জনচেতনা অনুযায়ী, নবরাত্রির অষ্টম দিন বা ‘অষ্টমী’ বোধহয় দুর্গাপূজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে দেবী দুর্গার অস্ত্রগুলিকে দেবজ্ঞানে অর্ঘ্য প্রদান করা হয় কারণ দেবগণ নানা অস্ত্র প্রদানের মাধ্যমে এই মহাষ্টমী তিথিতেই দেবীকে রণসাজে সাজিয়ে তুলেছিলেন। এই দিনটিকে বীরাষ্টমীও বলা হয়। আবার ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই দিনটিতে ‘অস্ত্র পূজা’ করা হয়, যেমন উত্তর ভারতে বিজয়া দশমীর দিনে। এদিন দেবী রাজরাজেশ্বরী মূর্তি ধরে দু’হাতে বর দেন ভক্তদের তাই বাঙালিরা যেমন অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে উন্মুখ, বীর সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে এই বিশেষ তিথিতেই বীরাষ্টমী ব্রত পালন করেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মহিলারা। এদিন দেবী মহাগৌরীরূপা বৈষ্ণবী শক্তি।
ব্রিটিশ জমানায় দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে মাতৃভূমিকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করার সংগ্রামকে অসুরনাশ ও শুভশক্তির উদয়সূচক বিপ্লবের সাথে মিলিয়ে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার করে তুলেছিলেন আমাদের বীর বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। সেইসময়ই বিভিন্ন কুস্তির আখড়ায় দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু হয়। সেসময় অষ্টমী তিথিতে আখড়ায় আখড়ায় এবং দুর্গামণ্ডপে কুস্তি প্রদর্শিত হত এবং বাঙালি ভিড় করে দেখতো। একইসঙ্গে এই দিনে বীরদের সম্মান জানানোরও রেওয়াজ ছিল। কিন্তু যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে অষ্টমীর সাথে বীরত্বের কি সম্পর্ক। থিমের ঠেলায় আর দেবীর আরাধনাকে সামাজিক উৎসবে পর্য্যবসিত করার তাগিদে বাঙালি অস্ত্রপূজার রীতিও আজ হারিয়ে ফেলেছে।
বাঙালি হিন্দু যে একসময় অস্ত্র ধরতে পারত, অস্ত্র নিয়ে প্রবল তেজে যুদ্ধ করতে পারত, সেকথা আজ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বীরাষ্টমী সম্পর্কে তাই বর্তমান প্রজন্ম অজ্ঞান। তারা হয়তো জানেও না যে বাঙ্গালী হিন্দুরা কেন এককালে ছড়া বেঁধেছিল 'আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে। ঢাঁই মিরগেল ঘাঘর বাজে॥' বাঙালি এককালে যেমন গাজা বাজা বাজিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধে যেত, তেমনিই নিজেদের শারীরিক ও মানসিক শক্তি বজায় রাখতে পাল্লা দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় লাঠি আর তলোয়ারও খেলত, আজকের মতন রাজনীতির ধামা ধরে ফোকটে সুবিধা আদায়ের ফিকির খুঁজতো না।
পরম পূজনীয় ডাক্তারজির সময়ের রাইফেল অনুশীলন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও বহুকাল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শাখাগুলিতে তলোয়ার খেলা প্রচলিত ছিল, এখন সেখানেও নাকি কেবল লাঠি বা কাঠের তলোয়ার ব্যবহার হয় বলে শুনেছি। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রাচীন রীতি যাঁরা আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ভারত সেবাশ্রম সংঘ। এছাড়া উত্তর কলকাতার বাগবাজার সার্বজনীনেও পালিত হয় বীরাষ্টমী ব্রত। অনুশীলন সমিতি খ্যাত পুলিন বিহারী দাস যতদিন শারীরিকভাবে সক্ষম ছিলেন, ততদিন তাঁর উপস্থিতিতেই বাগবাজারে এই ব্রত পালিত হতো, এখনো হয়, তবে ধীরে ধীরে বাঙালিদের মধ্যে লাঠি আর অস্ত্র ধরার লোকের সংখ্যা কমে আসছে।