ভূগোল যখন রাজনীতি দ্বারা নির্মিত হয়, তখন সে দেশ; যখন সংস্কৃতি দ্বারা নির্ধারিত হয়, তখন সে রাষ্ট্র; যখন বলপ্রয়োগের দ্বারা নির্দেশিত হয়, তখন সে সাম্রাজ্য; আর যখন মনন দ্বারা নির্ণায়িত হয়, তখন সে সভ্যতা। ইতিহাস আর ভূগোলের মধ্যে কার ভূমিকা আগে আর কারটি পরে এই আলোচনা এখানে নিরর্থক কারণ এরা একে অপরের পরিপূরক, দুটিতে প্রায় একসাথেই হাতে হাত ধরে পথ চলে। ভারত কেবল একটি দেশমাত্র নয়, ভারত এক সভ্যতা, এক অনবদ্য ও অনন্য সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার, যাকে হিন্দু সভ্যতাও বলে। এই সহজ ঐতিহাসিক সত্যটি না বুঝলে কেন যে আমাদের মাতৃভূমি পুণ্যভূমি, ধর্মের ধাত্রী এবং মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের তপোভূমি, সেটা বুঝতে অসুবিধা হবে।
মানুষের ব্যাপারটাও প্রায় এইরকমই। যখন সে শুধুই শরীর, তখন সে অন্নময়; যখন সে শরীর এবং মন, তখন সে মনোময়; যখন সে শরীর এবং মন এবং বুদ্ধি, তখন সে বিজ্ঞানময়; আর যখন সেই বুদ্ধিকে পার করে গিয়ে সে বিবেকি, তখন সে আনন্দময়। অন্যভাবে দেখতে গেলে, মানুষ যখন শারীরিক, তখন সে পাশবিক; মানুষ যখন মানসিক, তখন সে অহংকারী; মানুষ যখন বৌদ্ধিক, তখন সে বৈচারিক; আর মানুষ যখন সাধক, তখন সে অন্বেষী। ভূগোল যদিও সভ্যতার গন্ডিতে সীমাবদ্ধ, মানুষের কিন্তু এরপরেও একধাপ এগোবার সুযোগ আছে, যাকে ঋষিরা সমাধি অবস্থা বলেন - যখন তার আর কোনো সীমা নেই, সে অসীম, অনন্ত, যখন সে ব্রহ্মস্বরূপ।
সমস্ত জীবজগতের মধ্যে যেহেতু একমাত্র মানুষই স্থান কাল পাত্রের গন্ডি পেরিয়ে অধিভৌতিকে পৌঁছতে পারে, তাই একমাত্র মানুষই ভৌতিক প্রয়োজনে দেশ তৈরি করে, দেশের মধ্যে সমাজ তৈরি করে, নিয়ম নীতি তৈরি করে আর জীবনকে ভোগ এবং ত্যাগ করার বিভিন্ন পন্থাও তৈরি করে। তারপর সেই জীবনবোধ ছড়ায়, তাকে ঘিরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এক সভ্যতা। প্রত্যেক প্রাচীন সভ্যতারই কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, ভারতেরও আছে। ভারতীয় সভ্যতার বিশেষত্ব হলো তার অন্তর্নিহিত ধর্মবোধ, যা মানুষকে পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বে এবং মনুষ্যত্ব থেকে দেবত্বে উত্তিরণের পথ দেখায়। স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়, "প্রত্যেকের অন্তরে যে দেবত্ব (ঐশ্বরীয় সত্ত্বা) আছে, তার পূর্ন বিকশিত রূপই ধর্ম।" তাই মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশের সাথে তার ভারতে জন্মগ্রহণ করার অবশ্যই কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে, নইলে এত হাজার হাজার বছর ধরে এত এত মহামানব এই বিশেষ ভূমিতে প্রকাশিত পল্লবিত বিকশিত হলেন কি ভাবে?
স্বামীজী তাঁর 'ভারত প্রসঙ্গে' গ্রন্থে (বাণী ও রচনা, পঞ্চম খণ্ড, ভূমিকা) নিজের মাতৃভূমি সম্পর্কে বলছেন,
'আমার দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক যাহা কিছু সম্বল—সে-সবই তো আমি এই দেশের কাছে পাইয়াছি, এবং যদি আমি কোন ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করিয়া থাকি, সে গৌরব আমার নয়, তোমাদের। কিন্তু দুর্বলতা ও ব্যর্থতা—সেগুলি আমার ব্যক্তিগত; সে-সবই এই দেশবাসীকে যে মহতী ভাবধারা আজন্ম ধারণ করিয়া রাখে, তাহা দ্বারা সমৃদ্ধ হইবার শক্তির অভাববশতঃ।
আর কী দেশ! বিদেশী অথবা স্বদেশী, যে-কেহ এই পবিত্রভূমিতে আসিয়া দাঁড়াইবে—যদি তাহার মন পশুস্তরে অধঃপতিত না হইয়া থাকে, তাহা হইলে ইতিহাসের বিস্মৃত অতীত হইতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম যে-সন্তানেরা পশুসত্তাকে দিব্যসত্তায় উন্নীত করিবার সাধনা করিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের জীবন্ত চিন্তারাশি দ্বারা নিজেদের পরিবৃত অনুভব করিবে। সমগ্র বায়ুমণ্ডল আধ্যাত্মিকতায় স্পন্দিত হইতেছে।
দর্শন, নীতিশাস্ত্র ও আধ্যাত্মিকতা—যা কিছু মানুষের অন্তর্নিহিত পশুসত্তা বজায় রাখিবার নিরন্তর প্রচেষ্টায় বিরতি আনিয়া দেয়, যে-সকল শিক্ষা মানুষকে পশুত্বের আবরণ অপসৃত করিয়া জন্মমৃত্যুহীন চিরপবিত্র অমর আত্মা-রূপে প্রকাশিত হইতে সাহায্য করে—এই দেশ সেই সব-কিছুরই পুণ্যভূমি। এই দেশ—যেখানে আনন্দের পাত্রটি পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল, বেদনায় পাত্রটি পূর্ণতর হইলে অবশেষে এইখানেই মানুষ সর্বপ্রথম উপলব্ধি করিল—এ সবই অসার; এখানেই যৌবনের প্রথম সূচনায়, বিলাসের ক্রোড়ে, গৌরবের সমুচ্চ শিখরে, ক্ষমতার অজস্র প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ মায়ার শৃঙ্খল চূর্ণ করিয়া বাহির হইয়াছে।'
স্বামীজীর কথাগুলি কিন্তু কেবল কথার কথা নয়, তাঁর সারা জীবনের উপলব্ধি। আসলে এই দেশে জন্মানো কখনোই অকারণে ঘটে না, কোথাও না কোথাও পরমাত্মার কৃপা কাজ করে। এই যে দেশের সম্মিলিত বোধে ত্যাগকে ভোগের অনেক ওপরে রাখার সংস্কৃতি, এ তো আর অকস্মাৎ হতে পারেনা, বোধের কত না গভীর স্তরে উঠে নিঃস্পৃহ চিন্তন মননের ফসল এই অনন্য জীবনদর্শন। এই যে ধনীকে ছেড়ে সন্ন্যাসীকে শ্রদ্ধা করার শিক্ষা, সর্বত্যাগীর সামনে দুর্বিনীতকেও বিনীত হতে বাধ্য করা, কখনো খালি হাতে দেব ও সাধুদর্শন না করার সংস্কার, আশৈশব এইসব কর্তব্যবোধ এই দেশে না জন্মালে পেতাম কিভাবে?
একই দেশে যাজ্ঞবল্ক্য আর অষ্টাবক্র, বাক আর গার্গী, বাল্মীকি আর বেদব্যাস, আত্রেয়ী আর মৈত্রেয়ী, বুদ্ধ আর শংকর, অতীশ দীপঙ্কর আর অভিনব গুপ্ত এবং বিবেকানন্দ আর রবীন্দ্রনাথ জন্মান, এটা নেহাতই কাকতলীয় বলে তো মনে হয়না। দেশের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে দেশবাসীর বেড়ে ওঠাটা একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে, যুগে যুগে সব দেশের ক্ষেত্রেই তাই হয়ে এসেছে। আমাদের দেশে আমরা বেড়ে উঠেছি ধর্মের পথে থেকে সমাজের স্বার্থে সৎপথে অর্থ উপার্জন করে জাগতিক কামনা মিটিয়ে নিয়ে মোক্ষের পথে পাড়ি জমানোর একটা প্রক্রিয়ার আবহে, এর কিন্তু কোনো জুড়ি নেই। আমাদের এই অনন্য দেশে কখন যে ভোগের ভেতর দিয়ে যোগ তার রাস্তা তৈরি করে নেবে, বোঝা দুষ্কর।
বৃহদারণ্যকোপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য নারীপুরুষের প্রেমকে পর্য্যন্ত ব্ৰহ্মপোলব্ধির উপমারূপে উপস্থাপন করছেন - 'যেমন প্রিয় স্ত্রীর দ্বারা আলিঙ্গিত পুরুষের বাহ্যজগতের কিছুরই বোধ থাকে না, তেমনই ব্ৰহ্মজ্ঞান হলে বাহ্যবস্তুর কোনও বোধই থাকে না।' বোঝো কান্ড!
জনক রাজা ওনাকে প্রশ্ন করছেন, 'পুরুষের জ্যোতি কি?'
যাজ্ঞবল্ক্যের উত্তর, 'সূৰ্য'
'সূর্য অস্ত গেলে?'
'চন্দ্ৰমা'
'চন্দ্ৰমা না থাকলে?'
'অগ্নি'
'তাও না থাকলে?'
'বাক'
'তাও নীরব হয়ে গেলে?'
‘আত্মাই পুরুষের জ্যোতি। এই আত্মার লীলাই লোকে দেখে, তাকে কেউ দেখে না'।
আর্যাবর্তে বহু খণ্ড-রাজ্য ছিল, নানা রাষ্ট্রব্যবস্থা, নানা জাতি মত ও আচার। উপনিষদ সবাইকে এক করে দিয়ে বলল, 'সবই সেই একক সত্তার প্রকাশ, সত্য সেই এক, সেই বৃহৎ ব্ৰহ্ম, সেই পরম-সত্তা আত্মা, স্ব-রূপ'। ব্যস, গল্প শেষ হয়ে গেল। একটা গোটা জাতি একসাথে অদ্বৈতজ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে গেয়ে উঠলো,
শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা
আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূ॥
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ, ২.৫)
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্
আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
তমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতি
নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়॥
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ, ৩.৮)
শোনো বিশ্বজন,
শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ
দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে
মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে
জ্যোতির্ময়। তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পারো, অন্য পথ নাহি।
(রবীন্দ্রনাথ, রূপান্তর)
আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন যে মৃত্যুতে সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। তাই জন্মান্তরবাদে মৃত্যু আপেক্ষিক হলেও, উপনিষদগুলি জুড়ে মৃত্যুর সঙ্গে অমরত্বের এমন মধুর সমন্বয় এত কার্যোপযোগীভাবে ফুটে উঠেছে। মৈত্ৰেয়ী যখন যাজ্ঞবল্ক্যকে বললেন, "যাতে অমর হব না তা দিয়ে আমি কী করব?" তখন তার উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য তাঁকে উপদেশ দিলেন, "ব্যক্তিসত্তাকে বিশ্বসত্তার মধ্যে স্থাপিত করে স্ব-রূপে তাকে জানো; সেই সত্তাই আত্মা, সেইই ব্ৰহ্ম"। এই সেই জ্ঞান, যা মানুষকে অমরত্ব প্রদান করে, নিত্য করে তোলে, সত্য করে তোলে, বলে যে ব্যক্তি-শরীরের নাশ থাকলেও ব্রহ্মের নাশ নেই, ফলে সে শুধু ক্ষণকালীন শরীর-মন-বুদ্ধি নয়, সে চিরকালের - এই বোধই মানুষকে দেবতা করে তোলে।
এইটি জেনে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার দিনে মানুষ আশ্বস্ত হয়ে যেতে পারে যে, নিরবধি কাল ও বিপুলা ধরায় সে অক্ষয়, অমর। এর চেয়ে বড় মুক্তির বার্তা সভ্যতার ইতিহাসে আর কে কবে দিতে পেরেছেন? ঋষি বলছেন,
যদা সর্বে প্রমুচ্যন্তে কামা যে অস্য হৃদি শ্রিতাঃ
অথ মর্তোঽমৃতো ভগবত্যত্র ব্রহ্মা সমশ্নুতে ।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪/৪/৭) এবং তেঽর্চিরভিসম্ভবন্তি (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪/২/১৫) অর্থাৎ যাঁরা হৃদয়ের রােগরূপী সমস্ত জড় বাসনা থেকে মুক্ত হয়েছেন, তাঁরা মৃত্যুকে জয় করে ভগবদ্ধামে প্রবেশ করেন, তাকে বলা হয় সদ্য-মুক্তি। আর যারা অর্চি আদি মার্গে ধীরে ধীরে উচ্চ থেকে উচ্চতর লােক অতিক্রম করে অবশেষে ভগবদ্ধাম প্রাপ্ত হন, তাকে বলা হয় ক্ৰম-মুক্তি। যেভাবেই হোক, মুক্তি কিন্তু অনিবার্য, ফলে শুদ্ধ হও, পবিত্র হও, ধর্মকে ধরে থাকো, যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষ সারা বিশ্বকে এই ঐশ আশ্বাসবার্তাই দিয়ে চলেছে।
No comments:
Post a Comment