরুকে প্রণাম জানাই। জ্ঞানাঞ্জন মানে জ্ঞান রূপ অঞ্জন অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞানরূপ কাজল যার দ্বারা অজ্ঞানরূপ অন্ধকার দূর হয় বা তিমিররোগ নিরাময় হয় এবং সমস্ত কিছুর প্রকৃত রূপ অর্থাৎ সবই যে ব্রহ্ম, এই সত্যটি উপলব্ধি করা যায়। গুরুরূপে ঠাকুর স্বামীজীর মধ্যে এই পরমজ্ঞানের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। ঠাকুরের নিজের কথায়, "যেমন পায়ে জুতা পরা থাকলে লোকে স্বচ্ছন্দে কাঁটার ওপর দিয়ে চলে যায়, তেমনি তত্ত্বজ্ঞানরূপ আবরণ পরে মন এই কণ্টকময় সংসারে বিচরণ করতে পারে।"
*'Atman is separate from the mind, as well as from the body, and that this Atman goes through birth and death, accompanied by the mind, the Sukshma Sharira. And when the time comes that it has attained to all knowledge and manifested itself to perfection, then this going from birth to death ceases for it. Then it is at liberty either to keep that mind, the Sukshma Sharira, or to let it go for ever, and remain independent and free throughout all eternity. The goal of the soul is freedom. That is one peculiarity of our religion.' (Swami Vivekananda, Lectures from Colombo to Almora, Vedantism)
No comments:
Post a Comment