বড় অশুভ সময় এখন বাংলার, মানে যে বাংলায় এখনো বাঙালি নাম, বাংলা ভাষা, বাঙালি বেশ, বাঙালি মনিষীদের স্মরন, বাঙালি রান্না ইত্যাদি যা কিছু চিরাচরিতরূপে বাঙালি, তার স্বাদ পাওয়া যায়, সেই পশ্চিমবঙ্গের। অশুভ এই কারণে, যা যা বাঙ্গালিত্বকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত ওপার বাংলায় ঘটছে দেখতে পাচ্ছি, সেই আরবিকরণের রাস্তা প্রশস্ত করতে কিছু প্রাক্তন বাঙালি সীমান্ত পেরিয়ে এসে ইদানিং আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গেও অতিসচেষ্ট। তাদের দাপটে এপারবাংলাও যেন একটা অবক্ষয়ের ঘূর্ণাবর্তে ক্রমশ অচেনা এক প্রদেশ হয়ে উঠছে, ছেলেবেলায় যে বাংলামায়ের রূপ আমরা দেখেছি, উত্তরোত্তর তাঁর হাত আজ কালো দস্তানায়, মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা কেন?
সময়টা অদ্ভুতও বটে। যেদিন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হল, সেদিন কিন্তু বাঙ্গালিত্ব, বাঙ্গালিয়ানা, বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতি কিচ্ছু মাথায় ছিলনা, শুধু পন্থ আর সব কিছু ছাপিয়ে তার সার্বজনীন আধিপত্য। যে যোগেন মণ্ডল সেই বিচ্ছিন্নতাবাদকে আশ্রয় করে একমাত্র বাঙ্গালিত্বের ভরসায় পূর্ব পাকিস্তানে নমঃশূদ্রদের আলাদা পরিচয় তৈরি করে ক্ষমতার দর কষাকষি করতে গিয়েছিলেন, তাঁকেও মন্ত্রিত্ব ছেড়ে কলকাতায় শ্যামাপ্রসাদের বাড়িতে পালিয়ে এসে প্রাণরক্ষা করতে হয়েছিল। তর্কের খাতিরে যদি ধরেওনি যে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে বাঙালি আইডেন্টিটি রক্ষা করার জন্যই পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের আদর্শগত লড়াই, তাহলে বাংলাদেশ আজ আর একটি আরবিস্থানের কিম্ভূতকিমাকার প্রতিরূপ হওয়ার দৌড়ে পাকিস্তানের সঙ্গে তেড়ে পাল্লা দিচ্ছে কেন? কেবল ২১শের আবেগ দিয়ে কি আর দা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিঙ্গের অন্যতম খলনায়ক মুজিবের জাতির জনক হয়ে ছড়ি ঘোরাবার অদম্য ক্ষমতালিপ্সাকে ঢাকা দেওয়া যায়? মুক্তিযোদ্ধাদের জেন্যুইন সেন্টিমেন্টকে মুজিব ব্যবহার করেছিলেন সুকৌশলে, ঐ তরতাজা প্রাণগুলো কিন্তু সত্যিকারের বাঙালি ছিলেন।
এই অদ্ভুত অশুভ অবহে ফিরে আসি আজকের বিভাজিত দুইবঙ্গে। প্রতিটি মননশীল বাঙালি যারা আগামিকাল ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ভাষা দিবসের গান গাইবেন, এপার বাংলায় এবং ওপার বাংলায়, আশাকরি তাঁরা নিজেদের প্রশ্ন করবেন তাঁরা আদপে কতটা বাঙালি? এপারে, কারণ পালিয়ে রক্ষে নেই, বাংলাবিদ্বেষীরা সিঁদ কেটে এখানেও ঘরে ঢুকে নাকে ক্লোরোফর্ম দেওয়ার তোড়জোড় করছে দেখেও আপনারা যারা ভয়ে চোখ বন্ধ করে মটকা মেরে পড়ে আছেন, আপনারা কি নিজেদের জাত্যাভিমান ভুলে যাননি? একই ভুল কোন মূর্খ দুবার করে? আর ওপারেও, কারণ যে বাঙ্গালিত্বকে রক্ষা করার জন্য অতজন টগবগে নিবেদিতপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধা জাত্যাভিমানের বশে নিজেদের সবকিছু আহুতি দিলেন, সেই আইডেন্টিটি বাঁচানোর বদলে, আপনারা যারা তাঁদের বৌদ্ধিক উত্তরাধিকারী, তাঁরা কি করে চুপচাপ রোজ বাঙ্গালিত্বের স্লোপয়সন হওয়া দেখছেন?
আগামীকাল, বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসে, দুই বাংলায় বাঙ্গালিত্ব পুনর্জাগরিত হোক এই প্রার্থনা করি। এই বাংলা অতিশ দীপঙ্করের বাংলা, এই বাংলা চাঁদ বনিকের বাংলা, এই বাংলা বিজয় সিংহের বাংলা, এই বাংলা শ্রী চৈতন্যের, কৃত্তিবাসের, বঙ্কিমচন্দ্রের, ডঃ কাদম্বিনী বসুর, স্বামী বিবেকানন্দের, রাজা রামমোহনের, বিদ্যাসাগরের, রবীন্দ্রনাথের, নজরুলের, সুভাষ বসুর, শ্যামাপ্রসাদের, বেগম রকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের, সৈয়দ মুজতবা আলীর, কাজী আবদুল ওদুদের, হুমায়ুন আজাদের এমন আরো কত গুণীজনের বাংলা। কোন অবস্থাতেই আমাদের সাধের বাংলা যেন এক বিজাতীয় বর্বর অন্ধকারের গহ্বরে তলিয়ে না যায়, আমরা যেন আমাদের গৌরবময় অতীত এবং শক্তিসাধনার উত্তরাধিকার ভুলে আত্মসন্মান খুইয়ে না বসি, আমরা যেন আবার সত্যিকারের বাঙালি হয়ে উঠতে পারি, ভাষা দিবসের প্রাক্কালে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে করজোড়ে সেই প্রার্থনা করি।
No comments:
Post a Comment