তিনটি মাত্র শব্দ উচ্চারিত হলো, "তোমাদের চৈতন্য হোক", আর গোটা দুনিয়ার আত্মঅন্বেষী অনন্বেষী সকলের ভবিষ্যৎটি চিরকালের জন্য নির্ধারিত হয়ে গেল, আধাত্ম পথে না এগোনোর উপায়ন্তরটিই আর রইলো না। আপাতদৃষ্টিতে এটি একজন কর্কট রোগাক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী কপর্দকশূন্য মানবদেহী গুরুর শেষ আশীর্বচন, কিন্তু সত্যিই কি তাই? যদি তাই হতো তাহলে আকন্ঠ জ্ঞানতৃষ্ণা নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের স্মৃতিবিজড়িত প্রতিটি স্থানে আজ লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নামতো কি? কিসের আশায় তাঁরা কত দূর দূর থেকে কত কষ্ট করে দলে দলে আসেন, কেন বছরের পর বছর পয়লা জানুয়ারিতে কাশিপুরে, দক্ষিণেশ্বরে, বেলুড়ে, কামারপুকুরে, বলরাম বাটিতে, সারা বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মন্দিরে তাঁরা ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন দেন - for nothing? এটি আসলে এক ঈশ্বরকল্প পুরুষের পরম আশ্বাসবচন, an ultimate declaration - 'কেন তুমি বোধ বুদ্ধি বিবেকযুক্ত মানবশরীর পেয়েছ, সেটা কোনো না কোনো জন্মে ঠিকই বুঝতে পারবে আর তারপর তোমার final destination-ও তুমি ঠিক খুঁজে পাবে, আমি আশীর্বাদ করছি'।
তিনটি শব্দের প্রথম শব্দটি "তোমাদের"। লক্ষণীয় যে এটি বহুবচন এবং direct। যখন 'তোমাদের' বলছেন তখন কি কেবল সেদিন কাশিপুরের বাগানে ওঁর চোখের সামনে যাঁরা আছেন, তাঁদের কথা বলছেন? যিনি সারা পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে সনাতন ধর্মের পথ দেখাতে এসেছেন (যার নিদর্শন এখন আমরা সারা বিশ্ব জুড়ে নানা ভাষাভাষী, নানা বর্ণের, নানা পন্থের মানুষের তাঁর এবং বেদান্তের প্রতি যথাক্রমে অনুরাগ এবং অনুসন্ধিৎসা থেকে দেখতে পাই), তিনি কেবল গুটিকতক ভক্তকে address করবেন, এও কি সম্ভব? ভুলে গেলে চলবে না যে যে ঠাকুর একদিন সমাধিভঙ্গ হওয়ার পর বলেছিলেন যে তিনি দেখলেন অনেক দূরের দেশে কিছু সাদা সাদা মানুষ তাঁর ছবিকে পুজো করছে, সেই তিনি কি নিজেকে কেবল একটি বাগানেই আবদ্ধ রাখবেন? হয় কখনো? এই প্রসঙ্গে দ্বিতীয় বিষয় হলো কাল অর্থাৎ সময়। শ্রীরামকৃষ্ণ দেশ কালের অতীত, তিনি ত্রিগুনাতীত, অনন্তের messenger, জগৎগুরু। তিনি সমস্ত মানুষকে আলো দেখাতে এসেছেন, ফলে তাঁর কথাগুলো কখনোই একটি বিশেষ কালখণ্ডে সীমিত নয়। তাই ওনার মুখে 'তোমাদের' শুধুমাত্র বর্তমানে restricted নয়, তা ভবিষ্যতের সমস্ত প্রজন্মকেও address করে। মোদ্দা কথা, এই 'তোমাদের' মানে সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এবং তাঁর সময়ের সমস্ত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মও বটে, যার মধ্যে আমি আপনি সবাই পড়ি।
দ্বিতীয় শব্দটি হলো "চৈতন্য"। এই শব্দটি বেশ মজার। সাধারণত এর তিন রকমের মানে হয়, ১ হুঁশ, সংজ্ঞা, বাহ্যজ্ঞান (আঘাত পেয়ে চৈতন্য হারাল); ২ বোধ, চেতনা, অনুভূতি (কবে আর তোমার চৈতন্য হবে?); ৩ টিকি। কিন্তু হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর iconic বঙ্গীয় শব্দকোষে চৈতন্যের অর্থ করেছেন, ১ চেতনভাব, চেতনা, জ্ঞান, বুদ্ধি; ২ (বেদান্তে) চিৎস্বরূপ পরমাত্মা; ৩ (ন্যায়ে) আত্মরূপ চেতনা; ৪ প্রকৃতি। এই প্রত্যেকটি মানে যদি আমরা contextually ভাবি, তাহলে ন্যায়শাস্ত্রের মানেটিই বোধহয় এখানে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী, 'চৈতন্য' অর্থাৎ সেই জ্ঞান বা 'আত্মরূপ চেতনা'র উন্মেষ ঘটায়, যাকে শঙ্কর বলেছিলেন 'আত্মবোধ'। কি সম্পর্কে চেতনা? না প্রত্যেক মানুষের অন্তরে সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম বাস করেন এবং সেই বোধ জাগলে সে তার আত্মপরিচয় উপলব্ধি করে, যাকে বেদান্তশাস্ত্রে মহাবাক্য হিসেবে 'অহম ব্রহ্মাস্মি' (বৃহদারণ্যক উপনিষদ্, যজুর্বেদ, ১.৪.১০) বা 'অয়ং আত্মা ব্রহ্ম' (মাণ্ডুক্য উপনিষদ্, অথর্ববেদ, ১।২), 'আমিই ব্রহ্ম' বলা হয়েছে।
এরপর আসি শেষ শব্দটিতে, "হোক"। 'হবে' নয় কিন্তু, 'হোক'। অর্থাৎ ভবিষ্যৎবাণী নয়, ইচ্ছার প্রকাশ বা আশীর্বাদ। উনি ওই জায়গায় একবার 'হবে' বললেই কেল্লাফতে হয়ে যেত। কাউকে আলাদা করে আর কোনো চেষ্টাই করতে হতো না, আত্মবোধ জাগরণের ভার উনি ওঁর নিজের ওপরই নিয়ে নিতেন, কিছু না করলেও সবাই তরে যেতো, তা সে জন্ম জন্ম ধরে যত খারাপ কর্মফলই জড়ো করে থাকুক না কেন - মুড়ি মিছড়ি সব একদর হয়ে যেত। তাই সেটা কিন্তু বললেন না, বললেন 'হোক' - মানে 'চেষ্টাটি তোমাকেই করতে হবে, কিন্তু করলে যে নিশ্চিত ফল পাবে, সেই আশীর্বাদ আমি তোমায় করলাম'। একটি কথা কম নয়, একটি কথাও বেশি নয়, - একেবারে precise, to the point, unambiguous, সোজাসাপ্টা। এবারে প্রশ্ন উঠতেই পারে, যদি আমি চেষ্টা না করি তাহলে কি আমার চৈতন্য হবেনা? এখানেই আসল catch। যেহেতু এটি একজন অবতার পুরুষের আশীর্বাদ, পুরুষ-প্রকৃতি যতই মায়ার খেলা খেলুন না কেন, কারো সাধ্য নেই যে তা বিফলে যায়। ফলে this is a statement of fact, not just of hope - আত্মোপলব্ধির চেষ্টা করিয়েই ছাড়বে। প্রারব্ধ আর কর্মফলের ওপর নির্ভর করে হয়তো কারো কয়েকটি বেশি জন্ম লাগবে, কারো হয়তো কিছু কম, কিন্তু প্রত্যেক মানুষের ভেতর একদিন না একদিন সেই পরমাত্মার আলোর উন্মেষ ঘটবেই, কল্পতরুরূপী গরিব বামুনের কথা কখনো মিথ্যা হতে পারেনা।