Saturday, October 21, 2023

বীরাষ্টমী

জনচেতনা অনুযায়ী, নবরাত্রির অষ্টম দিন বা ‘অষ্টমী’ বোধহয় দুর্গাপূজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে দেবী দুর্গার অস্ত্রগুলিকে দেবজ্ঞানে অর্ঘ্য প্রদান করা হয় কারণ দেবগণ নানা অস্ত্র প্রদানের মাধ্যমে এই মহাষ্টমী তিথিতেই দেবীকে রণসাজে সাজিয়ে তুলেছিলেন। এই দিনটিকে বীরাষ্টমীও বলা হয়। আবার ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই দিনটিতে ‘অস্ত্র পূজা’ করা হয়, যেমন উত্তর ভারতে বিজয়া দশমীর দিনে। এদিন দেবী রাজরাজেশ্বরী মূর্তি ধরে দু’হাতে বর দেন ভক্তদের তাই বাঙালিরা যেমন অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে উন্মুখ, বীর সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে এই বিশেষ তিথিতেই বীরাষ্টমী ব্রত পালন করেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মহিলারা। এদিন দেবী মহাগৌরীরূপা বৈষ্ণবী শক্তি।

ব্রিটিশ জমানায় দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে মাতৃভূমিকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করার সংগ্রামকে অসুরনাশ ও শুভশক্তির উদয়সূচক বিপ্লবের সাথে মিলিয়ে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার করে তুলেছিলেন আমাদের বীর বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। সেইসময়ই বিভিন্ন কুস্তির আখড়ায় দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু হয়। সেসময় অষ্টমী তিথিতে আখড়ায় আখড়ায় এবং দুর্গামণ্ডপে কুস্তি প্রদর্শিত হত এবং বাঙালি ভিড় করে দেখতো। একইসঙ্গে এই দিনে বীরদের সম্মান জানানোরও রেওয়াজ ছিল। কিন্তু যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে অষ্টমীর সাথে বীরত্বের কি সম্পর্ক। থিমের ঠেলায় আর দেবীর আরাধনাকে সামাজিক উৎসবে পর্য্যবসিত করার তাগিদে বাঙালি অস্ত্রপূজার রীতিও আজ হারিয়ে ফেলেছে।

বাঙালি হিন্দু যে একসময় অস্ত্র ধরতে পারত, অস্ত্র নিয়ে প্রবল তেজে যুদ্ধ করতে পারত, সেকথা আজ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বীরাষ্টমী সম্পর্কে তাই বর্তমান প্রজন্ম অজ্ঞান। তারা হয়তো জানেও না যে বাঙ্গালী হিন্দুরা কেন এককালে ছড়া বেঁধেছিল 'আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে। ঢাঁই মিরগেল ঘাঘর বাজে॥' বাঙালি এককালে যেমন গাজা বাজা বাজিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধে যেত, তেমনিই নিজেদের শারীরিক ও মানসিক শক্তি বজায় রাখতে পাল্লা দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় লাঠি আর তলোয়ারও খেলত, আজকের মতন রাজনীতির ধামা ধরে ফোকটে সুবিধা আদায়ের ফিকির খুঁজতো না। 

পরম পূজনীয় ডাক্তারজির সময়ের রাইফেল অনুশীলন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও বহুকাল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শাখাগুলিতে তলোয়ার খেলা প্রচলিত ছিল, এখন সেখানেও নাকি কেবল লাঠি বা কাঠের তলোয়ার ব্যবহার হয় বলে শুনেছি। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রাচীন রীতি যাঁরা আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ভারত সেবাশ্রম সংঘ। এছাড়া উত্তর কলকাতার বাগবাজার সার্বজনীনেও পালিত হয় বীরাষ্টমী ব্রত। অনুশীলন সমিতি খ্যাত পুলিন বিহারী দাস যতদিন শারীরিকভাবে সক্ষম ছিলেন, ততদিন তাঁর উপস্থিতিতেই বাগবাজারে এই ব্রত পালিত হতো, এখনো হয়, তবে ধীরে ধীরে বাঙালিদের মধ্যে লাঠি আর অস্ত্র ধরার লোকের সংখ্যা কমে আসছে।

Friday, October 20, 2023

নবপত্রিকা

যাঁরা মনে করেন নবরাত্রি অবাঙালিদের আর দুর্গাপূজা বাঙালিদের অনুষ্ঠান, তাঁরা নিশ্চয় আজ সপ্তমীর পূজার শুরুতেই নবপত্রিকার স্নান ও স্থাপনা দেখেছেন। আসলে ইনি হলেন নয়টি গাছ বা উদ্ভিদ - 
রম্ভা কচ্চী হরিদ্রাচ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িম্বৌ
অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা।
অর্থাৎ, রম্ভা (কলা), কচ্চী (সাধারণ কচু), হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী (একটি ভেষজ উদ্ভিদ যার আয়ুর্বেদিক নাম নাদেয়ী), বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মানকচু ও ধান মিলিয়ে হলেন নবপত্রিকা, যাঁদের শ্বেত অপরাজিতার লতা দিয়ে একসাথে বেঁধে দুটি বেল সহ কাপড় ও সিঁদুর পরিয়ে গণেশের পাশে স্থাপন করা হয়। অনেকেই মনে করেন নবপত্রিকা বা প্ৰচলিত ভাষায় কলা বউ নাকি গণেশের স্ত্রী, আসলে মোটেও তা নয়। 

এই নয়টি গাছ বা উদ্ভিদ হলেন মা দুর্গারই নয়টি রূপের প্রতীক। বলা হচ্ছে -
রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা, ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী।
অর্থাৎ, কলা গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী;
সাধারণ কচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কালিকা;
হলুদ গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী উমা;
জয়ন্তী গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কার্তিকী;
বেল গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শিবা;
ডালিম গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা;
অশোক গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শোকরহিতা;
মানকচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী চামুণ্ডা;
ধান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মী।

কি, নবরাত্রির সঙ্গে বাংলার দুর্গাপূজার সম্পর্ক নেই? নবরাত্রির নয়টি দিনের প্রতিদিন মাকে তাঁর এই নয়টি রূপের এক একটি রূপ ধরে ধরেই তো আরাধনা করা হয়, অন্য কিছু তো নয়।

Tuesday, October 17, 2023

চতুর্থী

আজ চতুর্থী - মৃন্ময়ী মূর্তিতে মা হয় অধিকাংশ পূজাস্থলে ইতিমধ্যেই এসে পৌঁছিয়েছেন অথবা আজ পৌঁছবেন। আজ আর আগামীকাল বাড়ি বা আবাসনের পুজোগুলোতে মাকে খুব করে সাজানো গোজানো হবে, তারপর ষষ্ঠীতে সকালে কল্পারম্ভ আর বিকেলে বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের পর মা তাঁর চিন্ময়ীরূপ ধারণ করবেন। 

এই তো মাত্র শতখানেক বছর আগেও এই মহাশক্তি জগজ্জননী মহামাঈ মানুষের শরীর ধারণ করে বহুবছর প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনে ছিলেন, তাই স্বামীজী শ্রীশ্রীমাকে বলতেন জ্যান্ত দুর্গা। এখনও মা সূক্ষ্মশরীরে বিদ্যমানা, তাই বেলুড় মঠে দুর্গা পূজার সংকল্প মায়ের নামেই করা হয়। মা এখন ইষ্টরূপে ভক্তের হৃদয়ে বাস করেন। 

শ্রীশ্রীমায়ের কথা বইটির ১৯০ পৃষ্ঠায় স্বামীজী আর মায়ের একটি অসাধারণ সরস কথোপকথনের উল্লেখ আছে, যার গভীরতা সীমাহীন। স্বামীজী একদিন মাকে বলছেন, "মা, আমার আজকাল সব উড়ে যাচ্ছে।" মা হেঁসে বললেন, "দেখো দেখো, আমাকে কিন্তু উড়িয়ে দিও না!" তখন স্বামীজী মহাব্যস্ত হয়ে উত্তর দিচ্ছেন, "মা, তোমাকে উড়িয়ে দিলে থাকি কোথায়? যে জ্ঞানে গুরুপাদপদ্ম উড়িয়ে দেয় সে তো অজ্ঞান। গুরুপাদপদ্ম উড়িয়ে দিলে জ্ঞান দাঁড়ায় কোথায়?" 

এটি তো কেবল একজন শিষ্য ও গুরুপত্নীর মধ্যে কথোপকথন নয়, এক ব্রহ্মজ্ঞ মহর্ষি এবং পরমাপ্রকৃতির মধ্যে, ভক্ত আর ভগবানের মধ্যে আর শিষ্য ও সদগুরুর মধ্যে চিরকালীন সম্বন্ধের একটি অনবদ্য দলিল, যার প্রত্যেকটি শব্দের মধ্যে গভীর দর্শন লুকিয়ে রয়েছে। 

স্বামীজী বলছেন, মা, আজকাল সব উড়ে যাচ্ছে - এর অর্থ কি? বোধের এমন এক সীমায় স্বামীজী তখন অবস্থান করছেন যে এই শরীর, এই পার্থিব জগৎ, মায়ার বন্ধন ইত্যাদি কোনো কিছুই আর তাঁকে ধরে রাখতে পারছে না, তিনি যে সত্যি সত্যিই অজড় অমর আত্মা, এই ব্রহ্মজ্ঞান তাঁর মধ্যে মূর্তরূপ ধারণ করে তখন সর্বক্ষণ বিরাজমান। 

স্বামীজীর 'বাঙাল' শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর লেখা 'স্বামী শিষ্য সংবাদ' আর মানসকন্যা সিস্টার নিবেদিতার লেখা 'The Master, as I saw Him' বইগুলোতে তাঁর এই ধরণের ইন্দ্রিয়াতীত নানা অনুভূতির বর্ণনা রয়েছে। ঠাকুরের মধ্যেও আমরা ঘনঘন 'এই আছি এই নেই' ভাব দেখেছি, মহারাজ এবং ঠাকুরের অন্যান্য সন্তানদের মধ্যেও দেখেছি - আত্মজ্ঞানীদের যে এমনটা হয়, তা শাস্ত্রেও বর্ণিত।

যাইহোক, গুরুর কৃপায় যে তাঁর আত্মদর্শন হয়েছে, স্বামীজী মাকে সেটাই বলছেন। আর মা কি বলছেন? সেটা আরো মারাত্মক - দেখো, আমায় কিন্তু উড়িয়ে দিও না! ঠাকুর নয় কিন্তু, 'আমি'! এই আমি কে? স্বামী অভেদানন্দজি তাঁর মাতৃস্তোত্রে যাঁর সম্পর্কে বলছেন, "শরণাগত-সেবকতোষকরীং, প্রণমামি পরাং জননীং জগতাম্" অর্থাৎ, শরণাগত সেবকের তুষ্টিবিধানকারিণী এই পরমা জগজ্জননীকে প্রণাম করি। শরণাগতি - এটি ছেড়ো না বাপু, এটি ছাড়লেই সর্বনাশ! তোমার এই যে তুরীয় অবস্থা, সেটি আমারই দেওয়া, আমিই 'জননীং জগতাম্' - ভুল করে আমাকেই যেন আবার উড়িয়ে বোসো না। 

এরপর স্বামীজীর যে উত্তর, সেটা classic - স্বামীজী তো ততক্ষনে বুঝে ফেলেছেন আবেগের বশে কার সামনে কি কথা বলে ফেলেছেন, তিনি একেবারে শশব্যস্ত, সামান্য যে অহংবোধটুকু শরীরধারণ করার জন্য প্রয়োজন হয়, সেটুকুকেও যেন সম্পূর্ণভাবে মায়ের পায়ে অর্পণ করে দিয়ে বলছেন, মা, তোমা ছাড়া আমার আর আলাদা অস্তিত্ব কোথায়? তুমি আছো তাই আমি আছি, তোমায় উড়িয়ে দিলে যে আমার অস্তিত্বটুকুও উড়ে যায়।

তারপরেই স্বামীজী নিজের মনের গোপন কথাটি মায়ের সামনে তুলে ধরছেন। মা, তুমিই আমার গুরু, তুমি ঠাকুর নামক ব্রহ্মাগ্নির দাহিকাশক্তি, তুমি কৃপা করে আমায় আত্মজ্ঞান দিয়েছো - সেই তোমাকেই যদি অস্বীকার করি, তাহলে তো সে আমার অজ্ঞান। গুরু আর ইষ্ট এক, গুরু বিনা জ্ঞান নেই, আমার যা কিছু realisation হয়েছে সব তোমার দয়ায় - 'তাং সারদাং ভক্তিবিজ্ঞানদাত্রীং, দয়াস্বরূপাং প্রণমামি নিত্যম্' - তুমি সারদা, সরস্বতী, ভক্তিবিজ্ঞান-দায়িনী, দয়াস্বরূপিনী, তোমায় নিত্য প্রণাম করি। 

ওই বইটিরই পরের পাতায় মায়ের আর একটি কথা লিপিবিদ্ধ আছে, যা স্বামীজী আর মায়ের মধ্যে এই বার্তালাপকে sum up করে। মা বলছেন, "জ্ঞান হলে ঈশ্বর-টীশ্বর সব উড়ে যায়। 'মা' 'মা' শেষে দেখে। মা আমার জগৎ জুড়ে। সব এক হয়ে দাঁড়ায়। এই তো সোজা কথাটা।" আহা, এই সোজা কথাটাকে উপলব্ধি করা যে আসলে কত কঠিন, মহামাঈর অহেতুকি কৃপা না হলে যে সমগ্র জীবজগৎকে জগৎপ্রসবিনীরূপে দেখা সম্ভবই নয়, আর সেটাই যে আসল জ্ঞান, তা আর আমরা বুঝি কই? বুঝলে, মায়ের কাছে নির্বাসনা আর শরণাগতি প্রার্থনা করার এটাই কিন্তু সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।

নবরাত্রি

সারা বছরের মধ্যে শুভতমকাল নবরাত্রির আজ তৃতীয় দিন - তৃতীয়া। বিজয়া দশমী অবধি দেবীপক্ষের এই অতি পূণ্য দিনগুলিতে এক একদিন মহাশক্তির এক একটি রূপ ধারণ করে মা দৈহিকভাবে ধরায় উপস্থিত হন, ফলে ধরাতলে এমন এক দিব্য আধ্যাত্মিক আভামন্ডল তৈরি হয়, যা বছরের অন্য কোনো সময় আর হয়না।

এই দৈবীবলয় অনুভব করতে হলে কিছু সংযম, কিছু নিয়ম পালন আর যথাসম্ভব বেশি জপ তপ সাধন ভজন করতে হয়, যাতে শরীর মন সবসময় একেবারে শুচিশুদ্ধ থাকে, মাতৃআরাধনায় লীন থাকে। আমরা অনেকেই হয়তো উত্তর ও পশ্চিম ভারতে ভক্তদের সারা রাত জেগে কীর্তন ইত্যাদি সহযোগে 'জাগরণ' করতে দেখেছি, রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুরী-হালুয়া প্রসাদ বিতরণ হতে দেখেছি, এই দশ দিন ওখানে আমিষ খাদ্য প্রায় পাওয়াই যায়না - খাদ্যাভ্যাসের বিতর্কে না ঢুকেও বলা চলে যে ওসব অঞ্চলে এই শুভকালের প্রস্তুতির একটা বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা আছে। 

আমরা হয়তো ৭৩ বর্ষীয় অতিব্যস্ত এবং অতিজনপ্রিয় এক শিবভক্তের কথা জানি যিনি গত ৪০ বছর ধরে প্রত্যেক নবরাত্রিতে দিনে কেবল একবার একটি ফল আর বাকি সময়ে কয়েক গেলাস নিম্বুপানি খেয়ে নিজেকে সার্বজনীন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন ও একান্তিক আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য প্রস্তুত রাখেন। এই যে নিজেকে মায়ের অমৃতস্পর্শের জন্য প্রস্তুত রাখা এবং বছরের পর বছর ধরে প্রস্তুত রাখা - কৃপাময়ী যদি কৃপা করে একবার অন্তর্দৃষ্টি দেন আমরা যেন তা অনুভব ও গ্রহণ করার মতন আধাররূপে তৈরি থাকতে পারি - এই প্রক্রিয়াটিও সাধনার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 

আমাদের বাঙালিদের মধ্যে হুল্লোড় বেশি, গভীরতা কম। আমাদের কাছে পুজোর প্রস্তুতি মানে নতুন কাপড় জামা কেনা, আড্ডা মারা, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠেলাঠেলি করে ঠাকুর দেখা, খাওয়া দাওয়া, মোটের ওপর মোচ্ছব করা আর নিয়ম করে অষ্টমীর অঞ্জলিটি দিয়ে কোনোমতে পুজোর ব্যাপারটা থেকে রেহাই পাওয়া। পুজো কিন্তু আসলে এর কোনোটাই নয়। কাকে পুজো করা হচ্ছে, কেন হচ্ছে আর এই পুজোর ফলে জীবনের ওপর কি প্রভাব পড়ে, এগুলো নিয়ে একটু ভাবা দরকার বৈকি। 

যেদিন আমরা বাহ্যিক পরিমণ্ডল থেকে একটু গুটিয়ে নিয়ে নিজেদের উৎপত্তি ও সদগতি নিয়ে ভাববো, সেদিন হয়তো আমরা থমকে দাঁড়াবো। সেদিন প্যান্ডেলের মাইকে চন্ডীপাঠে 'ইয়া দেবী সর্বভূতেষু' শুনলে আমাদের হয়তো মনে হবে সর্বভূতে কে থাকতে পারেন? যখন শুনবো তিনি ক্ষান্তিরূপেণ সংস্থিতা, জাতিরূপেণ সংস্থিতা, শান্তিরূপেণ সংস্থিতা, শ্রদ্ধারূপেণ সংস্থিতা, কান্তিরূপেণ সংস্থিতা, লক্ষ্মীরূপেণ সংস্থিতা, বৃত্তিরূপেণ সংস্থিতা, স্মৃতিরূপেণ সংস্থিতা, দয়ারূপেণ সংস্থিতা, তুষ্টিরূপেণ সংস্থিতা, মাতৃরূপেণ সংস্থিতা, আবার ভ্রান্তিরূপেণ সংস্থিতাও, তখন হয়তো বুঝবো যে দুর্গাপুজো নিয়ে আমাদের বাঙালিদের মনে যে ভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, সেটা আমাদের কর্মফলেরই কারণে, এটাই আমাদের প্রারব্ধ। 

দিনকে দিন জাতি হিসেবে আমরা যে পিছিয়ে যাচ্ছি - কটুভাষী, ঈর্ষাকাতর, অর্বাচীন, নিম্নমেধার উপাসক - এক পশ্চাদমুখী ধারা বইছে খোদ মাতৃসাধনার পীঠস্থানে - এর শেষ মায়ের কৃপাতেই হবে, আর তার জন্যই আমাদের নিজেদের তৈরি করতে হবে। নবরাত্রি হলো সেই শুভকাল, যখন মা স্বয়ং সশরীরে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হন। আসুন না, আমরা নিজেদের তাঁর পাদপদ্মে সমর্পণ করে শুদ্ধ হই। 

"ইন্দ্রিয়ানামধিষ্ঠাত্রী ভূতানাং চাখিলেষু ইয়া।
ভূতেষু সততং তসৈ ব্যাপ্তৈ দেব্যৈ নমো নমঃ।।
চিতিরূপেণ ইয়া কৃৎস্নমেতদ্‌ ব্যাপ্য স্থিতা জগত।
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।"

Sunday, October 15, 2023

অর্গলাস্তোত্রম

আজ দেবীপক্ষের দ্বিতীয়া - মা আসছেন। মায়ের স্বরূপ বর্ণনা করে ঋষি মার্কণ্ডেয় অর্গলাস্তোত্রমের প্রথম দিকে বলছেন,
শ্লোক ১
"হে দেবী চামূণ্ডা, তোমার জয় হোক। হে দেবী, তুমি জীবের দুঃখনাশকারিণী; তুমি সর্বভূতে অবস্থিতা; আবার তুমিই প্রলয়ের অন্ধকার স্বরূপিণী কালরাত্রি। তোমায় নমস্কার করি।"
শ্লোক ২
"হে দেবী, তুমি সর্বোৎকৃষ্টা জয়যুক্তা দেবী জয়ন্তী; তুমি জন্মমৃত্যুবিনাশিনী মোক্ষপ্রদায়িনী দেবী মঙ্গলা; তুমি সর্বসংহারকারিণী কালী; তুমি সুখদায়িনী ভদ্রকালী; আবার তুমিই প্রলয়কালে ব্রহ্মা প্রমুখের মাথার খুলি হস্তে নৃত্যরতা কপালিনী। তুমি দুর্গা, কারণ বহু কষ্ট স্বীকার করে তবে তোমায় লাভ করা যায়; তুমি চৈতন্যময়ী শিবা; তুমি করুণাময়ী ক্ষমা; তুমি বিশ্বধারিণী ধাত্রী; তুমি দেবগণের পোষণকর্ত্রী স্বাহা ও পিতৃগণের পোষণকর্ত্রী স্বধা। তোমায় নমস্কার করি।"

এ দুটি শ্লোক থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে জগজ্জননী মহামায়াই যে ব্রহ্মের শক্তিস্বরূপিণী অক্ষয়রূপ, তা মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি প্রত্যক্ষভাবে জেনেছেন। তাই সেই ঋষিই যখন পরবর্তী শ্লোকগুলিতে বারেবারে মায়ের কাছে প্রার্থনা করছেন, "রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি", অর্থাৎ আমায় রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও আর আমার শত্রু নাশ করো, তখন তিনি স্বয়ং মোক্ষদায়িত্রীর কাছে সামান্য কোনো সাময়িক জাগতিক সুখ প্রার্থনা করে সময় নষ্ট করছেন, এমনটি কি কল্পনা করা সম্ভব?

মিশনে দুর্গাপূজার সময় ওই যে বিখ্যাত গানটি গাওয়া হয় না, "একবার বিরাজ গো মা হৃদি কমলাসনে। তোমার ভুবন-ভরা রূপটি একবার দেখে লই মা নয়নে।।" - যাঁরা শুনেছেন তাঁরা বুঝবেন এখানে যখন 'রূপং দেহি' বলা হচ্ছে তখন সেটা মোটেও 'আমায় রূপ দাও' হতে পারেনা; মা, তোমার ভুবন-ভরা রূপটি যেন সদা সর্বদা হৃদয়ে দেখতে পাই, জগন্মাতার কাছে সেই কৃপাই প্রার্থনা করা হচ্ছে। আমার শারীরিক রূপ নিয়ে কি হবে, ও তো অস্থায়ী। আজ লোকে আহা আহা করছে, কালের নিয়মেই একদিন চামড়া কুঁচকে যাবে, দাঁত পড়ে যাবে, চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে যাবে, শরীর নড়বড় করবে - ও ছাইপাঁশ চেয়ে লাভ কি? চাইতে হলে এমন জিনিস চাও যা জন্মজন্মান্তরেও ফুরাবে না, যা ধীরে ধীরে বাহ্যিক বাঁধন কেটে অভ্যন্তরীণ অনন্তের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

এরপর বলছেন 'জয়ং দেহি' - জয় দাও। শত্রুতা মিত্রতা সবই তো সাময়িক, যতক্ষণ শরীর আছে ততক্ষণ জয়-পরাজয়, যেই শরীর গেল অমনি সব শেষ। জয় আর ভোগেচ্ছা তো একে অপরের পরিপূরক - ভোগও কেবলই জাগতিক। তাহলে কিসের ওপর জয় প্রার্থনা করছেন ঋষি? চোদ্দটি ইন্দ্রিয়ের ওপর জয়। এই যে আমাদের পাঁচটি অনিয়ন্ত্রিত কর্মেন্দ্রিয় : বাক্ পাণি পাদ পায়ু উপস্থ, পাঁচটি নিয়ন্ত্রণহীন জ্ঞানেন্দ্রিয় : চক্ষু কর্ণ নাসিকা জিহ্বা ত্বক, আর চারটি অন্তরিন্দ্রিয় : মন বুদ্ধি অহঙ্কার চিত্ত - এদের ওপর জয় চাই। যতক্ষণ এরা আমার বশে নেই, ততক্ষণ এরাই আমায় চালনা করবে আর বাসনায় বাসনায় জর্জরিত করে বারেবারে ভোগের চোরাবালিতে নিয়ে যাবে; আমার আর মনুষ্য জীবনের আসল উদ্দেশ্য সাধন করা সম্ভব হবে না। মা, তুমি কৃপা না করলে এই ভয়ঙ্কর চোদ্দ শত্রুর বিরুদ্ধে জয়যুক্ত হওয়া আমার পক্ষে সম্ভবই নয়, তুমিই আমায় এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় প্রদান করো মা। 

কর্ণ-কুন্তী সংবাদের একেবারে শেষ পংক্তিটি মনে আছে? কর্ণ জানেন তাঁর মা আসলে তাঁর কাছে কি চাইতে এসেছেন, তাই মহাবীর তাঁর গর্ভধারিণীর কাছে কেবল এটুকুই প্রার্থনা করছেন যেন তিনি তাঁর যোদ্ধার ধর্ম পালন করতে করতেই মরতে পারেন, তিনি যেন কখনো স্বধৰ্মচ্যুত না হন। কর্ণ বলছেন, 
"শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে
জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি,
বীরের সদ্‌গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।"
জয়, যশ আর রাজ্য - এই তিনটির লোভই তো কুন্তী দেখিয়েছিলেন কর্ণকে - তোমার পাঁচ ভাই তোমায় মাথায় করে রাখবে, তুমি সূতপুত্র নও, পাণ্ডবকূলশ্রেষ্ঠ বলে পরিচিত হবে, তুমি সসাগরা পৃথিবীর সম্রাট হবে, তোমার নাম যশ কীর্তি অমর হয়ে থাকবে পৃথিবীর বুকে - কর্ণ সে সব হেলায় ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন। আসল যশ হলো ঠিক ঠিক ধৰ্ম পালন করতে পারার যশ - আমি সমস্ত প্রলোভনকে জয় করে আমার রাজধর্ম, বন্ধুধর্ম, স্বধর্ম ইত্যাদি সব ধৰ্ম ঠিক ঠিক পালন করতে পেরেছি - তার যশ। তাই "যশো দেহি"।

শেষে ঋষি বলছেন, "দ্বিষো জহি" - শত্রু নাশ করো মা। আমাদের আসল শত্রু তো বাইরে নেই, সবই ভেতরে। ষড়রিপু অর্থাৎ কাম ক্রোধ লোভ মোহ অহংকার আর ঈর্ষা - এই হলো আমাদের প্রত্যেকের ছয়টি আসল শত্রু। আমাদের যা কিছু দুর্গতি, সব এই রিপুগুলোর জন্যই, এগুলোই আমাদের ক্রমাগত আঘাত করে করে এমন একটা অন্ধকূপে আটকে ফেলে যে আমরা আর আমাদের অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করতে পারিনা। আমরা ভুলে যাই যে আমরা potentially Divine, আমরা অমৃতের পুত্র, যাকে আমরা হিংসা করছি বা যার ওপর রাগ করছি সেও আমারই অংশ, আলাদা কেউ নয়। আমার যা কিছু কর্মফল, সব বাসনা থেকে উদ্ভূত আর তার পেছনে ক্রমাগত ইন্ধন যোগায় এই ষড়রিপু। মা আমার অন্তরের শত্রু নাশ করো, কৃপা করে আমায় নির্বাসনা দাও, আমি যেন এই জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারি, তার উপায় করো মাগো।

Wednesday, October 4, 2023

বোধবুদ্ধি



বোধ আর বুদ্ধি এক নয়। বোধ বললেই আমার জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইনদুটি মনে পড়ে - ' স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়- ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!' বোধ মানে চেতনা, অন্যভাবে দেখলে উপলব্ধি। বুদ্ধি কম বেশি সমস্ত প্রাণীকুলেরই আছে কিন্তু বোধকে আত্মবোধে উন্নীত করার ক্ষমতা একমাত্র মানুষের আছে বলেই জানি, হয়তো ভবিষ্যতে গবেষকরা অন্য খোঁজও করতে পারেন। 

গাছের স্নায়ুতন্ত্র নেই, অথচ বেদনাবোধ আছে, এমনটা জগদীশচন্দ্র হাতে কলমে প্রমান করে দেখিয়েছিলেন। স্নায়ুতন্ত্র নেই মানে বুদ্ধি নেই অথচ বোধ আছে। মস্তিষ্ক না থাকলে অনুভূতি আসে কিভাবে এই মুহূর্তে সেই প্রসঙ্গে না ঢুকেও, এক্ষেত্রে বোধ আর দুঃখ বা সুখের অনুভূতি সমার্থক, সব ক্ষেত্রে যদিও নয়। কেবল মানুষই একমাত্র অদ্ভুত জীব যার গঠনতন্ত্রে সমস্ত রকমের সিস্টেম inbuilt থাকা স্বত্তেও, বাস্তবে দেখা যায় অনেকের মধ্যেই বুদ্ধি আছে কিন্তু বোধের উন্মেষ নেই। 

এ কিন্তু এক মারাত্মক বস্তু - মানুষকে অসম্পূর্ণ মানুষ করে তোলে। বুদ্ধি একটি বৃত্তি, যা rationally চিন্তা করে কোনো নির্ণয়ে পৌঁছতে সাহায্য করে। বুদ্ধির দুটি দিক আছে : ১. আমানতি, অর্থাৎ অতীতের অভিজ্ঞতা বা অর্জিত জ্ঞান থেকে নিষ্কর্ষ টেনে আনার ক্ষমতা আর ২. বিশ্লেষাত্মক, অর্থাৎ বর্তমান পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করে অতীতের অভিজ্ঞতা বা অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে এখন কি করণীয়, সেই নির্ণয়ে সহায়ক হওয়া। বুদ্ধি knowledge ভিত্তিক আর বোধ super knowledge বা conciousness ভিত্তিক - দুটো সম্পুর্ন পৃথক বস্তু। বুদ্ধি সমকালীন আর বোধ চিরকালীন। 

গাছ বন্ধুদের থেকে আলাদা হয়ে গেলে দুঃখ পায়, নির্জীব হয়ে যায়, আবার অনেকগুলো বন্ধু গাছের সান্নিধ্য পেলে আনন্দে চাঙ্গা হয়ে ওঠে, সেটা যাঁরা বাগান করেন তাঁরা রোজই উপলব্ধি করেন। কেন হয়? মস্তিষ্ক নেই, স্নায়ুতন্ত্র নেই, বুদ্ধি নেই কিন্তু চেতনা আছে - সে চেতন স্বত্তা, ফলে তার মধ্যে বোধ কাজ করে। সেই বোধ বা conciousness এর স্তর কি এমন যে তা তার আত্মবোধ জাগাতে সক্ষম? না। ওটা গোটা চেতন জগতে একমাত্র মানুষের জন্যেই তুলে রাখা আছে। 

কিন্তু মানুষ কি তার সদ্ব্যবহার করে? অধিকাংশই করে না। কারণ? সে সেই বর্তমানে বাঁচতে চায় যার কোনো অস্তিত্ব নেই। ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বর্তমান যে ক্রমাগত অতীত হয়ে যাচ্ছে, সেই বোধ তার প্রবৃত্তির নিচে চাপা পড়ে থাকে, ফলে সে এমন এক অনিত্যকে ধরে বাঁচতে চায়, বোধের জগতে যার কোনো relevence নেই। রামপ্রসাদ বলছেন, 'প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জায়া, তার নিবৃত্তিরে সঙ্গে লবি', কিন্তু কে আর নিবৃত্তি চায়? আজকাল তো অনেক সাধু সন্ন্যাসীরা তীব্র বৈরাগ্যের তাড়নায় গৃহত্যাগ করেও পরবর্তীকালে আনুষ্ঠানিক দায়িত্বপালন করতে গিয়ে জাগতিক প্রবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ছেন দেখছি। 

অলীক সুখের খোঁজে আমাদের বুদ্ধি আমাদের দিয়ে এমন খাটান খাটিয়ে নেয়, যে যখন বেলাশেষে আমরা realise করি 'এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়', তখন আর নতুন করে বোধের রাস্তায় হাঁটার মতন শারীরিক বা মানসিক রেস্ত অবশিষ্টই থাকে না। বস্তুতঃ, কেবল বুদ্ধির কথা শুনে চললে বেদনা ছাড়া আর কিছু জোটে না - সে বেদনা নিজেরও হতে পারে আবার অপরের ওপর চাপিয়েও দেওয়া যেতে পারে। অবশ্য ঈশ্বরের কৃপা হলে 'আমি জীবনের উদ্দেশ্যকে বুঝতে না পেরে বৃথা সময় নষ্ট করছি' এই বেদনাও বুদ্ধির মাধ্যমেই মনকে পীড়া দেয়।

মজার ব্যাপার হলো এইরকমই কোনো এক বেদনা থেকে বোধের উদয় হয় - জীবনে যত বেশি বেদনা তত বেশি উপলব্ধি, যত বেশি উপলব্ধি তত বেশি নিবৃত্তি, যত বেশি নিবৃত্তি তত বেশি অহঙ্কারের ক্ষরণ আর আর তত বেশি ইন্দ্রিয়ের বাঁধা ভেঙে চেতনার উদয় - যে চেতনা চিরকালীন প্রেম আর চিরকালীন আনন্দ, অর্থাৎ সত্যের দিকে নিয়ে যায়। তাই রবীন্দ্রনাথ সৎ-চিৎ-আনন্দস্বরূপের কাছে এই বৌদ্ধিক প্রার্থনা করছেন, 
আরো বেদনা আরো বেদনা,
প্রভু, দাও মোরে আরো চেতনা।
দ্বার ছুটায়ে বাধা টুটায়ে
মোরে করো ত্রাণ মোরে করো ত্রাণ।
আরো প্রেমে আরো প্রেমে
মোর আমি ডুবে যাক নেমে।
সুধাধারে আপনারে
তুমি আরো আরো আরো করো দান ॥