আমি জীবনে প্রথমবার ভোট দিয়েছিলাম ১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনে। এখন যদিও আসনটি দক্ষিণ কলকাতা হয়ে গেছে, আমাদের তখনকার যাদবপুর লোকসভা আসনে বিজেপির প্রার্থী ছিলেন শ্রী উত্তম বসু, নামটা এখনো আমার মনে আছে। সিপিএমের প্রার্থী ছিলেন শ্রীমতি মালিনী ভট্টাচার্য, উনিই জিতেছিলেন। সেবার বিজেপি পেয়েছিল ১২০টি আসন আর সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়েও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন শ্রী পি ভি নরসিংহ রাও।
তার পরপরেই আমি দিল্লি চলে যাই এবং দ্বিতীয়বার লোকসভায় ভোট দিই ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে। সেবার আমাদের দক্ষিণ দিল্লির আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন শ্রীমতি সুষমা স্বরাজ, হারিয়েছিলেন কংগ্রেসের শ্রী কপিল সিব্বলকে। সেইবারই অটলজীর প্রধানমন্ত্রীত্বে বিজেপি তথা NDAর প্রথম তেরোদিনের সরকার গঠিত হলো, তারপর তো দেবেগৌড়া গুজরাল ইত্যাদি খিচুড়ি পাকিয়ে যা তামাশা হলো সেটা কোনো গণতন্ত্রের পক্ষেই খুব একটা ভালো বিজ্ঞাপন নয়।
ইতিমধ্যে অবশ্য ১৯৯৩ সালে প্রথমবার দিল্লি বিধানসভার নির্বাচন হলো, তাতেও ভোট দিলাম। আমাদের কালকাজি বিধানসভা আসনে জিতেছিলেন বিজেপির শ্রীমতি পূর্ণিমা শেঠি আর দিল্লি সরকারে তার পরের পাঁচ বছরে বিজেপির পক্ষ থেকে তিনজন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন - প্রথমে শ্রী মদন লাল খুরানা, তারপর শ্রী সাহেব সিং ভার্মা আর ১৯৯৮ এর নির্বাচনের ঠিক আগে আগেই মাসকয়েকের জন্য শ্রীমতি সুষমা স্বরাজ। এরপর যখন ১৯৯৮ সালে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন হয়, ১৩ মাসের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অটলজী আবার ফিরে আসেন, আমি তখন দেশের বাইরে। ওই ১৯৯৮ সালেই দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনও হয়েছিল, আমি সেবারও বিদেশে।
এরপরের লোকসভা নির্বাচন ১৯৯৯ সালে, আমরা থাকি পূর্ব দিল্লিতে কিন্তু আমাদের ভোটার কার্ড তখনো দক্ষিণ দিল্লির, ব্যস্ততার জন্য ঠিকানা পাল্টানো হয়নি। ভোটের দিন ভোট দিতে গিয়ে দেখি ভোটার লিস্ট থেকে নাম কেটে দিয়েছে। মনে আছে খুব রেগে গিয়েছিলাম কিন্তু চেঁচামেচি করেও কোনো ফল হয়নি। সেবার দক্ষিণ দিল্লি থেকে কে যে বিজেপির বিজয়ী প্রার্থী ছিলেন তা এখন আর মনে নেই, সম্ভবত শ্রী বিজয় কুমার মালহোত্রা কারণ সেবার মাত্র কয়েকদিনের নোটিসে শ্রীমতি সুষমা স্বরাজ কর্ণাটকের বেল্লারি থেকে শ্রীমতি সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছিলেন এবং হেরে গেলেও বিপক্ষকে যথেষ্ট বেগ দিয়েছিলেন।
যাইহোক, তারপর নয়ডায় থাকাকালীন ইউপিতে ভোট দিয়েছি, ফরিদাবাদে থাকাকালীন হরিয়ানায় ভোট দিয়েছি আর কলকাতায় ফিরে আসার পর থেকে, অর্থাৎ ২০০৭এর পর থেকে তো পশ্চিমবঙ্গেই সব স্তরে ভোট দিয়ে চলেছি, যদিও এখানে যাঁদের ভোট দিয়েছি তাঁরা কেউই নির্বাচিত হননি। শেষবার ভোট দিয়েছি ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বেহালা পশ্চিম আসনের এমন একজন থার্ড ক্লাস প্রার্থীকে, যাঁর নাম মুখে আনতেও লজ্জা করে, যদিও লজ্জাটা আসলে হওয়া উচিত তাঁদের যাঁরা তাঁকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। আমার ব্যক্তিগত ভোটের ইতিহাসের এত বড় গৌরচন্দ্রিকা করার কারণ হলো এই - আজকেই মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগছিলো যে এই যে ৩০-৩২ বছর ধরে ক্রমাগত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভোট দিয়ে যাচ্ছি, তাও আদর্শ মেলে এমন একটাই দলকে ভোট দিয়ে যাচ্ছি, দেশে তার কোনো positive effect কি দেখতে পেলাম?
হ্যাঁ পেলাম। অবশ্যই পেলাম। প্রথম হলো একটা ব্যক্তিগত বৌদ্ধিক অন্তর্বেদনা থেকে মুক্তি। কি সেই বেদনা? ১২০ আসন পাওয়ার পর, আহা রে, আরো কিছু বেশি মানুষ যদি আমাদের আদর্শ এবং দিশাকে একটু ভালোভাবে বুঝতেন তাহলে আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গড়তে পারতাম আর দেশকে বেপথ থেকে সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য যা যা করার দরকার, সব করতে পারতাম। তার পরেরবার ১৮২ আসন পাওয়ার পর বেদনা - মানুষ আশীর্বাদ দিলেন কিন্তু কেন যে ছাই পুরোটা দিলেন না, এবারেও ওই পাঁচভূতের চাপে আসল কাজ কিছুই করা যাবে না। তারপর অত বড় golden quadrilateral বানানো ও কার্গিলের যুদ্ধ জেতার পরেও অপ্রত্যাশিতভাবে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার চরম বেদনা - ব্যস সব আশা বুঝি শেষ হয়ে গেল! ২০১৪তে এই নিয়মিত যন্ত্রণার অবসান হয়েছে, দশ বছর পেরিয়ে গেছে এবং অন্তত আগামী দুদশকের জন্যেও নিশ্চিন্ত আর ততদিনে দেশের যা ভালো হওয়ার সবটাই হয়ে যাবে। যত দেশ এগোবে তত শত্রুদের শক্তিক্ষয় হবে এবং শেষে একেবারে নির্বিষ হয়ে পড়বে, এটাও কম পাওয়া নয়।
দ্বিতীয় হলো সব জেনেও কিছু না করতে পারার অসহায়তা থেকে মুক্তি। চোখের সামনে দেখছি ব্রাউন সাহেবরা বাচ্চাদের কেবল হেরে যাওয়ার ইতিহাস পড়াচ্ছে, আমাদের নিজেদের সংস্কৃতিকে হেয় করে বিজাতীয় সংস্কৃতিকে মূল্য দিতে শেখাচ্ছে, একশ্রেণীকে তোষামোদের চূড়ান্ত করে তাদের মধ্যে নতুন করে আবার একটা অদ্ভুত false sense of entitlement তৈরি করে দেশের ভবিষ্যতকে চরম বিপাকে ফেলছে, বিজাতীয় ভাবধারা আর বিদেশি পণ্যকে প্রাধান্য দিয়ে দেশীয় enterpriseকে শেষ করে দিচ্ছে, কিছুতেই সোভিয়েত অর্থনীতির লেগেসি বজ্রআঁটুনির ভূতকে ঘাড় থেকে নামাতে পারছে না - কিন্তু কিছুই করার নেই। আজকে ওই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই corrective action নেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে এবং খুব দ্রুত সেই পরিবর্তনের প্রভাব সমাজে পরিলক্ষিতও হচ্ছে, এটা খুবই তৃপ্তিদায়ক।
তৃতীয় হলো ভারতীয় হিসেবে যে যে বিষয়ে গর্বিত হওয়া উচিত, সেগুলো নাকচ হয়ে যেতে দেখে শুধুই হাত কামড়ানো। ভারতীয় অস্মিতা ও শৌর্যবীর্য্যের চিহ্ন বহনকারী ভূলুণ্ঠিত প্রতীকের পুনির্নির্মাণ করা, ঔপনিবেশিক ইতিহাসের বদলে ভারতের গৌরবগাথা - চোলা, চৌহান, অহম ও মারাঠাদের ইতিহাসকে প্রাধান্য দেওয়া, এক প্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকারী হিসেবে অধিকাংশ ভারতীয়দের আস্থা যেখানে যেখানে জড়িত সেই স্থানগুলির কেবল সংরক্ষণ নয়, তার পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করা, ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হিসেবে গর্ববোধ করানোর রাস্তা খুলে দেওয়া এবং প্রাচীন ভারতীয় দর্শন, তার value system, তার উৎকর্ষকে আজকের জীবনে প্ৰতিষ্ঠা করা - কিছুই তো হতো না, এখন হচ্ছে। এখন যখন নতুন শিক্ষানীতি দেখি, যখন অযোধ্যা বা কাশীর দিকে তাকাই, যখন ধারা ৩৭০ ও ৩৫এ সরে যাওয়ার পর কাশ্মীরে smart city তৈরি হতে দেখি, যখন শুনি যে CAA লাগু হবে, NRC হবে, UCC হবে, তখন মনে হয় বৈকি যে একদম ঠিক দিকে চলছে আমার দেশ।
চতুর্থ হলো সর্বোচ্চ পর্যায়ে ভয়ানক চুরি দেখেও তাকে আটকাতে না পারার যন্ত্রণা। বফোর্স স্ক্যাম, 2G, 3G স্ক্যাম, কমনওয়েলথ গেমস স্ক্যাম, কয়লাখনি বন্টন স্ক্যাম, হেলিকপ্টার স্ক্যাম, কেন্দ্র ১ টাকা পাঠালে গরিবের হাতে মাত্র ১৫ পয়সা পৌঁছনো - আরো কত কত দুর্নীতি - যে যেখান থেকে পারছে দেশের টাকা লুট করে নিয়ে চলে যাচ্ছে আর নেতা রেনকোট পরে স্নান করছেন! বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তাটাই বন্ধ হয়ে গেছে এখন। না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা। পুরো তালা পরে গেছে কেন্দ্রীয় সরকারের upper level corruptionএ, এবার জোরকদমে রাজ্যগুলিতেও চোর ধরার কাজ শুরু হয়েছে প্রতিটি স্তরে। কত আমলার চাকরি গেছে আর কত দুর্নীতিবাজ যে ভয়ে সিঁটিয়ে আছে, তার ইয়ত্তা নেই। ভালো লাগছে দেখে। এখন JAM খেল দেখাচ্ছে, এখন শুধুই direct cash transfer, সমস্ত পেমেন্ট ধীরে ধীরে ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে, শক্ত শক্ত আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, নে কিভাবে চুরি করবি এবার করে দেখা!
সবচেয়ে বড় কথা হলো এখন একটা স্পষ্ট দিশা দেখতে পাচ্ছি - দেশ কোনদিকে যাচ্ছে সে বিষয়ে আর কোনো ambiguity নেই। ভারত তো আর ইংরেজের India নয়, ভারত হলো হিন্দু সভ্যতার ধাত্রীভূমি, সিকন্দরের সাথে মেগাস্থেনিস আসার এবং হেরে ফিরে যাওয়ার অনেক আগেই এই সভ্যতার হিন্দু নামকরণ হয়ে গিয়েছিল। এই ভূমি সভ্যতার আদিভূমি, যে সভ্যতা বিশ্বকে শূন্য দিয়েছে, পাই-এর value দিয়েছে, সূর্য্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের মাপ দিয়েছে, প্লাস্টিক সার্জারি সহ শল্যচিকিৎসা দিয়েছে, dentistry দিয়েছে, আয়ুর্বেদ দিয়েছে, যোগ দিয়েছে, flush toilet দিয়েছে, ২ মিলিমিটারের ভাগ ওলা ruler দিয়েছে, পিথাগোরাসের অনেক আগেই পিথাগোরিয়ান থিওরাম দিয়েছে, ত্রুসিবেল স্টিল দিয়েছে, সর্বোপরি ভারতীয় দর্শনসমূহ দিয়েছে, আরো কত কিই। আমাদের ভাণ্ডারে গচ্ছিত নিজেদের পারিবারিক সম্পদ ছেড়ে আমরা ভিখারির মতন পরের সম্পদের পেছনে এতদিন ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, সেটা অবশেষে বন্ধ হয়েছে।
আমাদের দেশীয় উৎপাদন বাড়ছে, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে সরকারের আয় বাড়ছে, অবকাঠামোয় বিনিয়োগ বিপুল পরিমাণে বাড়ছে, ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বাড়ছে, প্রতিদিন আমরা অর্থনৈতিকভাবে এবং সামরিকভাবে আরো শক্তিশালী হচ্ছি এবং ধীরে ধীরে আত্মনির্ভরও হয়ে উঠছি। দেশে দারিদ্র কমছে, অশিক্ষা কমছে, ধীরে ধীরে একটা welfare stateএর রূপরেখা দেখা যাচ্ছে, না খেতে পেয়ে আর কেউ মরে না, আমাদের পাসপোর্টের কদর বাড়ছে, renewable energyর ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, export বাড়ছে, ব্যাঙ্কগুলো পোক্ত হচ্ছে, আমরা রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকমুক্ত বিষমুক্ত কৃষির দিকে ঝুঁকছি, সারা বিশ্বজুড়ে ভারত নেতৃত্বের জায়গায় উঠে আসছে, আরো কতকিছুই না হচ্ছে।
জনজীবনে সংস্কৃত ফিরে আসছে, সংস্কার ফিরে আসছে, সেঙ্গোল ফিরে আসছে। যত আমরা নিজেদের সত্যিকারের ইতিহাসকে জানতে পারছি তত আমরা নিজেদের অতীতের গৌরবকে উপলব্ধি করছি আর তত আমাদের জিদ চেপে যাচ্ছে যে তার থেকে আরো গৌরবময় ভবিষ্যত আমরা বানিয়ে দেখাবোই। এই দেশকে ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়া থেকে আটকাবে, এমন সাধ্য কার? তাই যতদিন শরীর দেবে ততদিন নিজের ভোটটা ঠিক জায়গাতেই দিয়ে যাবো কারণ আমি নিজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সার কথা এই বুঝেছি যে democracy indeed delivers if one votes right.
No comments:
Post a Comment