জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখছি বাইরেটা ঝাপসা হয়ে গেছে, মাতার স্তন্যসুধা-হেন বৃষ্টির জীবনদায়িনী ফোঁটা ঝরে ঝরে পড়ছে অঝোরে। গাছের পাতাগুলো সব যেন স্নেহচুম্বনের পরিপূর্ণতায় একেবারে টগবগ করছে, বহতি ঝোড়ো হাওয়ার সাথে সাথে যেন মায়ের কোলে ওঠা শিশুর হটাৎ আনন্দের উচ্ছলতার স্পর্শ সবকিছুকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিভেজা মাটি যেন উদ্ভিন্নযৌবনা সদ্যযুবতীর মতো আরক্তমুখে সোহাগে সিঞ্চিত হতে হতে প্রেমে নিশ্চিন্ত নির্ভর নিবেদিতা হয়ে পড়ছেন। একটু পরেই রোদ উঠবে, আলোর কণায় কণায় ভরে যাবে এই ভোর, পাতাদের ভিজে গায়ে যেন হাজার হাজার জোনাকি জ্বলে উঠবে, তার ফাঁক দিয়ে জীবন উঁকি মেরে মুচকি হেসে বলবে, "কেমন আছো?" হয়তো তারপর আবার আকাশ মেঘে ঢেকে যাবে, আবার বৃষ্টি নামবে, আবার আলো আর কালোর লুকোচুরি খেলা শুরু হবে। দেখছি আর রবীন্দ্রনাথ মনে পড়ছেন, মনে পড়ছে শেষের কবিতার অমিত আর লাবণ্যকে, মনে পড়ছে শিলং পাহাড়ে এমনই এক বৃষ্টিস্নাত দিনে অমিতের সেই কথাগুলো, "বিধাতার রাজ্যে ভালো জিনিস অল্প হয় বলেই তা ভালো, নইলে সে নিজেরই ভিড়ের ঠেলায় হয়ে যেত মাঝারি"। ওই হলো আসল কথা - 'ভালো'।
শিলং পাহাড়ে একসঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে অমিত যখন লাবণ্যকে একটা ছ্যাৎলাপড়া পাথরের ওপর বসতে অনুরোধ করেছিল, তখন লাবণ্য ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, "কিন্তু সময় যে অল্প।" উত্তরে অমিত কি বলেছিল মনে পড়ে? বলেছিল, "জীবনে সেটাই তো শোচনীয় সমস্যা লাবণ্যদেবী, সময় অল্প।… সময় যাদের বিস্তর তাদের পাঙ্কচুয়াল হওয়া শোভা পায়। দেবতার হাতে সময় অসীম; তাই ঠিক সময়টিতে সূর্য ওঠে, ঠিক সময়ে অস্ত যায়। আমাদের মেয়াদ অল্প, পাঙ্কচুয়াল হতে গিয়ে সময় নষ্ট করা আমাদের পক্ষে অমিতব্যয়িতা।" সবটাই তো সময়ের খেলা প্রভু। সময় হলে পাওয়া আবার সময় না হলে না-পাওয়া আর এই পাওয়া না-পাওয়ার মাঝের সময়টিতে নিজেকে বোঝা।
"ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে ‘হারাই হারাই’ সদা ভয় হয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে।
আশ না মিটিতে হারাইয়া–
পলক না পড়িতে হারাইয়া–
হৃদয় না জুড়াতে হারাইয়া ফেলি চকিতে।
কী করিলে বলো পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে।"
অমিত একদিন বুঝেছিল যে প্রেমেরও বাহির আর ভেতর আছে, তার মধ্যে ওপরে ভেসে ওঠা আর ভেতরে ডুব দেওয়ার খেলাও আছে। তাই তো সে বলেছিল, "কেতকীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালোবাসারই। কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল, প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যের ভালোবাসা, সে রইল দীঘি। সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।" আসলে ভেতরের জগতের মধ্যেই বাইরের জগৎটাও বিরাজ করে, ওটা যেমন, এটাও তেমনই সজীব - ফলে গোটাটাকে চাই, সুপুরিগাছ বেয়ে আকাশের দিকে উঠে যাওয়া লতাগুল্মের মতন একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে চাই। যাকে বাইরে দেখা যায়, তাকেই ভেতরে দেখা যায়, ঠিক যেন আয়নার সামনে দাঁড়ানোর মতন। আবার, চোখ খুললে যে আলো, চোখ বন্ধ করলেও তো সেই আলো, কেবল আলোর রকমফের কারণ চোখের নিজের যে কোনো আলো নেই। অন্ধকার মানে তো আসলে আলোই, আলোর বাইরের রূপ। যেমন প্রেম মানেই অপ্রেম আর অপ্রেম মানেই প্রেম। প্রেমের ওপর বাইরের আলো পড়লে তাকে খালি চোখে দেখা যায়, আর ভেতরে ঢুকলে সে আত্মগত হয়, তখন তাকে অন্তরের আলোয় দেখতে হয়। অমিতের সেই কথাগুলো মনে পড়ছে? "যে ভালোবাসা ব্যাপ্তভাবে আকাশে থাকে অন্তরের মধ্যে সে দেয় সঙ্গ; যে ভালোবাসা বিশেষভাবে প্রতিদিনের সব-কিছুতেই যুক্ত হয়ে থাকে সংসারে সে দেয় আসঙ্গ। দুটোই আমি চাই।"
No comments:
Post a Comment