আজ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। বেশ কয়েক ঘন্টা হয়ে গেল ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, রাস্তাঘাট জনশূন্য, পাখিদের ডাকও তেমন শুনতে পাচ্ছি না।কেন জানিনা আমার মন গতকাল বিকেল থেকেই বড় মৃত্যুময়। আসলে গতকালই আরো এক বছর এগিয়ে গেছি মৃত্যুর দিকে, ফলে খালি মনে হচ্ছে আর বেশি সময় নেই - হয়তোবা আর মাত্র পনেরো-কুড়ি বছর, এটুকুর মধ্যে কি সেই চিরকালীন অধরা ক্ষণকালীন হয়ে আমার বোধে, চেতনায় ধরা দেবেন? নাকি এই জীবনটা সত্যিই একেবারে বৃথা যাবে?
রবীন্দ্রনাথ বলছেন,
"পৃথিবীতে সকল বস্তুই আসিতেছে এবং যাইতেছে-- কিছুই স্থির নহে; সকলই চঞ্চল-- বর্ষশেষের সন্ধ্যায় এই কথাই তপ্ত দীর্ঘনিশ্বাসের সহিত হৃদয়ের মধ্যে প্রবাহিত হইতে থাকে। কিন্তু যাহা আছে, যাহা চিরকাল স্থির থাকে, যাহাকে কেহই হরণ করিতে পারে না, যাহা আমাদের অন্তরের অন্তরে বিরাজমান-- গত বর্ষে সেই ধ্রুবের কি কোনো পরিচয় পাই নাই-- জীবনে কি তাহার কোনো লক্ষণ চিহ্নিত হয় নাই? সকলই কি কেবল আসিয়াছে এবং গিয়াছে? আজ স্তব্ধভাবে ধ্যান করিয়া বলিতেছি তাহা নহে-- যাহা আসিয়াছে এবং যাহা গিয়াছে তাহার কোথাও যাইবার সাধ্য নাই, হে নিস্তব্ধ, তাহা তোমার মধ্যে বিধৃত হইয়া আছে। যে তারা নিবিয়াছে তাহা তোমার মধ্যে নিবে নাই, যে পুষ্প ঝরিয়াছে তাহা তোমার মধ্যে বিকশিত-- আমি যাহার লয় দেখিতেছি, তোমার নিকট হইতে তাহা কোনোকালেই চ্যুত হইতে পারে না। আজ সন্ধ্যার অন্ধকারে শান্ত হইয়া তোমার মধ্যে নিখিলের সেই স্থিরত্ব অনুভব করি। বিশ্বের প্রতীয়মান চঞ্চলতাকে অবসানকে বিচ্ছেদকে আজ একেবারে ভুলিয়া যাই।" (বর্ষশেষ)
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে প্রাচীন ভারতের ঋষি মানুষকে অমৃতের পুত্র বলে সম্বোধন করে বলছেন,
‘শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ’ (শ্বেতাশ্বতর-২/৫)।
তিনি আরো বলছেন, মৃত্যুকে অতিক্রম করার পন্থা -
‘বেদাহ্মেতং পুরুষং মহান্তম্ আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
তমেব বিদিত্বাহ্তি মৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহ্য়নায়।।’ (শ্বেতাশ্বতর-৩/৮)।
দেখছি এই দিব্যচেতনার অসামান্য অনুবাদ করছেন আধুনিক ভারতের ঋষি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থে -
‘শোনো বিশ্বজন,
শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ
দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে,
মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে
জ্যোতির্ময়। তাঁরে জেনে, তাঁর পানে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পার, অন্য পথ নাহি’।
দুই যুগ এক হয়ে যাচ্ছে এক অনন্ত অখন্ড বোধের প্রবাহমান ধারায়। কি অপূর্ব, কি অপূর্ব!
উপনিষদে ঋষি প্রার্থনা করছেন,
ওঁ মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ।
মাধ্বীর্ন সন্তোষধীঃ।।
মধু নক্তমুতোপষো মধুমত্পার্থিবং রজঃ।
মধু ধৌরস্তু নঃ পিতা।।
মধুমান্নো বনস্পতির্মধুমাং অস্তু সূর্যঃ।
মাধ্বীর্গাবো ভবন্তু নঃ।। (বৃহদারণ্যক ৬॥৩॥৬॥)
(বায়ু মধু বহন করিতেছে। সমুদ্রসকল মধুক্ষরণ করিতেছে। রাত্রি মধু হউক, ঊষা মধু হউক, পৃথিবীর ধূলি মধুমৎ হউক। যে আকাশ পিতার ন্যায় সমস্ত জগৎকে ধারণ করিয়া আছে তাহা মধু হউক। ঔষধি বনস্পতি সকল মধুময় হউক। সূর্য মধুমান হউক। গাভীরা জগতের জন্য মাধ্বী হউক।)
আর রবীন্দ্রনাথ বলছেন,
"হে বিশ্ববিধাতঃ, আজ আমাদের সমস্ত বিষাদ-অবসাদ দূর করিয়া দাও-- মৃত্যু সহসা যে যবনিকা অপসারণ করিয়াছে তাহার মধ্য দিয়া তোমার অমৃতলোকের আভাস আমাদিগকে দেখিতে দাও। সংসারের নিয়ত উত্থানপতন, ধনমানজীবনের আবির্ভাব-তিরোভাবের মধ্যে তোমার ‘আনন্দরূপমমৃতং’ প্রকাশ করো। কত বৃহৎ সাম্রাজ্য ধূলিসাৎ হইতেছে, কত প্রবল প্রতাপ অস্তমিত হইতেছে, কত লোক-বিশ্রুত খ্যাতি বিস্মৃতিমগ্ন হইতেছে, কত কুবেরের ভাণ্ডার ভগ্নস্তূপের বিভীষিকা রাখিয়া অন্তর্হিত হইতেছে–কিন্তু হে আনন্দময়, এইসমস্ত পরিবর্তনপরম্পরার মধ্যে ‘মধু বাতা ঋতায়তে’, বায়ু মধুবহন করিতেছে, ‘মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ’, সমুদ্রসকল মধুক্ষরণ করিতেছে–তোমার অনন্ত মাধুর্যের কোনো ক্ষয় নাই–তোমার সেই বিশ্বব্যাপিনী মাধুরী সমস্ত শোকতাপবিক্ষোভের কুহেলিকা ভেদ করিয়া অদ্য আমাদের চিত্তকে অধিকার করুক।"
১৯০৫এ পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়ানের পর রবীন্দ্রনাথ ১৭ই পৌষ ১৩১৬ (ইং ১৯১০) তাঁকে উদ্দেশ্য করে একটি গান লিখেছিলেন যেটি পরে গীতাঞ্জলিতে ৫১ নম্বর কবিতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। গানটি হলো:
কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস।
সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো, পাগল ওগো, ধরায় আস।
এই অকুল সংসারে,
দুঃখ-আঘাত তোমার প্রাণে বীণা ঝংকারে।
ঘোরবিপদ-মাঝে
কোন্ জননীর মুখের হাসি দেখিয়া হাস।
তুমি কাহার সন্ধানে
সকল সুখে আগুন জ্বেলে বেড়াও কে জানে।
এমন ব্যাকুল করে
কে তোমারে কাঁদায় যারে ভালোবাস।
তোমার ভাবনা কিছু নাই -
কে যে তোমার সাথের সাথি ভাবি মনে তাই।
তুমি মরণ ভুলে
কোন্ অনন্ত প্রাণসাগরে আনন্দে ভাস।
আমি বহুক্ষণ গানটি গেয়ে বা না গেয়ে গুনগুন করছি কিন্তু একে এতদিন যেভাবে বুঝতাম, আজ যতবার পড়ছি, সেই বোঝার সমস্তটাই কেমন যেন পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। আজ আর খেই পাচ্ছি না, যত এক একটি শব্দবন্ধ ধরে ধরে মনে মনে ব্যাখ্যা করছি তত স্তর থেকে স্তরান্তরে চালে যাচ্ছে ভাবনা, অর্থের নতুন নতুন দিগন্ত খুলে যাচ্ছে। এক একটা যতিচিহ্নর ব্যবহার সম্পুর্ন স্তবকের ব্যঞ্জনা পাল্টে দিচ্ছে, এ যেন বোধের এক অদ্ভুত অনিঃশেষ ধাঁধা। এটুকুই কেবল নিশ্চিতরূপে বুঝছি যে এতদিন কিছুই বুঝিনি আর চোখ দুটো আপনা থেকেই বারেবারে জলে ভরে উঠছে।
আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।
এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা ॥
কত জনম-মরণেতে তোমারি ওই চরণেতে
আপনাকে যে দেব, তবু বাড়বে দেনা ॥
No comments:
Post a Comment