Sunday, August 29, 2021

কাল আর যাপন

যেটুকু বুঝেছি, generally হিন্দু সভ্যতায় কালচক্র (time cycle) হলো প্রায় সব দর্শনেরই মধ্যবিন্দু। যেমন ছয়টি ঋতুই কালের নিয়মে একের পর এক নির্দিষ্ট cycle মেনে চলতে থাকে তেমনিই ঋত (Cosmic order), সত্য (Truth), ধর্ম (Universal Law) এবং ঋণ (Debts owed to ancestors, Rishis and nature) ওই একই প্রথায় একটি নির্দিষ্ট cycle মেনে চলতে থাকে। পূর্বপুরুষের প্রজ্ঞার ওপর ভিত্তি করে, ধর্মের পথ ধরে, সত্যকে আশ্রয় করে পরমসত্যে লীন হয়ে যাওয়া একটা গোটা জন্মচক্রের পরিণতি। সেই জন্যই বারেবারে জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্মের cycle চলে আর সেইজন্যই ধর্মাশ্রয়ী সুকর্মের মাধ্যমে বাজে কর্মফল ক্ষয় করে করে শেষে ব্রহ্মকে উপলব্ধি করার সুযোগ সবার আছে, ফলে eternal hell বা eternal heaven বলে আমাদের দর্শনে কিছু নেই। এবং পুরো দর্শনটিই বিজ্ঞানের (science) ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যা মূলত প্রত্যক্ষ প্রমান (empirical evidence) নির্ভর কিন্তু তারপরেও stage by stage ধীরে ধীরে মানুষের বোধবুদ্ধি অনুযায়ী অনুমান (inference), উপমান (analogy), অর্থপ্রাপ্তি (deductive evidence) ও শেষে শব্দ (scriptural authority) অবধি নামতে পারে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো শব্দ কিন্তু last resort আর প্রত্যক্ষ প্রমান সবচেয়ে ওপরে কারণ time cycle চোখের সামনে দেখা যায়, তাকে জীবনের প্রতিটি বিষয়ের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে বোঝা যায় - উদাহরণ স্বরূপ সুখ এবং দুঃখ একটা cyclical order এ চলতে থাকে, ক্ষুধা একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর পর পায়, জাগরণ এবং ঘুম দিন আর রাতের cycle এর সাথে জোড়া, ফুলের পর ফল হয়, ইত্যাদি। মূল কথা হলো কেউই ব্রাত্য নন, যিনি যখন realise করবেন যে তাঁর সত্যিকারের আমিটাকে খোঁজা প্রয়োজন, সেই দিন থেকেই তাঁর reverse osmosis চালু হয়ে যাবে এবং এখানে final day of judgement এর কোনো আষাঢ়ে গল্প নেই - সবটাই জীবের নিজের হাতে। সত্যিকারের আমির না কোনো শুরু না শেষ, না তার কোনো ঈশ্বর, না কোনো শব্দ - সে সনাতন, অব্যক্ত ও অবিভক্ত। নামরূপী ও অনামরূপী সবকিছুই শুধুমাত্র আদি ও অনন্ত ব্রহ্মের (Universal Consciousness) বিভিন্ন কায়িক বা দার্শনিক manifestation মাত্র।

এরপর আসে, যাঁরা অনুসন্ধানে বেরোবেন, তাঁদের ideal living এর বিষয়। পাঁচটি 'পরিহার' অর্থাৎ অহিংসা, সত্যবাদিতা, অচৌর্য, অপরিগ্রহ এবং কামশুন্যতার মধ্যে অপরিগ্রহ হলো বেশ কঠিন একটি concept। অপরিগ্রহ মানে হলো মূলত অনাসক্তি কিন্তু তার মধ্যেও অন্তঃপ্রবৃত্তি (নিজের পছন্দ/অপছন্দ) ও বাহ্যপ্রবৃত্তির (বিষয়েচ্ছা/ভোগেচ্ছা ইত্যাদি) মধ্যে পার্থক্য থাকতে বাধ্য। অবশ্য অপরিগ্রহ বলতে সাধারণ ব্যাখ্যায় 'কেউ নিজে থেকে দিলে ভিক্ষা নেব কিন্তু নিজে আগবাড়িয়ে কিছু চাইবো না' বোঝায়, যা আপাতদৃষ্টিতে হয়তো কেবলমাত্র স্থূল শারীরিক চাহিদাপূরণের ক্ষেত্রে একটি মানসিক restraint-এর ইঙ্গিত, কিন্তু এর পেছনে আসলে ঈশ্বরের ইচ্ছার ওপর সম্পুর্ন নির্ভরতা, আস্থা এবং তাঁতে পূর্ণ সমর্পণের ভাব কাজ করে। এছাড়াও সত্য দম দয়া অক্রোধ আর্জব সন্তোষ তপস্যা স্বাধ্যায় শৌচ এবং মিতাহার - সবটা মিলিয়ে যাপনের একটা গোটা eco-system। দম মানে হলো দমন - নিজের কুপ্রবৃত্তিকে দমন, কমেচ্ছাকে দমন ইত্যাদি; আর্জব মানে ঋজুতা বা সারল্য আর স্বাধ্যায় মানে শাস্ত্রপাঠ। এগুলি জৈনদের কৃত্য বটে কিন্তু যিনিই আত্মানুসন্ধানে ব্রতী হবেন তাঁদের সকলের পক্ষেই এইগুলি common factor। হিন্দু সভ্যতায় কোনো religious dogma নেই, সবটাই way of life। ওটি মানতে পারলে মন আপনা থেকেই এমন আধ্যাত্মিক উচ্চতায় উঠে যাবে যে তারপর আর rigidity-র কোনো জায়গা থাকে না - সব পথকেই নিজের পথ বলে মনে হয়। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাধন-জীবন নানা পথ ধরে শেষে সেই একই সনাতন সত্য বা eternal truth-এর উপলব্ধির মূর্তরূপ। এর আগের অবতারে শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন এই শাশ্বত দর্শনের ব্যবহারিক প্রতিরূপ আর শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন এর বৌদ্ধিক প্রতিরূপ।

Tuesday, August 10, 2021

জাতির প্রারব্ধ

একজন মানুষ যেমন আগের আগের জন্মের কর্মফলের নিট ফলাফল-স্বরূপ প্রারব্ধ ঘাড়ে করে নিয়ে জন্মান এবং এই জন্মের সু অথবা কু কর্মফলের কারণে সেই প্রারব্ধকে হয় খণ্ডন অথবা বর্ধন করেন, ঠিক সেইরকমই যেকোনো জাতির জীবনেও ওই একই প্রারব্ধ আর কর্মফলের সূত্র কাজ করে, তবে সমষ্টিগতভাবে, যা সামাজিক জীব হিসেবে ব্যক্তির জীবনকেও প্রভাবিত করে। আমরা কোন দেশে জন্মেছি, কোন প্রদেশে জন্মেছি, কোন পরিবারে জন্মেছি, কোন সংস্কারে লালিত পালিত হচ্ছি - সবটাই আমাদের প্রারব্ধ। আর আমরা যে এই জাতিতেই জন্মেছি এবং আমাদের কর্মফল জাতিকেও ভোগ করতে হচ্ছে, এটা সেই জাতির প্রারব্ধ। দেখবেন অনেক সময় এমন হয় যে একেবারে হওয়া কাজ ঘেঁটে গেল, চরম অশান্তির কারণ হয়ে উঠলো, অথচ এমনটা ঘটার কোনো পূর্ব ইঙ্গিতই ছিলনা - প্রারব্ধ। জাতির ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। হটাৎ বলা নেই কওয়া নেই কোত্থেকে হৈ হৈ করে ঘোড়ার পিঠে চড়ে কিছু বর্বর এসে লুটপাট করে, বহু মন্দির আর শ্রীবিগ্রহ ভেঙেচুরে, শাস্ত্রগ্রন্থ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে, জোর করে নিজেদের বর্বরতা কিছু মানুষের মধ্যে বপন করে, গোটা সমাজকে কলুষিত করে দিয়ে চলে গেল - কি বলবেন, জাতির প্রারব্ধ নয়? যদি নিজেদের মধ্যে জাতবিচার না করে, জাতি সু আর কু-এর মধ্যে জাতবিচার করতো আর সবাই মিলে একসাথে এক জাতি হিসেবে বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারতো তাহলে সেই কর্মফলের দ্বারা পরাধীনতার প্রারব্ধ খণ্ডন হয়ে যেত, কিন্তু জাতি পারলো না। বারবার অবতারেরা এলেন, তাঁদের দূতরা এলেন, বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে সমগ্র বিশ্বের কল্যাণহেতু মানবতার ধাত্রীভূমি আমাদের এই পবিত্র হিন্দুভূমির নিজের ক্ষমতা এবং খামতি সম্পর্কে আত্মপোলব্ধির বড় প্রয়োজন, কিন্তু জাতি জাগলো না আর দীর্ঘ সময় ধরে জন্মজন্মান্তরের সঞ্চিত পাপও আর স্খলন করা গেলনা। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য - দেশভাগ থেকে শুরু করে এখন যে শ্রদ্ধাহীনতা, ক্ষুদ্রতা, অপরিসীম লোভ, লালসা, হিংসা, পরনির্ভরতা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি সব মিলিয়ে এক সার্বজনীন নৈরাজ্যের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেটাও বাঙ্গালী জাতির প্রারব্ধ - তারা সত্যিকারের শ্রীচৈতন্যকে বুঝতে পারেনি, মহীরুহকে লতাগুল্ম বানিয়ে ছেড়েছে। যাইহোক, জন্মান্তরবাদ তত্বের মতে অহেতুকি ভগবৎ কৃপায় কোনো না কোনো এক জন্মে মানুষের বোধোদয় ঠিকই হয় এবং তার জীবন অবশেষে প্রারব্ধশূন্যতার দিকে মোড় নেয়। জাতির জীবনেও এমনটাই হয়। সারা বিশ্ব জুড়ে বহু সভ্যতার উত্থান ও পতন এবং পুনরুত্থানের মধ্যেই এর প্রমাণ ছড়িয়ে আছে, ইহুদীরা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। এখনই বাঙ্গালীর জাগার সময় হয়েছে কিনা আমি জানিনা, কিন্তু ভারত আবার জাগছে। আর ভারত জাগলে বঙ্গভূমিও আজ নয় কাল জাগতে বাধ্য। ভবিষ্যৎ আশাময়।

মনের মধ্যে পাহাড়

বরফঘেরা পাহাড়ের ছবি দেখছিলাম, দেখতে দেখতে মনে হলো পাহাড়ের চূড়ায় যেখানে বরফ লেগে থাকে, সেটা ধাক্কাধাক্কির সময় সবচেয়ে প্রথম বেসামাল হয়েছিল আর ঠেলা সামলাতে না পেরে ধীরে ধীরে অতটা ওপরে উঠে গিয়েছিল। বাকি গোটা পাহাড় এইভাবেই তৈরি - গোটাটাই বিভিন্ন পর্যায়ে নিচের ধাক্কার চোট সামলাতে না পেরে উর্ধতনস্তরের ভার ঠেলতে ঠেলতে নিজেরাও হাজার হাজার ফুট উঁচু হয়ে গেছে। মধ্যাকর্ষণ প্রতিনিয়ত চূড়াকে টানে, কিন্তু পাহাড়ের নিম্নদেশ এমনই বলবান, সেটা মাটিকে এমনভাবে সবলে আঁকড়ে ধরে রয়েছে যে চুড়োর আর নিচে নামবার উপায় নেই। মাঝেমাঝে হয়তো পাহাড়ের গা থেকে ভূস করে খানিকটা মাটি পাথর গড়িয়ে নেমে আসে, হয়তো কখনো পাহাড়ের খানিকটা অংশ ভেঙে পড়ে, মাথার বরফ গলে গলে জীবনদায়ী নদী হয়েও নেমে আসে ধরাতলে, কিন্তু পাহাড় নামে না। আসলে ওই উচ্চতায় একবার উঠে গেলে আর নামবার যো থাকে না। আমাদের মনের মধ্যে বরফঢাকা পাহাড়চূড়া দেখলে যে অদ্ভুত এক শান্তির অনুভূতি হয়, সেটা আসলে মনে মনে তার উচ্চতার এবং নির্লিপ্ততার স্বীকৃতি - সে মাটির সব কলুষতা, সব ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমরা তো জানি যে একেবারে পাদদেশে যে পাথর, চূড়াতেও তাই, তবু কেন শ্রদ্ধা হয়? কারণ আমরাও আর টাল সামলাতে পারছি না, আমাদেরও নানাবিধ অশান্তি চতুর্দিক থেকে ঘিরে নিয়ে ভয়ানক ঠেলছে, আমাদেরও আর এই রোজকার চিঁড়েচেপ্টা হওয়া ভালো লাগছেনা, আমরাও চাইছি অশান্তির উৎসের কাঁধে ভর দিয়েই ওগুলোর উর্ধে উঠে যেতে। আসলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেই তো কত পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে দেখা যায় - কই তাদের তো ডেডলাইন মিট না করার গালাগাল খেয়ে, নিজের মনকে ছোট করে পেটের রসদ জোগাড় করতে হয়না, তাদের তো দেখনদারী করার জন্য ক্রেডিটকার্ডের বোঝার তলায় ডুবে যেতে হয়না, তাহলে আমাদের কেন হয়? তারা যদি অতটুকু বুদ্ধি নিয়ে প্রকৃতি থেকেই নিজেদের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু অক্লেশে মিটিয়ে নিতে পারে, আমরা এত বুদ্ধি নিয়েও কেন তা পারিনা? নিজেদের চারপাশে নিজেদেরই গড়ে তোলা এই যে একটা কৃত্তিম বাসনার ইঁট আর বাসনাপূর্তির সিমেন্ট দিয়ে তৈরি দেওয়াল, ওই দেওয়াল চাপা পড়ে মরাই যেন আমাদের ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা সবাই পাহাড়চূড়ার শীতলতা চাই, অবিচ্ছিন্ন নীরবতা চাই, অবিক্ষুব্ধ যাপন চাই, অথচ কতজন এই অপ্রয়োজনীয় ধাক্কাধাক্কি থেকে আসলে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারি? আমাদের চতুরাশ্রম কিন্তু সেই কথাই বলে। বলে যে একটা বয়সের পর আর আহারের দিকে নয়, পাহাড়ের দিকে তাকাও। বহুদিন ধরে চাপ সহ্য করতে করতে একসময় টাল হারিয়ে ফেলাটা কোনো অন্যায় নয়, আমাদের সংস্কৃতিতে ওটাই প্রত্যাশিত। যিনি পারেন তিনি শান্তির পথে এগিয়ে যান। যিনি পারেননা, তাঁর চোখদুটি সামনের দিকে হলেও, আপাতত দৃষ্টি পশ্চাদগামী। তবে তিনিও জন্মের পর জন্ম ধরে বিতৃষ্ণা অর্জন করার জন্য সময় পান, কেউই আসলে বাদ নন।

ভাষা ও যাপন

 গতকাল বিকেলে দুজন অগ্রজপ্রতিম দক্ষিণ কলকাতার একটি ক্যাফেতে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে বেশ একটা মজার অভিজ্ঞতা হলো। অন্য একজন গ্রাহক আগে থেকেই বসে ছিলেন, ধীরে ধীরে আরো কিছু মানুষ যোগদান করলেন, বেশ একটা গ্রূপ তৈরি হয়ে গেল। যা বুঝলাম এঁদের মধ্যে একটি কাপেল আর বাকিরা সব বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী মিলিয়ে সিঙ্গেল যুবক এবং যুবতী। বোঝা গেল যে ওঁরা আগামী শুক্রবার দল বেঁধে দার্জিলিং বেড়াতে যেতে চান, সেই বিষয়েই আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার উদ্দেশ্যেই এই একত্রিত হওয়া। বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ আবহাওয়ায় আলোচনা শুরু হলো, সবাই উচ্চকিত, ঝপাঝপ খাওয়ার এবং পানীয়র অর্ডার দেওয়া শুরু হলো, হাসি ঠাট্টায় একেবারে যাকে বলে উৎসবের পরিবেশ। আমি ফিস ফ্রাই খাচ্ছি আর চুপচাপ দেখছি, শুনছি। তারপর যত সময় এগোতে থাকলো তত পরিবেশ বদলাতে থাকলো এবং প্রথম মতভেদ শুরু হলো mode of transport নিয়ে - কেউ প্লেনে যেতে চান তো কেউ ট্রেনে, কেউ এসিতে যেতে চান তো কেউ স্লিপার ক্লাসে, প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে। তারপর বিরোধ লাগলো বাসস্থান নিয়ে - কারো ইচ্ছে হোম স্টে, কেউ বা লোকাল কালচারে আগ্রহী নন, তাঁরা চান হোটেলের আরাম। যত পারা চড়ছে তত বিভিন্ন সাব-গ্রূপে ভাগ হয়ে সমমনোভাবাপন্নরা বাইরে গিয়ে ঘন ঘন সিগারেট ফুঁকে আসছেন আর ফিরে এসেই দ্বিগুন উৎসাহে নিজেদের মতের সপক্ষে নতুন যুক্তিজাল ছড়াচ্ছেন। আমি দেখছি, মিটিমিটি হাসছি আর ততক্ষনে ফ্রাই শেষ করে চিকেন কাটলেটে হাত দিয়েছি। এরমধ্যে হটাৎ করে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে প্রবল মতানৈক্য দেখা দিল, বন্ধুগোষ্ঠীর একদিকে স্বামী,  তো স্ত্রী আর একদিকে। স্বামীটি অবাঙ্গালী এবং স্ত্রীটি খাঁটি মেড ইন বঙ্গ ক্যালকেসিয়ান। উচ্চৈঃস্বরের মধ্যে একবার হিমশীতলগলায় 'ঔকাত' শব্দটি কানে এলো এবং তৎক্ষণাৎ স্বামী ভদ্রলোক নিজের পিঠের বোঁচকা তুলে সটান বাইরে হাঁটা দিলেন, তাঁর পেছনে পেছনে কয়েকজন 'আরে শুন শুন' বলতে বলতে দৌড়ালেন। গোটা জায়গাটা জুড়ে যেন অকস্মাৎ শ্মশানের শান্তি নেমে এলো, টেবিল প্রায় ফাঁকা, দুটো থমথমে ঘন কালো মেঘে ঢাকা মুখ, আর এরই মধ্যে একগাদা খাবার নিয়ে কয়েকজন ওয়েটার হাসিহাসিমুখে সশব্দে থরে থরে প্লেট গ্লাস কাঁটা চামচ ইত্যাদি সব টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখতে লাগলেন, কাঁচের বাইরে ফুটপাথে তখন চরম উত্তেজনা, ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ওঁদেরই মধ্যে যিনি সবার আগে এসে বসেছিলেন, তিনি বাইরে বেরোনোর আগে বিব্রতকণ্ঠে আমাদের দিকে ফিরে বলে গেলেন, "আমি কিন্তু যাবো না, এমনিই এসেছি"; এটা বলার কোনো প্রয়োজন ভদ্রমহিলার ছিলনা কিন্তু কেন বললেন সেটা হয়তো আন্দাজ করা কঠিন নয়। সম্পুর্ন নির্লিপ্ত হয়ে চোখের সামনে সামান্য কালখণ্ডের মধ্যে যেন গোটা জীবনের অসারত্বের একটা চলছবি দেখলাম, যার প্রয়োজনীয়তা আদপেই আছে কিনা ভাবা দরকার, খুবই দরকার। মানুষ নাকি কথা না বললে বাঁচে না। সে কি বাঁচার গুণাত্মক আর পরিমাণাত্মক দিকের পার্থক্য বোঝে আর যদি বোঝে তাহলে কথার প্রয়োজনীয়তা এবং প্রভাবকে কি সে স্বেচ্ছায় গ্রহণ বা বর্জন করার ক্ষমতা ধরে? নিজের মন বুদ্ধি আর অহংকার থেকে উৎপন্ন বাসনা - সেটা প্রকাশের ভাষা, আর অন্যের মন বুদ্ধি আর অহংকারের ওপর সেই বাহ্যিক ভাষার প্রভাব - সব মিলিয়ে বড় গোলমেলে সব ব্যাপার স্যাপার। হয়তো যত বাক্যহীন থাকা যায়, নিজেকে আত্মস্থ রাখা যায়, ততই যাপন অর্থবহ হয়।

কর্মফল ও পুনর্জন্ম

 কর্মফল ও পুনর্জন্ম


আমাদের সংস্কৃতিতে কর্ম তিন প্রকারের যথা: ক্রীয়মান, সঞ্চিত, এবং প্রারব্ধ। যখন কেউ তার শ্রমের ফল তার জীবদ্দশাতেই উপভোগ করতে পারে, তখন তাকে বলা হয় ক্রীয়মান; তার শ্রমের ফল ভোগ করার পূর্বেই যদি সে মারা যায়, তবে তাকে বলা হয় সঞ্চিত কর্ম। পূর্ব জন্মের সঞ্চিত কর্মের উদ্বৃত্ত অংশ ভোগ করার জন্য যদি তার পুনর্জন্ম হয়, তবে তাকে বলা হয় প্রারব্ধ। সাধনার গুণে কারো পক্ষে ক্রীয়মান ও সঞ্চিতের প্রভাব নিজের জীবন থেকে মুছে ফেলা যেতে পারে কিন্ত্তু প্রারব্ধ কর্মের প্রভাব মুছে ফেলা সম্ভব নয়। পার্থিব উচ্চাকাঙ্ক্ষা দ্বারা যতক্ষণ কোন ব্যক্তি আবিষ্ট থাকে ততক্ষণ তাকে নিশ্চিতভাবে জন্ম-মৃত্যুর অন্তহীন ভ্রমণ গ্রহণ করতে হবে। জীবাত্মা কখনও কখনও নাক্ষত্রিক জগতে ভ্রমণ করার জন্য স্থূল দেহ ত্যাগ করে যাকে বলা হয় প্রেত লোক। এর কর্মের প্রভাবের মধ্য দিয়ে যাবার পর এটি স্থূল দেহের সাথে স্থূল জগতে ফিরে আসে তার অতিরিক্ত বাসনাসমূহ যা তার পূর্ব জন্মে ছিল তা পূরণ করার জন্য। এ ব্যাপারে অজ্ঞ হয়ে কিভাবে এটি এক জগত থেকে অন্য জগতে চলাফেরা করে তা এক বড় রহস্যের বিষয়। যোগীরা এ রহস্য স্পষ্টভাবে হৃদয়ঙ্গম বা প্রত্যক্ষ করতে পারেন এবং জীবের পূর্ব সংস্কার সম্পর্কে বলতে পারেন।


বেদান্তসূত্রে সৃষ্টিকর্তা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, জগৎকে সৃষ্টির জন্য ব্রহ্মকেও জীবের কর্মের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। কেননা, এই সৃষ্টিজগৎ আপ্তকাম ব্রহ্মের লীলা (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৩) হলেও, জগৎ-স্রষ্টা হিসেবে ব্রহ্মর পক্ষপাতিত্ব ও নিষ্ঠুরতার আপত্তি উত্থাপিত হয়। বস্তুত জগতে- মানব সমাজে- যে বৈষম্য দেখা যায়, অনেকেই শ্রম করতে করতে অনাহারে মৃতপ্রায় হলেও কেউ কেউ বিনা পরিশ্রমেই অন্যের শ্রমের ফল ভোগ করে বিলাসী জীবন কাটায়। তাদের দেখেই পুরোহিতবর্গ দেবলোকের কল্পনা করেছেন। আবার মনুষ্য থেকে ক্ষুদ্রতম কীট পর্যন্ত প্রাণিজগতে যে ভীষণ সংহার দেখা যায় যায় তা জগৎ-স্রষ্টা ব্রহ্মকে বড়ই হৃদয়হীন বলে প্রমাণ করে, এবং তার থেকে আত্মরক্ষার জন্যই উপনিষদে পূর্বজন্মকৃত কর্মসিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়েছে-


‘তাদের মধ্যে যারা (পূর্বজন্মে) রমণীয় আচরণ বা পুণ্যকর্ম করে তারা দেহান্তরে শীঘ্রই ব্রাহ্মণযোনিতে বা ক্ষত্রিয়যোনিতে বা বৈশ্যযোনিতে জন্মলাভ করে। আবার যারা (পূর্বজন্মে) কপূয়াচরণ অর্থাৎ কুৎসিত বা অশুভ কর্ম করে তাদের শীঘ্রই কুকুরযোনিতে বা শূকরযোনিতে বা চণ্ডালযোনিতে পুনর্জন্ম হয়।’- (ছান্দোগ্য-৫/১০/৭)।


একই বিষয়ে বৃহদারণ্যক উপনিষদেও বলা হয়েছে এভাবে-

‘…তিনি কর্মকেই আশ্রয় করে থাকেন। তাই পুণ্য কাজ করলে ভালো আর পাপ কাজ করলে মন্দ ভোগ করতে হয়। পাপ-পুণ্যের আবর্তে জীব-পুরুষকে জন্মচক্রে পাক খেতে হয়। তাই কর্ম হলো জীবের গতি, কর্ম হলো জীবের মুক্তি। কর্মই স্থির করে দেবে জীব-পুরুষের অবস্থান।’- (বৃহদারণ্যক-৩/২/১৩)।


অর্থাৎ পূর্বজন্মের কর্মফলই নির্ধারণ করে দিচ্ছে এজন্মে কিভাবে এই ফল ভোগ করতে হবে, এই জন্মে সুখ ভোগ করবে, না কি দুঃখ ভোগ করবে। তৎকালীন সামাজিক ব্যবস্থা- শোষক-শোষিত, প্রভু-ভৃত্য প্রথার- দৃঢ় সমর্থক বাদরায়ণও একে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে বলেছেন-


(বৈষম্যনৈর্ঘৃণ্যে ন, সাপেক্ষত্বাৎ, তথা হি দর্শয়তি), ‘জগতে সুখ দুঃখাদি দেখে ব্রহ্মকে পক্ষপাতযুক্ত বা নিষ্ঠুর বলা যায় না- কারণ শাস্ত্রে এই বৈষম্যের হেতু এবং ব্রহ্মের স্বরূপ প্রদর্শিত হয়েছে।’- (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৪)।

এবং জীবের এই কর্মফল দাতা যে ঈশ্বরই, তা স্পষ্ট সিদ্ধান্ত করেই তিনি বলেন-

‘ফলমতঃ, উপপত্তেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/২/৩৮)।।

ভাবার্থ : জীবের কর্মফলদাতা যে ঈশ্বর তাই যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত (ব্রঃ-৩/২/২৮)।


এখানে হয়তো একটি আপত্তি উঠতে পারে যে, কর্ম তো একটা সময়ে করা হয়ে থাকে, তার আবার আগের জগতের কথা কী করে আসে ? কিংবা প্রশ্নটি এভাবেও হতে পারে যে, যেহেতু প্রথম সৃষ্টির পূর্বে জীবাত্মার পক্ষে তার পূর্বে কোন অবস্থান সম্ভব নয়, তাই কর্মফল থাকাও সম্ভব নয়, তাহলে প্রথম সৃষ্টির সময়েই জীবের মধ্যে অবস্থার পার্থক্য আসবে কোত্থেকে- যদি না ঈশ্বর পক্ষপাতিত্ব করে এই ভেদ সৃষ্টি করে থাকেন ? এই আপত্তির উত্তরে বাদরায়ণ বলেন যে, সৃষ্টি অনাদি, অতএব কর্মও অনাদি-

(ন কর্মাবিভাগাদিতি চেৎ, ন, অনাদিত্বাৎ), ‘সৃষ্টির পূর্বে জীব ও ব্রহ্মের কোন ভেদ ছিলো না। সৃষ্টির সময়েই ঈশ্বর পক্ষপাতিত্ব করে ভেদ সৃষ্টি করেছেন যদি এরূপ বলা হয়, তাহলে এর উত্তরে বলা যায় যে, না জীবজগৎও অনাদি।’- (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৫)।


পুনর্জন্মের বিষয়ে বাদরায়ণ উপনিষদের সিদ্ধান্তকে সু-ব্যবস্থিতরূপে একত্রিত করেছেন। ছান্দোগ্য উপনিষদের (ছাঃ-৫/১০/৭) শ্রুতিতে সুকৃতি-দুষ্কৃতির মাধ্যমে পুনর্জন্মের যে ধারণা অভিপ্রেত হয়েছে, তার থেকেই পরবর্তী উপনিষদগুলিতে জীবের পুনর্জন্মচক্রের একটা দার্শনিক রূপরেখাও তৈরি হয়ে গেছে। যেমন, প্রশ্ন-উপনিষদে বলা হয়েছে-

‘তেজো হ বা উদানঃ তস্মাৎ উপশানততেজাঃ। পুনর্ভবম্ ইন্দ্রিয়ৈঃ মনসি সম্পদ্যমানৈঃ’। (প্রশ্নোপনিষদ-৩/৯)।। 

‘যৎ চিত্তন্তেনঃ এষঃ প্রাণম্ আয়াতি। প্রাণঃ তেজসা যুক্তঃ সহাত্মনা যথাসঙ্কল্পিতং লোকং নয়তি’। (প্রশ্নোপনিষদ-৩/১০)।।

অর্থাৎ :

অগ্নিই উদান। মানুষের যখন মৃত্যু হয় তখন তার শরীর শীতল হয়ে যায়। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় তখন মনে লীন হয় এবং সে জন্মান্তরের জন্য প্রস্তুত হয় (প্রশ্ন-৩/৯)। মৃত্যুকালে জীবাত্মা প্রাণে প্রবেশ করে। সঙ্গে থাকে মন এবং সেই সময়কার মনের যত সংস্কার বা চিন্তা ও বাসনা সমূহ। প্রাণ তখন অগ্নি অর্থাৎ উদানের সঙ্গে যুক্ত হয় (কেননা উদানই তাকে দেহের বাইরে নিয়ে যায়)। আত্মা যে লোক কামনা করে প্রাণ তাকে সেই লোকেই নিয়ে যায়। তারপরে আত্মা নতুন জন্ম গ্রহণ করে (প্রশ্ন-৩/১০)।


এই ধারণারই আরেকটু বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বৃহদারণ্যক উপনিষদে-


‘স যত্র অয়মাত্মাহ্বল্যং ন্যেত্য সংমোহমিব ন্যেতি অথৈনমেতে প্রাণা অভিসমায়ন্তি স এতাস্তেজোমাত্রাঃ সমভ্যাদদানো হৃদয়মেব অন্ববক্রামতি ষ যত্রৈষ চাক্ষুষঃ পুরুষঃ পরাঙ্ পর্যাবর্ততে, অথ অরূপজ্ঞ ভবতি’। (বৃহদারণ্যক-৪/৪/১)।। 

‘একীভবতি ন পশ্যতীতি আহুঃ, একীভবতি ন জিয়তীতি আহুঃ, একীভবতি ন রসয়ত ইতি আহুঃ, একীভবতি ন বদতীতি আহুঃ, একীভবতি ন শৃণোতীতি আহুঃ, একীভবতি ন মনুতে ইত্যাহুঃ, একীভবতি ন স্পৃশতীতি আহুঃ একীভবতি ন বিজানাতীত্যাহুঃ। তস্য হি এতস্য হৃদয়স্যাগ্রং প্রদ্যোততে, তেন প্রদ্যোতেন এষ আত্মা নিষ্ক্রামতি চক্ষুষ্টো বা মূর্ধ্নো বা অন্যেভ্যো বা শরীরদেশেভ্যঃ। তং উৎক্রমন্তং প্রাণোহনুৎক্রামতি, প্রাণমনুৎক্রামন্তং সর্বে প্রাণা অনুৎক্রামন্তি, সবিজ্ঞানো ভবতি, সবিজ্ঞানমেব অন্ববক্রামতি। তং বিদ্যাকর্মণী সমন্বারভেতে পূর্বপ্রজ্ঞা চ’। (বৃহদারণ্যক-৪/৪/২)।। 

তদ্ যথা তৃণজলায়ুকা তৃণস্যান্তং গত্বাহন্যমাক্রমম্ আক্রম্যাত্মানম্ উপসংহরত্যেবং এবায়মাত্মা ইদং শরীরং নিহত্যাহবিদ্যাং গময়িত্বাহন্যমাক্রমং আক্রম্যাত্মানং উপসংহরতি’। 

(বৃহদারণ্যক-৪/৪/৩)।।

অর্থাৎ :

এই শারীর-পুরষ আত্মা দুর্বলতার কারণে যখন সংজ্ঞালোপ পাবার মতো অবস্থায় আসে তখন সবকটি প্রাণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় এসে জড়ো হয় আত্মার কাছে। যে তেজশক্তি নিয়ে ইন্দ্রিয়রা ছিলো প্রকাশমান, করছিলো আপন-আপন নির্দিষ্ট কাজ, তাদের সেই তেজকে নিয়ে প্রবেশ করে হৃদয়ে। সঙ্গত কারণেই চাক্ষুষ-পুরুষ আদিত্যের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে, চোখ আর কেমন করে রূপ দেখবে ? তাই মুমূর্ষুর চোখে কোন রূপই ধরা পড়ে না (বৃঃ-৪/৪/১)। আত্মার সঙ্গে এক হয়ে মিশে গেলে, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না থাকলে কি আর স্বাতন্ত্র্য থাকে ? একীভূত হয়ে থাকার ফলে, লোকে বলে শুনতে, চিন্তা করতে, স্পর্শ করতে পারছে না, কিছু জানতেও পারছে না। সেই সময় তার হৃদয়ের অগ্রভাব দীপ্তিযুক্ত হয়ে ওঠে, প্রকাশিত হয় হৃদয়পথে নির্গমন দ্বার। দেহকে ছেড়ে জ্যোতির সাহায্যে সেই আত্মা জীবের কামনা অনুযায়ী অনুরূপ পথ দিয়ে বেরিয়ে যান। যদি তার সাধনা থাকে আদিত্যলোকের তবে আত্মা নিষ্ক্রান্ত হন চক্ষুপথে, ব্রহ্মলোকের জন্য ব্রহ্মতালু পথে, আবার নানা-বাসনা, নানা কর্মানুসারে অনুরূপ অপরাপর ইন্দ্রিয়পথে। আত্মা নির্গত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যপ্রাণ তাঁর অনুগমন করে, সেই সঙ্গে অপরাপর প্রাণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ও তাঁর অনুগমন করে। আত্মা তখন বিজ্ঞানময়। এই বিজ্ঞানময় আত্মার অনুগমন করে বিদ্যা, কর্ম আর সংস্কার (বৃঃ-৪/৪/২)। জলায়ুক বা জলৌকা অর্থাৎ জোঁক যেমন ঘাসের এক ডগা ছেড়ে আর এক ডগায় গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় নেয়, আত্মাও তেমনি দেহত্যাগের পর অবিদ্যা দূর করে, স্থূল শরীরটাকে পরিত্যাগ করে আশ্রয়রূপ অন্য দেহকে অবলম্বন করে (বৃহদারণ্যক-৪/৪/৩)।


এই শ্রুতিকেই প্রামাণ্য স্বীকার করে তাই বাদরায়ণও বলেন-


‘তদন্তরপ্রতিপত্তৌ রংহতি সম্পরিষ্বক্তঃ, প্রশ্ননিরূপণাভ্যাম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১)।।

‘প্রাণগতেশ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/৩)।।

অর্থাৎ :

জীব সূক্ষ্মভূত-সমন্বিত হয়ে দেহত্যাগান্তে অন্যদেহ প্রাপ্তির জন্য গমন করে- তা শ্রুতি বর্ণিত প্রশ্নোত্তর থেকে অবগত হওয়া যায় (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১)। বৃহদারণ্যক শ্রুতি বলেন যে, জীব উৎক্রান্ত হলে জীবের সাথে ইন্দ্রিয়সকলও গমন করে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/৩)।


এই প্রাণসকল বা সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়সহ উৎক্রান্ত জীব কোথায় গমন করে ? এর একটা বিবরণ ছান্দোগ্য উপনিষদেই পাওয়া যায়। যেমন-


‘স জাতো যাবৎ-আয়ুষম্ জীবতি তং প্রেতং দিষ্টমিতম্ অগ্নয়ঃ এব হরন্তি যত এবেতো যতঃ সম্ভূতো ভবতি’। (ছান্দোগ্য-৫/৯/২)।। 

‘তদ্ য ইত্থং বিদুর্যে চ ইমে অরণ্যে শ্রদ্ধা তপ ইত্যুপাসতে তে অর্চিষম্ অভিসংভবন্তি অর্চিষঃ অহঃ অহ্নঃ আপূর্যমাণপক্ষম্ আপূর্যমাণপক্ষাদ্ যান্ ষট্ উদঙ্ এতি মাসাংস্তান্’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/১)।। 

‘মাসেভ্যঃ সংবৎসরং সংবৎসরাৎ আদিত্যম্ আদিত্যাৎ চন্দ্রমসং চন্দ্রমসো বিদ্যুতং তৎ পুরুষঃ অমানবঃ স এনান্ ব্রহ্ম গময়তি এষঃ দেবযানঃ পন্থাঃ ইতি’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/২)।। 

‘অথ য ইমে গ্রাম ইষ্টাপূর্তে দত্তম্ ইতি উপাসতে তে ধূমম্ অভিসম্ভবন্তি ধূমাৎ রাত্রিম্ রাত্রেঃ অপরপক্ষম্ অপরপক্ষাৎ যান্ ষট্ দক্ষিণা এতি মাসাংস্তান্নৈতে সংবৎসরম্ ন অভি প্রাপ্নুবন্তি’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৩)।। 

‘মাসেভ্যঃ পিতৃলোকং পিতৃলোকাৎ আকাশম্ আকাশাৎ চন্দ্রমসম্ এষঃ সোমো রাজা তৎ দেবানাম্ অন্নম্ তং দেবা ভক্ষয়ন্তি’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৪)।। ‘তস্মিন্ যাবৎ সম্পাতম্ উষিত্বা অথ এতম্ অধ্বানম্ এব পুনঃ নিবর্তন্তে যথা ইতম্ আকাশম্ আকাশাৎ বায়ুম্ বায়ুঃ ভূত্বা ধূমঃ ভবতি ধূমঃ ভূত্বা অভ্রং ভবতি’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৫)।।

অর্থাৎ :

(সন্তান) জন্মগ্রহণ করে যতদিন তার আয়ু ততদিন জীবিত থাকে। (তারপর যখন) যথানির্দিষ্ট রূপে (অর্থাৎ কর্মফল অনুযায়ী লোক লাভের জন্য) দেহত্যাগ করে, তখন (তার পুত্র ও শিষ্যরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য) তাকে ঘর থেকে সেই অগ্নিতে নিয়ে যায়- যে অগ্নি থেকে সে এসেছে, যে অগ্নি থেকে সে উৎপন্ন হয়েছে (ছাঃ-৫/৯/২)। যাঁরা পঞ্চাগ্নিবিদ্যা জানেন এবং যাঁরা অরণ্যে বাস করে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে তপস্যাদি করেন, তাঁরা মৃত্যুর পর অর্চিলোক অর্থাৎ জ্যোতির্লোক প্রাপ্ত হন। (অতঃপর) অর্চি থেকে দিনে, দিন থেকে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের ছয় মাসে- (ছাঃ-৫/১০/১)। সেখান থেকে সংবৎসরে, সংবৎসর থেকে আদিত্যে, আদিত্য থেকে চন্দ্রলোকে এবং চন্দ্রলোক থেকে বিদ্যুৎ-লোক প্রাপ্ত হন। সেই স্থানে (ব্রহ্মলোক থেকে) এক অমানব অর্থাৎ জ্যোতির্ময় পুরুষ এসে তাদের ব্রহ্মলোকে নিয়ে যায়। এই পথই দেবযান অর্থাৎ দেবলোকের পথ (ছাঃ-৫/১০/২)। আর যে সকল গৃহস্থ যজ্ঞ, সমাজসেবামূলক কর্ম এবং দান ইত্যাদি অনুষ্ঠান করেন তাঁরা (মৃত্যুর পর) ধূমকে প্রাপ্ত হন। (তারপর তাঁরা) ধূম থেকে রাত্রি, রাত্রি থেকে কৃষ্ণপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ থেকে দক্ষিণায়ণের ছয়মাসে গমন করেন। এঁরা (দেবযানপথে গমনকারীদের মতো) সংবৎসরকে প্রাপ্ত হন না (ছাঃ-৫/১০/৩)। দক্ষিণায়ণের ছয়মাস থেকে পিতৃলোকে, পিতৃলোক থেকে আকাশে, আকাশ থেকে চন্দ্রলোকে গমন করেন। ইনিই (অর্থাৎ উজ্জ্বল চন্দ্রই) রাজা সোম। ইনি দেবতাদের অন্ন, দেবতারা এঁকে ভোগ করেন (ছাঃ-৫/১০/৪)। কর্মফল ক্ষয় না হওয়া পর্যন্ত চন্দ্রলোকে বাস করে তারপর যে পথে তাঁরা গিয়েছিলেন সেই পথেই পুনরায় (পৃথিবীতে) ফিরে আসেন। তাঁরা প্রথমে আকাশ ও পরে বায়ুকে প্রাপ্ত হন। বায়ু হয়ে ধূম, ধূম হয়ে কুয়াশা হন (ছান্দোগ্য-৫/১০/৫)।


শ্রুতিতে এই যে জীবের উৎক্রমণের পর আবার কর্মফল ভোগের জন্য পৃথিবীতে অবতরণ প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়, তাই বাদরায়ণও বলেন-


‘কৃতাত্যয়ে অনুশয়বান্, দৃষ্টস্মৃতিভ্যাম্ যথেতমনেবং চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/৮)।।

ভাবার্থ : শ্রুতি-স্মৃতি থেকে জানা যায় যে, জীব যে-পথে চন্দ্রলোকে গিয়েছিলো, কর্মফল ভোগের পর আবার সেই পথেই এবং অন্যভাবেও ভুক্তাবশিষ্ট কর্মসহ পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করে (ব্রঃ-৩/১/৮)।


কিন্তু এখানে প্রশ্ন আসে যে, এ সকল ব্যক্তির আত্মা কি বাস্তবিকপক্ষে আকাশ, ধূম ইত্যাদির সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায়, অথবা এরা কি একটি প্রকৃতিগত সাদৃশ্য প্রাপ্ত হয় ? বিষয়টি স্পষ্ট করতে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-


‘তৎসাভাব্যাপত্তিঃ, উপপত্তেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২২)।।

ভাবার্থ : চন্দ্রমণ্ডল হতে অবতরণকালে জীব আকাশাদির সদৃশ হয়। আকাশস্বরূপ হয় না- কারণ সদৃশ হওয়াই যুক্তিসঙ্গত (ব্রঃ-৩/১/২২)।


অর্থাৎ, শ্রুতিটিতে আকাশ ইত্যাদির সাথে অভিন্নত্বের কথা বলা হয়নি। শ্রুতিটির অর্থ হলো, এরা আকাশ ইত্যাদির প্রকৃতিগত একটি সাদৃশ্য প্রাপ্ত হয়- আকাশ, বায়ু প্রভৃতির মতো হয়ে যায়। তার মানে, জীব আকাশের মতো একটি সূক্ষ্ম আকার ধারণ করে বায়ুর অধীনে আসে এবং ধূম ইত্যাদির সাথে সংযুক্ত হয়। এই পুনর্জন্ম প্রক্রিয়ায় তারপরে ছান্দোগ্য উপনিষদে আরো বলা হয়েছে-


‘অভ্রং ভূত্বা মেঘো ভবতি মেঘো ভূত্বা প্রবর্ষতি ত ইহ ব্রীহি-যবাঃ ওষধি-বনস্পতয়ঃ তিলমাষাঃ ইতি জায়ন্তে অতঃ বৈ খলু দুর্নিষ্প্রপতরং যঃ যঃ হি অন্নম্ অত্তি যঃ রেতঃ সিঞ্চতি তৎ ভূয়ঃ এব ভবতি’। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৬)।।

অর্থাৎ :

কুয়াশা হয়ে মেঘ হন, মেঘ হয়ে বর্ষণ করেন। তারপর জীবগণ এই পৃথিবীতে ব্রীহি, যব, ওষধি, বনস্পতি, তিল ও মাষ ইত্যাদি রূপে জাত হন। এই শষ্যাদি থেকে নিষ্ক্রমণ দুঃসাধ্য। (সন্তান উৎপাদনে সমর্থ) যে যে প্রাণী ওই (ব্রীহি প্রভৃতি) অন্ন আহার করে এবং সন্তান উৎপন্ন করে, সেই সেই প্রাণিরূপে জীবগণ পুনরায় জন্মগ্রহণ করে (ছান্দোগ্য-৫/১০/৬)।


এখানে একটি প্রশ্ন উঠে যে, চন্দ্রলোক হতে প্রত্যাবর্তনকারী জীবাত্মা যখন আকাশ, বায়ু প্রভৃতির সাথে সাদৃশ্যপ্রাপ্ত হয় তখন কি তা বেশ দীর্ঘকালই ঐ অবস্থায় থাকে, না কি শীঘ্রই এক অবস্থা হতে অবস্থান্তর প্রাপ্ত হয় ? এবং অন্য প্রশ্নটি হলো, জীবাত্মা কি ব্রীহি ইত্যাদি উদ্ভিজ্জরূপে জাত হয় ? এ প্রেক্ষিতে বাদরায়ণ বলেন-

‘নাতিচিরেণ, বিশেষাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৩)।।

‘অন্যাধিষ্ঠিতে পূর্ববৎ, অভিলাপাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৪)।।

‘রেতঃ-সিক্-যোগঃ অথ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৬)।।

‘যোনেঃ শরীরম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৭)।।

ভাবার্থ :

শ্রুতি বলেন জীবের চন্দ্রলোক হতে নানা অবস্থার (ব্রীহি, যব ইত্যাদি) মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে আসতে বেশি বিলম্ব হয় না। এ বিষয়ে বিশেষ শ্রুতি তাই বলেন (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৩)। জীব ব্রীহি ইত্যাদি রূপ প্রাপ্ত হয় বলা হয়েছে; তার অর্থ হলো সেই সেই ব্রীহিতে অবস্থান হয় মাত্র, কারণ শ্রুতিতে এ প্রসঙ্গে আকাশাদি সম্বন্ধে যেরূপ উল্লেখ আছে, ব্রীহির সম্বন্ধেও সেরূপই উল্লেখ আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৪)। চন্দ্রলোক-প্রত্যাগত জীব ধান ইত্যাদির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার পর যারা শুক্রনিষেক করে জন্মদান করতে সমর্থ তাদের দেহে প্রবিষ্ট হয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৬)। যোনিকে (গর্ভকে) আশ্রয় করেই জীব স্বীয় ভোগায়তনদেহ লাভ করে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/২৭)।।


অতএব, সংক্ষিপ্ত করে বললে, দেহত্যাগান্তে পরলোক ভ্রমণ করে প্রত্যাগত জীব কর্মফল অনুযায়ী ইহলোকে পুনরায় জীবন শুরু করে। পুণ্যবানগণ চন্দ্রলোকে যান। নবকলেবর ধারণের জন্য চন্দ্রমা থেকে মেঘ, জল, অন্নাদির যে রাস্তার কথা উপনিষদে বলা হয়েছে তাতে ফিরে আসতে দেরি হয় না। যে ধান্যশস্যাদির সঙ্গে জীব মাতৃগর্ভে প্রবিষ্ট তাতে সে নিজে নয়, অন্যজীবের অধিষ্ঠাতা হওয়ার সময় এরূপ করে। সুতরাং অবতরণকারী জীবাত্মা অন্য জীবাত্মার দ্বারা (সঞ্জীবিত) প্রাণবন্ত বৃক্ষাদির মধ্যে অবস্থান মাত্র করে- যে পর্যন্ত না নতুন কোন জন্মের সুযোগ পায়। সেই শস্য ভক্ষণের পর আবার রক্ত-বীর্য-যোনির সংযোগ হয়, যার ফলে হয় নতুন শরীর সৃষ্টি। অর্থাৎ পরিশেষে জীবাত্মা একজন সন্তান-উৎপাদনসক্ষম (রেতঃসিঞ্চনকারী) পুরুষের সংস্পর্শে এসে নারীর গর্ভে প্রবেশ করে এবং সেখানে একটি নতুন দেহ লাভ করে, যে দেহ (ছান্দোগ্য-৫/১০/৭ অনুযায়ী) পূর্ব-কৃত-কর্মের ভুক্তাবশিষ্ট ফল ভোগ করার জন্য সমর্থ।

এখানে আরেকটি প্রশ্ন উঠে যে, ইহলোক থেকে যারা উৎক্রমণ করে তাদের সকলেই কি চন্দ্রলোকে গমন করে থাকে ? যে-সকল জীবের কর্মফল চন্দ্রলোক গমনের পক্ষে যথেষ্ট নয়, অর্থাৎ যারা যজ্ঞাদি বা কোন ধর্মানুষ্ঠান করে না, কিংবা অনিষ্টকারী ব্যক্তি, মৃত্যুর পর তাদের কী গতি হয় ? এ বিষয়ে ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে-

‘অথ এতয়োঃ পথোর্ন কতরেণচন তানীমানি ক্ষুদ্রাণি অসকৃৎ আবর্তীনি ভূতানি ভবন্তি জায়স্ব ম্রিয়স্ব ইতি এতৎ তৃতীয়ং স্থানম্ তেন অসৌ লোকঃ ন সম্পূর্যতে তস্মাৎ জুগুপ্সেত’।। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৮)।।

অর্থাৎ :

যারা (অর্থাৎ যে জীবগণ উপাসনা বা ইষ্টপূর্তাদি কর্ম করে না) উভয় পথের কোন পথ দিয়েই যায় না, তারা পুনঃ পুনঃ (জন্ম-মৃত্যু চক্রে) আবর্তনশীল ক্ষুদ্র প্রাণিরূপে জন্মগ্রহণ করে। (এদের বিষয়ে বলা যায়)- জন্মাও আর মরো (অর্থাৎ এরা এতো ক্ষণস্থায়ী যে জন্মগ্রহণ করেই মরে যায়। জন্ম-মৃত্যু ছাড়া এদের জীবনে অন্য কোন ঘটনা নেই)। এই হলো তৃতীয় স্থান। এজন্যেই এই লোক (অর্থাৎ স্বর্গ বা চন্দ্রলোক) পূর্ণ হয় না। সুতরাং (এই গতিলাভকে) ঘৃণা করবে (ছান্দোগ্য-৫/১০/৮)।


অর্থাৎ অনিষ্টকারী ব্যক্তি স্বর্গে গমন করে না। তাহলে কোথায় যায় ? সংশয় দূর করতে বাদরায়ণ বলেন-


‘সংযমনে তু অনুভূয় ইতরেষাম্ আরোহাবরোহৌ, তদ্গতিদর্শনাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৩)।।

ভাবার্থ : অনিষ্টকারী ব্যক্তি যমলোকে গমন করে; কারণ অনিষ্টকারীর সংযমী নামক যমপুরে যাওয়ার কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে (ব্রঃ-৩/১/১৩)।


কারণ, কঠ উপনিষদে বলা হয়েছে-

‘ন সাম্পরায়ঃ প্রতিভাতি বালং প্রমাদ্যন্তং বিত্তমোহেন মূঢ়ম্ ।

অয়ং লোকো নাস্তি পর ইতি মানী পুনঃ পুনর্বশম্ আপদ্যতে মে’।। (কঠোপনিষদ-১/২/৬)।।

অর্থাৎ :

যম বলছেন, সংসারী মানুষ মাত্রই নিজ নিজ পরিবারের প্রতি অতিশয় আসক্ত। ধন-সম্পদের মোহ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তাদের বুদ্ধি অপরিণত। তারা তাদের চারপাশের জগৎকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করে। এর বাইরেও যে একটা জগৎ আছে, সে খোঁজ রাখে না। ইহলোকই আছে, পরলোক বলে কিছু নেই- যে-ব্যক্তি এ কথা মনে করে সে বারবার আমার অধীন হয়। অর্থাৎ তার পুনঃ পুনঃ জন্মমৃত্যু ঘটে থাকে (কঠ-১/২/৬)।


চন্দ্রলোকে আরোহণ শুধুমাত্র শুভকর্মের ফল ভোগেরই জন্য- অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। সুতরাং অনিষ্টকারিরা চন্দ্রলোকে যায় না। তাদের গন্তব্য হয় নরকে। কৃতকর্মের কষ্টভোগের মাধ্যমে পাপমুক্ত হয়ে পূর্ব-কৃত-কর্মের ভুক্তাবশিষ্ট ফল ভোগ করার জন্য পুনরায় জন্মগ্রহণ করে জীব দেহধারী হয়। তাই বাদরায়ণ বলেন-


‘স্মরন্তি চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৪)।।

‘অপি চ সপ্ত’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৫)।।

‘বিদ্যাকর্মণোঃ ইতি তু প্রকৃতত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৭)।।

ভাবার্থ :

স্মৃতিশাস্ত্রেও (যথা মনুস্মৃতি) পাপীদের নরক গমনের কথা দৃষ্ট হয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৪)। অধিকন্তু পাপীদের ভোগের জন্য সাতটি নরক আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৫)। পাপীদের চন্দ্রলোকে গমন হয় না, কারণ, বিদ্যাদ্বারা দেবযান এবং কর্মের দ্বারা পিতৃযান প্রাপ্তির কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/১/১৭)।

হারিদ্বার

হারিদ্বার

এখনো এই শরীরে শিবপুত্রী মা নর্মদার দর্শনলাভ হয়নি আমার। তবে শুনেছি মা গঙ্গা সারাদিন ধরে গঙ্গোত্রী থেকে সাগর পর্য্যন্ত গোটা তট জুড়ে সমস্ত পাপীতাপি স্নানার্থীদের মনঃক্লেদ নিজের শরীরে ধারণ করে একটি কৃষ্ণবর্ণ গাভীর রূপ ধরে সন্ধ্যায় পরমপাবন রেবানদীতে অবগাহন করেন আর স্নানের পর শ্বেতশুভ্র নির্মল গোরূপ ধরে শুচিশুদ্ধা হয়ে উঠে আসেন। মহাদেবকন্যার পবিত্র সলিল-শরীর স্পর্শ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে বহুবার পবিত্র গঙ্গাদর্শন এবং গঙ্গাস্নানের সৌভাগ্য হয়েছে এবং সেই সূত্রে মা গঙ্গার সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে গোটা জীবন জুড়ে। এই সম্পর্কটি বোধহয় শুধুমাত্র এক জন্মের নয়, হয়তো জন্মান্তরেরও। আর এই যোগসূত্র কিন্তু ভাগীরথী-হুগলি তীরবর্তী কলকাতাবাসের সুবাদে নয়, মূলতঃ হরিদ্বারের কল্যাণে। কোনোদিন হরিদ্বারের অভিজ্ঞতার কথা আগে লিখিনি, গিন্নি এবং দুজন বন্ধু ছাড়া বলিওনি কাউকে। 


যখনই শুনি পরিচিত কেউ হরিদ্বার যাচ্ছেন বা হরিদ্বার পেরিয়ে দেবভূমিতে আরো ওপরে যাবেন, মনটা কেমন যেন বড্ড বেশি 'যাই যাই' করে নেচে ওঠে। বহুদশক আগে যেবার প্রথম হরিদ্বার দর্শন করি, সেবার রাস্তায় চলতে চলতে মনে হয়েছিল এসব আমার খুব চেনা। রামঘাটে সন্ধ্যায় বসে থাকতে থাকতে মনে হয়েছিল এই জায়গা আমার চেনা, এর বাতাসের গন্ধ আমার চেনা, এর প্রকৃতিও আমার চেনা। তারপর বহুবার ফিরে ফিরে গেছি হরিদ্বারে, সুযোগ পেলেই কিছুদিন করে থেকেছি, আর পায়ে হেঁটে সকাল থেকে সন্ধ্যে অলিতেগলিতে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে সূর্যাস্ত হয়ে গেছে, টেরটিও পাইনি। হরিদ্বার আমায় টানে, ভীষণভাবে টানে। হরিদ্বার আমার নিজস্ব জায়গা, এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। ওখানে যে শরীরের বাস ছিল তার ঠিকানা হয়তো এই শরীর জানেনা, সেই শরীরের আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবদের কথা হয়তো এখনকার শরীরের স্মরণে নেই, কিন্তু স্থানমাহাত্ম যাবে কোথায়? 


তবে একেবারে কিছুই কি মনে নেই? যে ক'বারই গেছি, প্রথম দর্শনেই বড় আপন মনে হওয়া গঙ্গাপারের একটি নির্দিষ্ট বহুপুরানো একতলা বাড়ির আশেপাশে পান্থশালা খুঁজে নিয়েছি প্রতিবার, ইচ্ছে করে। আশেপাশে ঘুরতে ফিরতে বারবার ওটার কালো রংচটা খোলা বা বন্ধ দরজাটার দিকে অজানা তৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে থেকেছি। প্রতিবার অনেকখানি হেঁটে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট দোকানে মাটির ভাঁড়ে গরম দুধ খেয়ে অন্যান্য সব জায়গার চেয়ে বেশি তৃপ্তি পেয়েছি আর গঙ্গার তীরে যেখানে এখন পুণ্যার্থীরা কমার্শিয়াল গঙ্গা আরতির জন্য ভিড় জমান, সেসব পেরিয়ে নির্জন শ্রীগঙ্গাজি মহারাজ ভগীরথজির প্রাচীন মন্দিরের চাতালে নিভৃতে গঙ্গাস্তব গেয়ে অনাবিল আনন্দ পেয়েছি। কয়েকবার মনে হয়েছে ওই ক্ষয়া ক্ষয়া বাড়িটার ততোধিক ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের সদর দরজাটা ঠেলে খুলে ভেতরের শানবাঁধানো উঠোনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াই, বাড়ির ভেতরটা একটু ভালো করে দেখি, কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠিনি। হয়তো সবটাই কল্পনা, শুধুমাত্র বুকের টানটা ছাড়া। তিনদশক ধরে অনেক চলমান ছবি তুলেছি হরিদ্বারের, সেসব কোনো এক হার্ডডিস্কে বন্ধ রয়েছে, ইচ্ছে করলেই মনের স্ক্রিনে ফুটিয়ে তোলা যায়। বড় চেনা, বড় চেনা এই শহর। আগামীকাল গিন্নি রওনা হচ্ছেন দেবভূমির উদ্দেশ্যে, হরিদ্বার হয়েই যাবেন এবং ফিরবেন। আমারও ইচ্ছে করছে দৌড়ে পৌঁছে যাই, মা গঙ্গার দর্শন করি, গঙ্গাস্নান করে স্নিগ্ধ হৈ, কিন্তু এবারে আর হলো না। হয়তো পরে কোনো একদিন অথবা পরের কোনো এক শরীরে আবার - কে জানে?


সদ্যঃ পাতকসংহন্ত্রী সদ্যোদুঃখবিনাশিনী।

সুখদা মোক্ষদা গঙ্গা গঙ্গৈব পরমা গতিঃ।।


২০১১সালে মনে হয়েছিল এবারে হয়তো হরিদ্বারে একটা স্থায়ী আস্তানা গড়া যাবে, শেষমেশ আশাপূরণ হয়নি। তার পরের বছর একটি পোস্টে গঙ্গাদ্বার হরিদ্বার সম্পর্কে লিখেছিলাম:

Gangadwára.....where the palace of King Daksha used to be and where lived Lord Shiva's consort Devi Sati......where a drop of Amrit fell in what is now called the Brahma Kund during the churning of the oceans or Samudra Manthan, spilled accidentally from the pitcher carried by Garuda.......which is refered to as a Tirtha by Rishi Dhaumya to Yudhistir in the Vanaparva of the Mahabharat.......where Rishi Agastya did his penance with the help of his wife Lopamudra........where Sage Kapila is said to have an ashram giving it another ancient name Kapila or Kapilastan.........now known both as Haridwar (gateway to Lord Vishnu in Badrinath) and Hardwar (gateway to Lord Shiva in Kedarnath)