Blog Archive

Wednesday, May 11, 2022

হিন্দু মন্দির

আমাদের হিন্দু মন্দিরের একটা পারম্পরিক গঠনশৈলী আছে। সিঁড়ি, তারপর প্রথমে অর্ধমণ্ডপ (porch), তারপর মণ্ডপ (hall), তারপর অন্তরাল (vestibule), আর সবশেষে গর্ভগৃহ বা মূলস্থান (sanctum sanctorum)। বেলুড়মঠের সামগ্রিক গঠনটি কল্পনা করলেই চিত্রটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রথমে পশ্চিমদিকের মুখ্য সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম, তারপর একটা খোলা চাতাল, তারপর সদর দরজা পেরিয়ে বিরাট পিলারওলা হলঘর, তারপর একটা আয়তক্ষেত্রাকার ফাঁকা জায়গা যার দুদিকে দুটি দরজা আর তার সামনে গর্ভগৃহে ঠাকুর পূর্বাশ্য হয়ে শ্বেতপদ্মাসনের ওপর সমাধিস্থ। গঠনটি যেন ঠিক মানুষের শায়িত দেহের মতো - প্রথমে নিম্নাঙ্গ, তার ওপরে পেট, তার ওপরে বুক আর সবার ওপরে মাথা। এই যে সিঁড়ি থেকে গর্ভগৃহ অবধি যাত্রা, এটাই হলো journey of many lifetimes, এ যেন আসলেই এক অনন্তযাত্রা। 

রাস্তা পেরিয়ে নিজের ইচ্ছায় প্রথম যেদিন কেউ মন্দিরের সিঁড়িতে পা দেন, সেইদিন থেকেই কিন্তু তিনি seeker, তাঁর মধ্যে কৌতুহল জেগেছে। কিসের কৌতুহল? না ভেতরে কি আছে একবার দেখি, তা সে মন্দিরেরই হোক বা নিজের। কারো মনে হয় যাই, স্থাপত্য দেখি, কারো মনে হয় মূর্তিটি কেমন দেখে আসি, কারো মনে হয় একবার দেবতার পায়ে মাথা ঠেকালে বেশ হয়, আর কারো বা মনে হয় দেবতার কাছে অধরা কিছু চেয়ে তো দেখি, যদি পেয়ে যাই! মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে চাতালে উঠে ভেতরের দিকে তাকালে সাধারণত একটি ছায়াঘন শান্ত সুশীতল মণ্ডপ নজরে পড়ে। কেউ সোজা ঢুকে পড়েন, কেউ বা একবার উঁকি মেরেই নীচে নেমে যান, যাঁর যেমন ভবিতব্য। এই চাতাল অবধি সবটাই পরিচিত স্বদেশ, মণ্ডপে পা দেওয়া মাত্র কিন্তু অচেনা ভিনদেশের শুরু। ওই যে অর্ধমণ্ডপ আর মণ্ডপের মাঝের কাঠের কারুকার্য করা ভারী দরজাটি, ওটিই হলো immigration gate, ওটি পেরোলেই দেশান্তর।

মণ্ডপ বা হলঘর পেরোনোর journey-টা কিন্তু খুব interesting, কারো খুব কম সময় লাগে, কারো বা অনেকগুলো জীবন। এখানেই প্রথম নিঃশব্দের সাথে পরিচয়, এখানেই প্রথম বাইরের জগৎকে shut-out করতে শেখা, এখানেই প্রথম বহু সাধকের বহুদিন ধরে ধ্যান-জপ-সাধনা-স্বাধ্যায় করার সম্মিলিত শক্তিকে অনুভব করতে পারা, এখানেই প্রথম নিজের মনের ভেতর সুপ্ত প্রশ্নের জেগে ওঠা আর পরিচিতদের কাছে উত্তর খুঁজে না পেয়ে এখানেই প্রথম দেবতার কাছে আত্মসমর্পণ। হলঘরের এক একটা কারুকাজ করা স্তম্ভ যেন প্রার্থনা থেকে নিয়ে আত্মানুসন্ধানের আধ্যাত্মিক যাত্রাপথের এক একটি মাইলফলক। ওই দরজা থেকে অন্তরাল অবধি সফর আসলে বাইরেকে পেছনে ফেলে ধীরে ধীরে অন্তরের দিকে এগোনো, যত এগোবে তত সত্য আর অসত্য অর্থাৎ নিত্য আর অনিত্যের পার্থক্য বোধগম্য হবে আর তত পরিচিত পরিবেশকে অপরিচিত বলে মনে হতে শুরু করবে। এ এক যাত্রা বটে - এই ফুটকয়েকের মধ্যেই মহাকুম্ভ আর তারই ভেতর মহাসঙ্গম।

অন্তরালে পৌঁছে সবাই সাষ্টাঙ্গ, ওখানে কিন্তু এতদিনের এতসব নাটকের একেবারে ইতি। ততদিনে বোঝা হয়ে গেছে যে যা হয়েছে সব তাঁর কৃপাতেই হয়েছে, ভবিষতে যা হবে তাও তাঁর ইচ্ছাতেই হবে, আমি বলে আলাদা করে কোনো বস্তু কিছু নেই, 'আমি' যেমন রসের মধ্যে চিনি বা ফুলের মধ্যে গন্ধ বা বরফের মধ্যে ঠান্ডা। ওই সামনে যাঁকে গর্ভগৃহের মধ্যে দেখছি, তিনি যেমন রেখেছেন, আমিও তেমন রয়েছি। তিনি আমার আরাধ্য আবার আমিও আমার আরাধ্য। তিনি পবিত্র, তাই আমিও পবিত্র। তিনি শাশ্বত, তাই আমিও শাশ্বত। আমি যেমন তাঁকে চোখের সামনে দেখছি, তিনিও তেমনিই আমায় দেখছেন, শুনছেন। তিনি সমুদ্র, আমি তাঁরই জলের ঢেউ হয়ে তাঁরই বুকে উঠছি আবার তাঁতেই মিশে যাচ্ছি। তিনি অপরিবর্তনীয়, আমিও তাই, কারণ মূলে তো সেই একই নোনাজল। কেবল সাময়িকভাবে 'আমি'রূপী এক একটা ঢেউয়ের form তৈরি হচ্ছে আবার নষ্ট হচ্ছে, আবার তৈরি হচ্ছে , আবার নষ্ট হচ্ছে আর এই সাময়িক form-কেই আমি এতদিন গর্ব করে 'আমি' 'আমি' বলে বেড়িয়েছি। মন্দিরের এই অংশটিকে অন্তরাল বলে কারণ এই 'আমি'টুকুই হচ্ছে আমার আর গর্ভগৃহে যিনি অধিষ্ঠান করছেন, দুজনের মধ্যে একমাত্র অন্তরাল।

সাধারণত গর্ভগৃহ বলতে আমরা সূতিকাগৃহ বা অন্তকক্ষ বা আঁতুরঘর বুঝি, যেখানে মায়েরা সন্তান প্রসব করেন। মন্দিরের ক্ষেত্রেও কিন্তু তাই। মাতৃগর্ভে ভ্রুন যেমন ভূমিষ্ঠ হওয়া অবধি মাতৃস্নেহে লালিত পালিত হয়, এখানেও তেমনি আত্মসমর্পণ থেকে নিয়ে আত্মসাক্ষাৎকার পর্য্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটাই এই বিশেষ অন্তকক্ষের যিনি অধিষ্ঠাত্রী, তাঁর কৃপায় ঘটে এবং সাধকের 'আমি' মুছে গিয়ে এক ব্রহ্মজ্ঞানীর জন্ম হয়। অবশ্য গর্ভগৃহ তখনই সন্নিধিঃ হয়ে ওঠে যখন মন্ত্রশক্তির দ্বারা জাগরিত এবং বিধিবৎ নিত্যপূজিত হয়ে দেবতা মৃন্ময়ের মধ্যে চিন্ময়রূপ ধারণ করেন, ওখানে তাঁর সাক্ষাৎ প্রকাশ ঘটে এবং নিয়মিত গুণকীর্তনের আবহে তিনি ওখানে নিত্য বিরাজ করেন। সন্নিধিঃ কারণ এই জায়গা থেকে যে শক্তিপুঞ্জ নিঃসৃত হয়, তা সরাসরি সাধকের বোধকে স্পর্শ করে এবং উৎসের সাথে সাক্ষাৎ সান্নিধ্য বা সামীপ্য সম্ভব করে তোলে। সদ্গুরু জাগ্গি বাসুদেব বিষয়টিকে এইভাবে বর্ণনা করেছেন, "Sannidhi means presence. A Sannidhi establishes an energy presence that naturally takes you to the realm of devotion, where something far bigger than you becomes an experiential reality for you."

হিন্দুর মন্দির জীবন্ত দেবতার বাসস্থান, কোনো সাধারণ প্রার্থনাগৃহ নয়। প্রত্যেকটি মন্দির আসলে এক একটি শক্তিকেন্দ্র (energy source)। আমাদের প্রার্থনা মানে তো খালি চাওয়া, সাধারণত পার্থিব কোনো সাময়িক সুখশান্তি চাওয়া - তার জন্য আবার শক্তিক্ষেত্রের প্রয়োজন কি? নিজের বাড়িতে বসেই তো নিশ্চিন্তে ভিক্ষাবৃত্তি চলতে পারে। মন্দির হলো এক জীবন্ত দেবতার সাথে ভক্ত বা সাধকের আলাপচারিতার পবিত্র সাক্ষাৎস্থল এবং আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিসঞ্চার ও গ্রহণ করার শুদ্ধ পরিকাঠামোও বটে। দেবতা আমাদের অন্তরের মধ্যে আছেন ঠিকই কিন্তু মাঝেমধ্যে যতক্ষণ না তাঁর কায়িক সান্নিধ্যে বসে একমনে তাঁর কথা চিন্তা করতে পারা যায়, ততক্ষণ তাঁকে যেন ঠিক অনুভব করা যায়না - সেইজন্যই মন্দির দরকার। হিন্দু মন্দির মোটেও কোনো হইহট্টগোলের জায়গা নয়, গাড়ি বাড়ি সম্পদ ইত্যাদি চাওয়ার জায়গা তো নয়ই। তাঁর নামজপের মধ্যে দিয়ে তাঁর দরজায় টোকা দেওয়ার জায়গা, ধ্যানের মাধ্যমে তাঁর প্রত্যক্ষ উপস্থিতিকে অনুভব করার জায়গা আর তাঁর অসীম কৃপার জন্য তাঁর সামনে শ্রদ্ধায় ভক্তিতে সতত প্রণত হয়ে গুণকীর্তন করার জায়গা। চাইলেই যিনি ষড়ৈশ্বর্য দিতে পারেন, তাঁর কাছে সামান্য কলাটা-মুলোটা চেয়ে লাভ কি, বিশেষতঃ যেখানে দেহ থেকে দেহাতীত, মুলাধার থেকে সহস্রার আর অজ্ঞান থেকে জ্ঞানলোকে যাত্রার সহযোগী মাধ্যম এই পুণ্যভূমির চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে।

No comments:

Post a Comment