আমি যখন 'আমি' বলছি তখন একজনকেই বোঝাচ্ছি, singular number, একবচন - নিজেকে, অর্থাৎ নিজেকে আমি যা বলে মনে করি, তাকে। সেটা যদি আয়নায় দেখা আকারটি হয় তাহলে তাইই। কিন্তু সেই আমিই যখন 'তুমি' বলছি তখন কিন্তু সেটি অনেকজনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য - তুমি, তুমি এবং তুমি - plural number, বহুবচন, যদিও ব্যাকরণের হিসেবে ওটিও একবচনই বটে।
এখন, 'আমি' যেমন specific, যতক্ষণ না পরমজ্ঞান হচ্ছে ততক্ষণ স্থান ও কাল নির্বিশেষে অপরিবর্তিত, 'তুমি' কিন্তু স্থান কাল পাত্র অনুযায়ী বদলে বদলে যেতে পারে। এক্ষুনি ঘরের ভেতরে গিন্নিকে তুমি বললাম, পরক্ষণেই রাস্তায় বেরিয়ে প্রতিবেশীকে তুমি বললাম আবার তারপর অফিসে পৌঁছে সহকর্মীকে তুমি বললাম - সবাই 'তুমি', সবাই বুঝলেন সেই বিশেষ সময় এবং সেই বিশেষ স্থানে specifically তাঁকেই সম্বোধন করছি, অর্থাৎ ডাকটা 'তোমরা'র মতন generalised নয় অথচ 'আমি'র মতন specificও নয়।
'আমি' ধ্রুবক কিন্তু 'তুমি' পরিবর্তনশীল, যদিও ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দুটিই কিন্তু attached to a particular individual and indicative of only that person at any given time and space - বিশেষক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের নির্দিষ্ট পরিচায়ক। এর বিশেষত্ব হলো কে যিনি 'তুমি' বলে ডাকছেন তাঁর মনে যেমন সেই সময় যাঁকে ডাকছেন তাঁর identity নিয়ে কোনো ambiguity নেই, তেমনি যিনি সারা দিচ্ছেন তাঁর মনেও কিন্তু তাঁকেই যে ডাকা হচ্ছে - সে বিষয়ে কোনো ambiguity নেই। এই যে দুতরফেই given time and space এ understanding of identity থাকে, সেটাই দুটি ভিন্নস্বত্তার মধ্যে singular যোগসূত্র তৈরি করে দেয়। খুব জটিল ব্যাপার, তাইনা?
বস্তুর ব্যাপারে সমস্যা কিন্তু আরো জটিল। 'গেলাস', 'জলের গেলাস', 'আমার জলের গেলাস' আর 'আমার নীলরঙের কাঁচের জলের গেলাস' এক হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। অন্যদিকে 'আমি' এবং 'তুমি' দুজনেই যে মানুষ সে বিষয়ে যেমন চরিত্রগত কোনো confusion নেই, বস্তুর ক্ষেত্রে কিন্তু বস্তুর বস্তুর ওপর তার চরিত্র নির্ভর করে, আবার করেও না। কাঁচের গেলাস, কাঁসার গেলাস আর রূপোর গেলাস যদিও উপাদানের নিরিখে চরিত্রগতভাবে একেবারেই এক নয়, কিন্তু উপযোগিতার দিক দিয়ে একই। কাঁচ একটি বস্তু আর গেলাস একটি আকৃতি বিশেষ - দুটির চরিত্র মিলে সহজেই যখন একটি বস্তুবিশেষ হয়ে যায় তখন তাদের পৃথক করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এর মধ্যে অবশ্য নিত্য আর অনিত্যের মানকের বিষয়টিও এসে পড়ে। যদিও শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন যা কিছু নিত্য তাই সত্য আর যা কিছু অনিত্য তাই অসত্য, কেবলমাত্র বিষয়টি সহজতর করার জন্য আমরা এখানে ক্ষণস্থায়ী আর দীর্ঘস্থায়ী দুটি বস্তুর মধ্যে তুলনা টানবো। উদাহরণস্বরূপ, একটা পাহাড় যেহেতু একজন মানুষের চেয়ে ঢের বেশি বছর অক্ষত থাকে, তাই বর্তমানে সেই পাহাড়ের মালিক যেটিকে 'আমার পাহাড়' বলে স্বত্ব আরোপ করেন, ভবিষ্যতে তাঁর মৃত্যুর পর নতুন মালিক একইভাবে ওই পাহাড়টিকেই আবার 'আমার পাহাড়' বলে স্বত্ব আরোপ করেন - তাতে কিন্তু পাহাড়ের চরিত্র একবিন্দু পাল্টে যায় না। অর্থাৎ 'আমি' পাল্টে গেলেও বস্তু পাল্টায় না, যদিও তার আরোপিত ও কৃত্তিম 'মালিকানা'র বর্ণনা পাল্টে যায়।
আবার এর উল্টোটাও হয়। ছাতুবাবু-লাটুবাবু কবে শরীর ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু উত্তর কলকাতায় ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ি এখনো ওই নামেই খ্যাত, যদিও তার এখনকার প্রজন্মের মালিকরা আলাদা। তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়ালো? বস্তু 'আমি'র নামে পরিচিত হতে পারে কিন্তু তাতে বস্তুর কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়না - পাহাড় পাহাড়ই থাকে এবং বাড়ি বাড়িই। যত গোলযোগ কেবল 'আমি' আর 'তুমি'র মধ্যে বস্তু ঢুকে পড়লে। মজার ব্যাপার হলো বস্তুর ক্ষেত্রে সোনার আংটি থেকে সোনা নিয়ে নিলে আর আংটি অবশিষ্ঠ থাকে না, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে আমি থেকে 'আমি' নিয়ে নিলে বা তুমি থেকে 'তুমি' নিয়ে নিলে কি হয়? ওইখানেই অদ্বৈত বেদান্তের শুরু।
এত কথার প্রয়োজন কি? প্রয়োজন এই যে সাধারণত আমি, তুমি আর বস্তু নিয়েই জগৎ সংসার আর এদের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রকৃত অর্থ বোঝবার জন্যই কখনো গৌতম বুদ্ধ বোধিবৃক্ষের তলায় তপস্যায় বসেন বা মানুষকে এর অর্থ বোঝাবার জন্য কখনো আচার্য্য শঙ্কর ঘুরে ঘুরে সারা দেশের চারটি কোনায় চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। আবার অন্যদিকে এই একই বিষয়ে অবুঝ হলে কখনো কার্ল মার্ক্সের তল্পীবাহকেরা বস্তুর অধিকার আমার না তোমার - এই প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে কয়েক কোটি মানুষকে খুন করে বসে আর চীন অবলীলায় নানান অন্যদেশকে জোর করে নিজের দেশ বলে অধিগ্রহণ করে নেয়।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, 'তুমি আর তোমার' - এইটি জ্ঞান। 'আমি আর আমার' - এইটি অজ্ঞান। হে ঈশ্বর, তুমি কর্তা আর আমি অকর্তা - এইটি জ্ঞান। হে ঈশ্বর দেহ মন গৃহ পরিবার জীব জগৎ - এ সব তোমার, আমার কিছুই নয় - এইটির নাম জ্ঞান। যে অজ্ঞান সেই বলে ঈশ্বর 'সেথায় সেথায়' - অনেক দূরে। যে জ্ঞানী সে জানে ঈশ্বর 'হেথায় হেথায়' - অতি নিকটে হৃদয়মধ্যে অন্তর্যামীরূপে, আবার নিজে এক একটি রূপ ধরে রয়েছেন।
তুমি, তুমি আর তুমি - বহুরূপে সম্মুখে তুমি, তবু 'সেথায় সেথায়' করে আমরা ঈশ্বরকে অন্যত্র খুঁজে মরি। বস্তুতঃ 'আমি' আর 'তুমি' যে একই, সেই একই অদ্বৈত স্বত্তা, তোমার আর আমার মধ্যে যে পৃথক কোনো কিছু নেই, সে কথা বুঝতে বুঝতেই তো কত কত জন্ম জন্মান্তর কেটে যায়, তারপর হয়তো তাঁর কৃপা হয়। বস্তুত, গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোনো বহুবচন নেই, সবটা মিলিয়ে একটাই একবচন। আত্মা চেতন, সদামুক্ত তবু সে জড়ে আসক্তিবশতঃ জীবরূপে দেহবোধে আবদ্ধ থাকে, ফলে তার এক কৃত্তিম অবস্থা এবং অন্য এক কৃত্তিম অবস্থার মধ্যে পার্থক্য খুঁজতে যাওয়াটা কেবল অর্থহীন বস্তুবিচারের বিষয়মাত্র। তবে বৈচারিকস্তরে সমস্ত প্রানীতে এক অবিভক্ত চিন্ময়ভাব দর্শন কল্পনা করা গেলেও মনেপ্রাণে তা বিশ্বাস করা এবং সেইভাবে নিজের 'আমি'কে 'তুমি'তে মিশিয়ে দেওয়াটি কিন্তু খুব খুব শক্ত কাজ এবং গুরুকৃপা ছাড়া সম্ভবই নয়।
১৮৬৮ সালে শ্রীরামকৃষ্ণদেব কাশীতে ত্রৈলঙ্গস্বামীকে দর্শন করতে গিয়েছিলেন। ঠাকুর তাঁকে বলতেন 'হাঁটা-চলা করা, কথা বলা কাশীর জ্যান্ত বিশ্বেশ্বর'। মণিকর্ণিকা ঘাটে গিয়ে ঠাকুর দেখলেন ত্রৈলঙ্গস্বামী সেখানে শুয়ে আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পদধ্বনি শুনে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন তিনি। কেউই কোনো কথা বললেন না। শুধু দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমেই সেরে নিলেন ভাবের আদানপ্রদান। তখনই ইশারায় ঠাকুর প্রশ্ন করলেন, "ঈশ্বর এক না অনেক?" স্বামীজী ইশারাতেই তাঁকে উত্তর দিলেন, "সমাধিস্থ হয়ে দেখলে এক, না হলে যতক্ষণ আমি, তুমি, জীব, জগৎ ইত্যাদির ভেদ রয়েছে ততক্ষণ অনেক।"
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের একেবারে শেষে সঞ্জয়ের কথা দিয়ে গীতা শেষ হচ্ছে। সেখানে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন,
রাজন্ সংস্মৃত্য সংস্মৃত্য সংবাদমিমমদ্ভুতম্।
কেশবার্জুনয়োঃ পুণ্যং হৃষ্যামি চ মুহুর্মুহুঃ।।৭৬।।
তচ্চ সংস্মৃত্য সংস্মৃত্য রূপমত্যদ্ভুতং হরেঃ।
বিষ্ময়ো মে মহান্ রাজন্ হৃষ্যামি চ পুনঃ পুনঃ।।৭৭।।
যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ।
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতির্ধ্রুবা নীতির্মতির্মম।।৭৮।।
অর্থাৎ
হে রাজন্! শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের এই পুণ্যজনক অদ্ভুত সংবাদ স্মরণ করতে করতে আমি বারংবার রোমাঞ্চিত হচ্ছি। ৭৬
হে রাজন্! শ্রীকৃষ্ণের সেই অত্যন্ত অদ্ভুত রূপ স্মরণ করতে করতে আমি অতিশয় বিস্ময়াভিভূত হচ্ছি এবং বারংবার হর্ষান্বিত হচ্ছি। ৭৭
যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ এবং যেখানে ধনুর্ধর পার্থ, সেখানেই নিশ্চিতভাবে শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি বর্তমান থাকে। সেটিই আমার অভিমত। ৭৮
সঞ্জয় কাদের মধ্যে পুণ্যজনক অদ্ভুত সংবাদ শুনে রোমাঞ্চিত? তুমি ও আমি, ঈশ্বর ও জীব, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সংবাদ - যেখানে স্রষ্টা কৃপা করে divergence ও delusionকে convergence ও truthএ পরিণত করছেন, দ্বৈতবোধ থেকে অদ্বৈতবোধে উত্তরণ ঘটাচ্ছেন, আত্মার আসক্তি সরে গিয়ে পরমাত্মার সাথে তার সাক্ষাৎকার ঘটছে। কোন অত্যন্ত অদ্ভুত রূপ স্মরণ করতে করতে সঞ্জয় অতিশয় বিস্ময়াভিভূত এবং বারংবার হর্ষান্বিত হচ্ছেন? তিনি বিশ্বরূপ দর্শন করেছেন। তিনি দেখেছেন যে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কিছুই আলাদা নয়, জড় ও চেতন অর্থাৎ বস্তু এবং জীব সব একই নির্গুণ ব্রহ্মের স্বগুণ রূপ এবং এই পরমজ্ঞানের চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু নেই। আর একদম শেষে সঞ্জয় যে 'শ্রী, বিজয়, অসাধারণ শক্তি ও নীতি'র কথা বলছেন সেটা হলো নিষ্কাম কর্মের outcome - কর্মফলের কামনা ত্যাগ করতে পারলে যোগেশ্বরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ হয়। এর ফলে যে আত্মবোধের শক্তি উৎপন্ন হয়, তার দ্বারা মায়াকে জয় করে জীবনের আসল উদ্দেশ্য অর্থাৎ ব্রহ্মত্ব অর্জন করা যায়। এটাই সমাধি। এটি পুরোটাই কিন্তু একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা, শোনা কথা নয়।
আর যাঁর সত্যি সত্যিই সমাধির অনুভব হয়েছে, যিনি নিজে এই পরম অবস্থাকে experience করেছেন, সেই স্বামী বিবেকানন্দ এইভাবে তাঁর অনুভূতিকে বর্ণনা করেছেন:
নাহি সূর্য নাহি জ্যোতিঃ নাহি শশাঙ্ক সুন্দর।
ভাসে ব্যোমে ছায়া-সম ছবি বিশ্ব-চরাচর॥
অস্ফুট মন আকাশে, জগত সংসার ভাসে,
ওঠে ভাসে ডুবে পুনঃ অহং-স্রোতে নিরন্তর॥
ধীরে ধীরে ছায়া-দল, মহালয়ে প্রবেশিল,
বহে মাত্র ‘আমি আমি’ - এই ধারা অনুক্ষণ॥
সে ধারাও বদ্ধ হল, শূন্যে শূন্য মিলাইল,
‘অবাঙমনসোগোচরম্’, বোঝে প্রাণ বোঝে যার॥
মানসিকভাবে এখন যে যেখানে আছি সেইখান থেকে এইখানে পৌঁছতে হবে। হয়তো আরো অনেকগুলো জন্ম লেগে যাবে, হয়তো রাস্তাটা সহজ হবে না, কিন্তু এই গোটা journeyটাতে যাতে লক্ষ্যে অবিচল থাকতে পারি, সেটাই আমাদের আসল প্রার্থনার বিষয়। 'আমি' নয় - 'তুমি', আবার 'তুমি' নয় - 'আমি', কোনো এক শুভক্ষণে সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যাক।