Saturday, February 24, 2024

লাটু মহারাজ

 কাশীর রামকৃষ্ণ মিশনের দোতলায় লাটু মহারাজের ঘরে তাঁর এই তৈলচিত্রটি আছে, আর তার ঠিক উল্টোদিকে তাঁর খাটের পাশের দেওয়ালে আছে মা কালীর এই দিব্য ছবিটি। আসলে মহারাজ মঠে খুব কমই থেকেছেন, উনি মাঠে ঘাটেই থাকতেন বেশি আর শেষে কয়েকবছর ছিলেন বাঙালিটোলায় একটি বাড়িতে, ওনার শরীর যাওয়ার পর ওখান থেকেই ওনার ব্যবহৃত জিনিষপত্তর মঠের এই ঘরে এনে রাখা হয়। আমি ভেজানো দরজা ঠেলে ঐ ঘরে যখন ঢুকেছিলাম, ওই বিশেষ গন্ধটা নাকে আসতেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল - সেই গন্ধটা যা একমাত্র প্রাচীন সাধুদের ঘরে পাওয়া যায়। লাটু মহারাজের মধ্যে ঠাকুর ছাড়া আর কিছু নেই - নিরক্ষর ছিলেন, ফলে শুনেছেন প্রচুর কিন্তু নিয়েছেন সেটুকুই যেটুকু ঠাকুরের কাছে যা শিখেছেন তার নিরিখে ওনার মান্য বলে মনে হয়েছে। 


যদিও বলাটা হয়তো politically incorrect হবে, ব্যক্তিগতভাবে আমার লাটু মহারাজকে ঠাকুরেরই extension বলে মনে হয়, যদিও তাঁর সব পার্ষদরাই তাঁর নিজের হাতে গড়া। আমি শ্রীশ্রীলাটুমহারাজের বিশাল বড় fan - এই সিদ্ধপুরুষের মুখের প্রতিটি কথা আমার কাছে সাক্ষাৎ দৈববাণী। আর এই যে মিশনের কর্মকান্ড থেকে তাঁর কন্সিয়াসলি দূরে থাকা এবং ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে সাধনায় ডুবে থাকা, এটাও কিন্তু ঠাকুরের ইচ্ছাতেই হয়েছে, কারণ লাটু মহারাজের সাথে ঠাকুরের সম্পর্কটা ছিল সর্বাঙ্গীন - শিক্ষক-ছাত্র, গুরু-শিষ্য, ইষ্ট-ভক্ত, প্রভু-ভৃত্য, সেবিত-সেবক, সবরকমের। তাঁর জন্মতিথি অজ্ঞাত, তাই আজকের এই মাঘী পূর্ণিমাকেই তাঁর জন্মতিথি বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। মহারাজের দিব্য শ্রীচরণে আমার ভূমিষ্ট প্রণাম জানাই।


|| অ দ্ভু ত আ ন ন্দ ||


লাটু মহারাজ একদিন বলিয়াছিলেন — "সংস্কার যাওয়া খুব কঠিন—ভগবানের কৃপা ভিন্ন যায় না। অনেক বড় লোকের ছেলে, কোনও অভাব নেই, তবুও চুরি করে। পূর্ব জন্মের সংস্কার। সেই জন্যই তো জন্মান্তর মানতে হয়। শাস্ত্রে বলেছে — জন্মগ্রহণ করে ভালো কাজ করলে মঙ্গল হয়। 

ভাইয়ে ভাইয়ে মিল থাকা খুব দরকার। সকলে সমান রোজগার করতে পারে না। হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না।"


যে বেশী রোজগার করিতে অক্ষম, তাহাকে বলিতেন, "এ সংসার ক'দিনের জন্য। বেশী ভাবিস না, কোনও রকমে সংসার চলে গেলেই হল।"


শ্রীশ্রীমা বলিয়াছিলেন "লাটু কি কম গা? সে সময় লাটু আমার কত কাজ করত। অন্য ছেলেরা আমার সামনে আসতে পারত না।"


একবার এক জনৈক ভক্তকে শ্রীশ্রীমা মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিয়া বলিয়াছিলেন "লাটুর সেবা করলে তোমার কল্যাণ হবে।"

(মূলগ্রন্থ : অদ্ভুতানন্দ প্রসঙ্গ, সংকলক : স্বামী সিদ্ধানন্দ, পৃ.: ১২৫-১২৬)


স্বামী গৌরীশানন্দ — শরৎ মহারাজ একবার লাটু মহারাজকে দেখতে গিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। তাতে ভূমানন্দ স্বামীর মনে হলো— ইনি গুরুভ্রাতা, কত বিদ্বান, পণ্ডিত! ইনি লাটু মহারাজকে প্রণাম করলেন কেন? কথাটা আলোচিত হতে লাগল। অবশেষে শরৎ মহারাজকে প্রশ্ন করা হলো। শরৎ মহারাজ বললেন, "লাটু কত আগে ঠাকুরের কাছে গিয়েছে। ঠাকুরের সমাধি, ভাবের সময় কত দেখেছে, শুনেছে—তাঁকে নানা নাম শুনিয়ে সমাধি ভাঙিয়েছে। আমাদের এখন যে-অবস্থা লাটু বহু দিন আগে তা লাভ করেছে। ও আমাদের চেয়ে ঢের বড়। গুরুতুল্য পূজার পাত্র।"

(লাটু মহারাজের স্মৃতি,  মূলগ্রন্থ : প্রাচীন সাধুদের কথা (দ্বিতীয় খণ্ড) সম্পাদক : স্বামী চেতনানন্দ, পৃ.: ১০-১১)

Friday, February 16, 2024

বাংলায় দেবী সরস্বতীর আবাহন মন্ত্র

 মধুর মধুর ধ্বনি বাজে

হৃদয়কমলবনমাঝে॥


নিভৃতবাসিনী বীণাপাণি   অমৃতমুরতিমতী বাণী

হিরণকিরণ ছবিখানি-- পরানের কোথা সে বিরাজে॥


মধুঋতু জাগে দিবানিশি   পিককুহরিত দিশি দিশি।

মানসমধুপ পদতলে   মুরছি পড়িছে পরিমলে।


এসো দেবী, এসো এ আলোকে,   একবার তোরে হেরি চোখে--

গোপনে থেকো না মনোলোকে   ছায়াময় মায়াময় সাজে॥


অর্থ : 

হৃদয় নামক পদ্মবনে তিনি বিচরণ করছেন, তাঁর নূপুরধ্বনির মধুর সুর মনের মধ্যে শোনা যাচ্ছে।


তিনি বীণাপাণি, সারদা, সরস্বতী - তিনি নিভৃতবসিনী, গোপনচারিণী, কারণ বিদ্যা আত্মস্থ করতে হয়, আত্মসাৎ করতে হয়, বিদ্যা জাহির করার বিষয় নয়। তাঁর বাণী সাক্ষাৎ অমৃত যা হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে সে আত্মবোধ জাগরিত করে মরণের পারে নিয়ে যায়, মোক্ষপ্রদান করে। 'হিরণকিরণছবি', অর্থাৎ, তিনি সোনার মত উজ্জ্বল প্রভাযুক্ত। তা মা সরস্বতী কোথায় বিরাজ করেন? ঘুরেফিরে সেই শুরুর কথা - হৃদয়কমলবনে, হৃদয়কে আলোকিত করে থাকেন। 


আমার হৃদয়ে যেহেতু স্বয়ং পরমজ্ঞানদাত্রী বিরাজ করেন, ফলে আমার অন্তরে চিরবসন্ত আর সেখানে ডালে ডালে বসন্তের অগ্রদূত কোকিল ডাকে। অন্তরে চিরবসন্ত অর্থাৎ মন নিত্য সৃজনশীল, নিত্য ক্রিয়াশীল, নিত্য চিন্তাশীল - সেখানে ক্রমাগত শ্রবণ মনন আর নিদিধ্যাসন ঘটে চলেছে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, 'if the cuckoo sings, can spring be far behind?' বসন্তে কোকিলের ডাকের সাথেই শুরু হয় নতুন পাতার উদ্গম, নতুন প্রাণের সঞ্চার - নতুন সৃজনের আভাস পাওয়া যায় - নতুন আশা, নতুন আকাঙ্খা, নবযৌবন। আধাত্মপথের পথিকের ক্ষেত্রে এর অর্থ নতুন উদ্যম, নতুন করে কাজে লেগে পড়া, যাতে মায়ের কৃপায় এই শরীরেই মনুষ্যজন্মের আসল উদ্দেশ্য সাধন করা সম্ভব হয়।


'মানসমধুপ', অর্থাৎ আমার মনরূপী ভ্রমর, এই হৃদকাননের পরিমলে অর্থাৎ পুষ্পসৌরভে কমলাসনা দেবীর পদতলে মুর্চ্ছিত হয়ে আছে। এ মূর্ছার অর্থ কি? পার্থিব চাওয়া-পাওয়া, লোভ-লালসা ইত্যাদির চাহিদা লোপ পাওয়া, সেই অর্থে সংজ্ঞাহীন হওয়া, আর চেতনের সৌরভে সুরভিত হওয়া। 


দেবী অন্তরালবাসিনী। মনের গহনে লুকিয়ে রয়েছেন। আসলে, আমার মনের মধ্যে 'আমি' সম্পর্কে যে প্ৰশ্ন জাগরিত হয়েছে, যা ধীরে ধীরে আমায় আধ্যাত্মপথের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেই প্রশ্নের অন্তরেই সারদার বাস। সেই মুর্তিমতী জ্ঞানকে এই বিশেষ দিনে শুভ্রা, হংসবাহিনী মূর্তিতে চোখের সামনে প্রকাশিত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তিনি বলছেন, "এস দেবী এস, এ আলোকে, একবার তোরে হেরি চোখে"। এখানে তাঁর নিরাকারকে সাকারে দেখার তীব্র ইচ্ছাই প্রকাশিত হচ্ছে।

Wednesday, February 14, 2024

নিজধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ

 একজন অতি সজ্জন বন্ধুকে দেখলাম বসন্ত পঞ্চমীর দিন একটি কবরে হলুদ গাঁদার চাদর চড়ানো হচ্ছে দেখে 'এটাই আমার ভারত' বলে আপ্লুত হয়ে পড়েছেন। আমি তাঁর ভাবনাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু যাঁর কবর, তৎকালীন ভারতের আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর নাস্তিবাচক ভূমিকা কি ছিল বা বহুত্ববাদ সম্পর্কেই বা তাঁর অবস্থান কি ছিল, সেটা জানলে বোধহয় ওঁর উচ্ছাসটি কিছু কম হতো। যাঁরা ছোটবেলা থেকে 'আল্লা কে বন্দে' বা 'Son of God' শুনে শুনে বড় হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে 'अहम् ब्रह्मास्मि' - আমিই ব্রহ্ম - এই মহাবাক্যের প্রকৃত দ্যোতনা উপলব্ধি করাটা খুবই কঠিন, আমি তাঁদের দোষ দিই না। 


There is a huge difference between faith and seeking - a Faithful does not seek logic and a Seeker seeks nothing but logic - দুটো সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি পথ। আমি আমার নিজের যাপনের প্রত্যক্ষ অনুভূতিগুলিকে বিশ্লেষণ করতে করতে যখন বুঝতে পারব যে এই শরীর, মন, ইচ্ছা, সুখ, সমৃদ্ধি ইত্যাদি সবই ক্ষনস্থায়ী এবং একমাত্র আত্মাই চিরন্তন আর সেই আত্মা আমার এই ক্ষণস্থায়ী শরীরের মধ্যেই বাস করছেন, এর পরের শরীরেও তিনিই থাকবেন এবং তার পরেরটিতেও, তিনিই প্রকৃতপক্ষে দ্রষ্টা বাকি সবই দৃশ্য, তখন ভারতীতীর্থের দৃক-দৃশ্য-বিবেকের logic আমায় আকৃষ্ট করবে, তখন আর আমি আকাশের দিকে মুখ করে বাইরের অচেনা কোনো ঈশ্বরকে খুঁজতে যাবো না। 


উল্টোদিকে বিশ্বাস হল অন্ধ - হয় সম্পুর্ন বিশ্বাস আছে অথবা একেবারেই নেই - এর মাঝামাঝি কোনো অবস্থান সম্ভব নয়। আর বিশ্বাস যেখানে প্রবল সেখানে লজিকেরও কোনো স্থান নেই। যা লেখা আছে বা যা বলা আছে সেটাকেই ধ্রুব সত্য বলে প্রথমে মেনে নিতে হয়, তারপর জীবনকে এমন এক নির্দিষ্ট দিশায় নিয়ে যেতে হয় যেখানে যাপন বিশ্বাসকে আরো পুষ্ট করে, বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করে। এরই পিঠোপিঠি বিষয় হলো অসহিষ্ণুতা এবং অন্যের বিশ্বাসের প্রতি অবজ্ঞা ও বিদ্বেষ। আসলে যেখানে যুক্তি নেই, বিশ্লেষণ নেই, তর্ক বিতর্ক নেই, শাস্ত্রার্থ নেই, শ্রবণ মনন নিদিধ্যাসন নেই, সেখানে যাচাই বাছাই করে নিজের মনের মতন মতটিকে গ্রহণ করার যেহেতু কোনো অবকাশই নেই, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা বা স্বীকৃতি বা গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নও নেই। 


সর্বোপরি হলো ধর্মবোধ। ধর্ম মানে সেই মানবিক মূল্যবোধ যা সমাজের ভিত্তি, যা সমাজকে ধারণ করে। বিশ্বাসীদের কোনো life after life concept নেই, একটাই জীবন - one life concept এবং এটিই হলো ভোগবাদের জনক। একটাই তো জীবন, তাই যত পারো লুটেপুটে খাও, বাকিটা judgement day-র দিন বুঝে নেওয়া যাবে'খন। এই যে অন্ধবিশ্বাসীরা সারা পৃথিবী জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করে অন্যের ধন সম্পদ কেড়ে নিয়ে, জোর করে তাদের পন্থ পরিবর্তন করিয়ে তাদের ওপর শতাব্দীর পর শতাব্দী রাজত্ব ও শোষণ করেছে, এর পেছনে ওই ভোগবাদের ভূতই কাজ করেছে। আমরাও তো ভিনদেশে গিয়েছি, কি নিয়ে গিয়েছি? শিক্ষার আলো নিয়ে গিয়েছি, জ্ঞানের উজ্জ্বল শিখা নিয়ে গিয়েছি, শাশ্বত সনাতন ধর্মের বাণী নিয়ে গিয়েছি। ঋষি অগস্ত‍্য যখন ইন্দোনেশিয়া যাচ্ছেন, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন বেদ চতুষ্টয়, অঙ্করভটে কেল্লা নয়, বিষ্ণুর মন্দির তৈরি হচ্ছে, অতীশ দীপঙ্কর যখন চীন যাচ্ছেন বুদ্ধের অমৃতবাণী নিয়ে যাচ্ছেন ঝোলায় বয়ে আর সম্রাট অশোকের সন্তান যখন শ্রীলঙ্কায় যাচ্ছেন, পবিত্র বোধিবৃক্ষের চারা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন যত্ন করে। 


এই যে এ দেশে এতগুলি ঋষির আশ্রম, এত গুরুকুল, গ্রামে গ্রামে এত পাঠশালা, রত্নাগিরি, জগদ্দল, বিক্রমশীলা, পুষ্পগিরি, ওদান্তপুরী, সোমপুরা, নালন্দা, তক্ষশীলা, বলভী আর বিক্রমপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন এতগুলি উৎকৃষ্ট জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল, তা কি ধর্মবোধ না থাকলে হয়? আমরা জানি যে বারেবারে ভিন্ন ভিন্ন শরীর নিয়ে এখানেই ফিরে আসতে হবে, ফলে জীবনকে এমনভাবে চালনা করো, উন্নত থেকে উন্নততর করো, যাতে তা 'সর্বজন হিতায়, সর্বজন সুখায়'-এর নিমিত্তে নিবেদিত হয়, কেবল 'আমি' নয়, 'আমরা' - সারা বিশ্বসংসার, যাতে কোনো না কোনো এক জন্মে পরা থেকে অপরার দিকে আমাদের যাত্রাপথ সুগম হয়। অনেকদিন হয়ে গেল ঔপনিবেশিক ভাবধারার প্রভাবে নিজেদের শাস্ত্রনির্দেশিত ধর্মবোধকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। ভুলটাকে নির্দ্বিধায় উচ্চৈঃস্বরে ভুল বলতে পারলে তাকে বর্জন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়, একটা স্তরে closure হয় তো বটেই। Let us stop romanticising what is intrinsically anticultural - যা আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতির পরিপন্থী তা অবশ্যই বর্জনীয়। চলুন পাল্টাই।

Tuesday, February 13, 2024

মা বিশালাক্ষ্মী, কাশী

আজ বলবো গত ৭ই ফেব্রুয়ারি রাতে কাশীতে হটাৎই অযাচিতভাবে মা বিশালাক্ষ্মীর দর্শন পাওয়ার সৌভাগ্যের কথা। লক্ষ্য করে দেখেছি, আমার ক্ষেত্রে দেবদর্শনের সংযোগগুলি অদ্ভুতভাবেই ঘটে, খুব যে একটা পূর্বযোজনা অনুযায়ী চলা যায়, তা কিন্তু সচারচর নয়। কাশীর পবিত্র ভূমিতে ছয়টি এমন পূণ্যক্ষেত্র আছে যেগুলি ষষ্ঠাঙ্গ যোগের দ্যতক - বাবা বিশ্বনাথের মন্দির, মা বিশালাক্ষ্মীর মন্দির, মা গঙ্গা স্বয়ং, বাবা কালভৈরবের মন্দির (যিনি মা বিশালাক্ষ্মীর ভৈরবও বটে), ধুন্ডি বিনায়ক মন্দির (শিব-পার্বতীপুত্র শ্রীগণেশের মন্দির) আর দণ্ডপাণির শিবমন্দির - এগুলি অবশ্য গন্তব্য। এবারে কাশীতে শেষদিনে বড্ড অসুস্থ হয়ে পড়ায় শেষ দুটি মন্দির এবারে আর দর্শন করা সম্ভব হয়নি, পরেরবার শুরুই করবো ওখান থেকে। 

যাইহোক, এক শুভানুধ্যায়ীনি মা বিশালাক্ষ্মীকে দর্শন করার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন যে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরের পাশের এক গলিতে এই মন্দির। কাশী বিশ্বনাথ করিডোরের মধ্যে এখন অনেকগুলি প্রাচীন মন্দির সমাহিত, এবং সেখানে একটি বিশালাক্ষ্মীর মন্দিরও আছে, ফলে আমি ভেবেছিলাম বোধহয় এইটির কথাই তিনি লিখেছিলেন। খটকা লাগলো যখন বিশ্বনাথ গলিতে একদিন সকালে দক্ষিণভারতীয় এক যুবক রাস্তায় আমার কাছে বিশালাক্ষ্মী মন্দিরের পথনির্দেশ চাইলেন কারণ তিনি সদ্য বাবাকে দর্শন করেই বেরিয়েছিলেন। 

সেইদিনই রাতের শৃঙ্গার আরতি দর্শন করে আর বেশি হাঁটতে ইচ্ছে করছিল না কারণ তার আগেই ধর্মশালায় আমার বেশ বারকয়েক বমি হয়ে গিয়েছিল। তাই পুলিশকে ওই করিডোর থেকে দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে যাওয়ার কোনো শর্টকাট আছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে উনি গঙ্গার দিকে 'উডিপি টু মুম্বাই' রেস্টুরেন্টের ঠিক লাগোয়া ডানদিকের একটি গলি দেখিয়ে দিলেন যা মিরঘাট লাহোরিটোলা হয়ে এঁকেবেঁকে দশাশ্বমেধ পৌঁছে যায়। বেশ রাত, প্রায় নিঝুম গলি, দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু করেছে, আমরা দুজন বাঁ দিক ডানদিক করতে করতে কখনো আন্দাজে কখনো দিশা জিজ্ঞেস করে হাঁটছি, হটাৎ এক বাঁকের ঠিক আগে মাথার ওপর দেখি এক প্রায়ান্ধকার বোর্ডে লেখা 'শ্রীকাশী বিশালাক্ষ্মী মন্দির'। মাথার ভেতর কে যেন হটাৎ একটা টোকা মেরে বললো - এটাই।

ঘুরতেই ডানহাতে মন্দির, দরজার ওপর দক্ষিণভারতীয় কোনো ভাষায় কিসব যেন লেখা, ভেতরে একটি দক্ষিণভারতীয় ভক্ত পরিবার পূজারত, এমনকি বাইরে, ফটকের ডানহাতে যে বৃদ্ধা গোলাপের মালা ইত্যাদি নিয়ে বসে আছেন, তিনিও দক্ষিণ ভারতীয় এবং আমাদের দেখে নিজের ভাষায় কি যে বললেন কিছুই বোধগম্য হলো না, বোধহয় পূজার সামগ্রী নেবার কথা বলছিলেন। ভেতরে উঁকি মারতেই দেখি সামনেই মা - একেবারে জ্বলজ্বল করছেন। 

বিশালাক্ষ্মী অর্থাৎ বিশাল আঁখি যাঁর - সত্যিই বিশাল নেত্রদ্বয় মায়ের। এই সতীপীঠে হয় মায়ের আঁখি পড়েছিল (যার সম্ভাবনা সমূহ) অথবা কানের মণিকুন্তল, যদিও পুরোহিত বললেন দেবীভাগবৎ পুরাণের মতে মায়ের গোটা মুখটাই নাকি এখানে পড়েছিল, এখন মাতৃমূর্তির পেছনে সযত্নে সুরক্ষিত আছে। কুলার্নব তন্ত্রে যে অষ্টাদশ পীঠের উল্লেখ আছে সেই তালিকায় এটি ষষ্ঠ। কেন দক্ষিণ ভারতীয় ভক্তদের এত উৎসাহ জানতে গিয়ে জানা গেল যে তাঁরা মূলত তিনরূপে দেবীমহাশক্তির উপাসক - বিশালাক্ষ্মী, কামাক্ষ্মী এবং মিনাক্ষ্মী, বাকি দুজন দক্ষিনেই আছেন, ফলে অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য, কেবল ইনি কাশীতে, ফলে ওঁর প্রতি দক্ষিণীদের এত আকর্ষণ। কাশী-তামিল সঙ্গমের বিষয়টি যে কোন স্তরে কত গভীরভাবে ব্যঞ্জনাময়, সেটা বোধগম্য হলো এতদিনে। 

এক অচেনা গলিতে হটাৎ করে মন্দিরটি আবিষ্কার করার সময়ই আমার স্থির বিশ্বাস জন্মেছিল যে আমি মা বিশালাক্ষ্মীকে দর্শন করতে যাইনি, উনিই অহেতুকি কৃপা করে টেনে এনে আমায় দর্শন দিয়েছেন। আমি তো জানতাম করিডোরের ভেতরেই আমার ওঁকে দর্শন করা হয়ে গেছে কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতি উনি সৃষ্টি করলেন যাতে ওঁর মন্দিরের রাস্তা আমায় ধরতেই হয় এবং বেশ রাতে প্রায় ফাঁকা মন্দিরে একদম সামনে থেকে দুচোখ ভরে আমি ওঁকে দেখতে পারি, ওঁকে প্রণাম করতে পারি, চরণামৃত পান করতে পারি। কি অপূর্ব মা আমার, নিকষ কালো, ডাগর আঁখি, সুগন্ধি ফুলের মালার অঙ্গরাগে সুসজ্জিতা। ওই চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মাথার ভেতর কেমন কেমন যেন লাগে, মনে হয় এবার বোধহয় বাহ্যজ্ঞান লোপ পাবে। ছবি তোলা নিষেধ না থাকলে মায়ের সেদিনের রূপ আপনাদেরও দেখাতে পারতাম, আপাতত সেটি আমার মনের মধ্যে ধরা আছে। যে ছবিটি দিলাম সেটি নেট থেকে নেওয়া। বাকি ছবিগুলি মন্দিরের বহিরঙ্গের।

সঙ্কটমোচন, কাশী

আজ সকালে তীর্থযাত্রা সেরে বাড়ি ফিরে এসেছি কিন্তু মন জুড়ে শুধুই তাঁরা সবাই, যাঁদের সান্নিধ্যে গত একটা সপ্তাহ কাটিয়ে এলাম। চোখ বন্ধ করে তো বটেই, চোখ খুলেও তাঁদেরকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। গত ৫ই ফেব্রুয়ারি কাশীতে নেমেই এযাত্রায় প্রথম দর্শন করেছিলাম সঙ্কটমোচনকে। এখনো আমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছি আর ঠিক তাঁর বুক বরাবর উল্টোদিকের এক অতি প্রাচীন মন্দিরে বিরাজমান তাঁর ইষ্টদেবকেও, যাঁকে এই মুহূর্তেও হৃদয়ে ধারণ করে তিনি মর্তে বিরাজ করছেন। 

আজ যখনই চোখের সামনে সঙ্কটমোচন ভেসে উঠছেন অমনি মনে পড়ছে তুলসীদাসবাবাজিকেও কারণ তাঁর নিজের হাতে মাটি দিয়ে গড়া ওই অপুরূপ বিগ্রহের মধ্যেই শুধু নয়, তুলসী ছড়িয়ে আছেন ওই ভূমির প্রতিটি কণায়। রচিত হওয়ার সাথে সাথে মানসের কত না দোহা প্রথম শুনেছেন তাঁর প্রাণনাথ আমাদের বাল ব্রহ্মচারী, ওখানকার জঙ্গলের বৃক্ষরাজি, ওখানকার আকাশ, বাতাস, মাটি। 

এখনো ক্রমাগত তাঁর রচিত স্তবই পাঠ হয়ে চলেছে ওই মন্দির চত্বরে, কথক লাগাতার ব্যাখ্যা করে চলেছেন মানসের, ভক্তরা তাঁরই প্রদর্শিত পথে ওখানে যে যাঁর মতন জায়গা খুঁজে নিয়ে রামনামের জপে-ধ্যানে মগ্ন। আমাকে একজন মহাত্মা বলেছিলেন যে মহাবীরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গেলে তাঁর সামনে আর তাঁর নিজের সুখ্যাত করতে নেই, রামের গুণগান গাইতে হয়, তাহলেই উনি যারপরনাই প্রসন্ন হন। 

গেট থেকে বাগানের পথ পেরিয়ে আমি যখন তাঁকে দর্শন করতে পৌঁছিয়েছিলাম তখন মন্দিরে বেশ কয়েকজন সমবেত কণ্ঠে জোরে জোরে হনুমান চল্লিশা পাঠ করছিলেন, আমি চুপ করে এককোণে দাঁড়িয়ে প্রথমে মন দিয়ে গোটাটা শুনলাম। তারপর তাঁদের পাঠ শেষ হলে 'জয় রাম জয় রাম জয় জয় রাম' গাইতে গাইতে মহাবীরের সামনে যেতেই কেন জানি না অনুভব হলো যে উনি আমার গান শুনছেন - আমার মুখের দিকে তাকিয়ে উনি রাম নাম শুনছেন।

ভিড় না থাকলেও লাইন তো একটা ছিলই কিন্তু কেউ আমায় ধাক্কা দিলেন না, কেউ ঠেলে সরিয়ে দিলেন না, ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিশ্চিন্তে তিন তিনবার গোটা নামমন্ত্রটা গাইলাম, তারপর প্রণাম করে ওনার সামনে থেকে চুপচাপ বাঁদিকে সরে গেলাম - এটা আমার মনে আছে। যতক্ষন আমি ওনার সামনে ছিলাম, আমার এই ক্ষীণদৃষ্টি নিয়েই ওই মেটে সিঁদুরের প্রলেপ ভেদ করে ওনার চোখদুটিকে একটু ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করছিলাম আর আমি নিশ্চিত যে উনিও মাথাটা সামান্য বেঁকিয়ে একদৃষ্টিতে আমার দিকেই তখন তাকিয়েছিলেন। 

তুলসী লিখেছিলেন 'শঙ্কর সুবন কেশরী নন্দন, তেজ প্রতাপ মহাজগবন্দন', যদিও তুলসীপীঠাধিশ্বর স্বামী রামভদ্রাচার্য্যজির মতে ওটা ভুল, আসলে তুলসী লিখেছিলেন 'শঙ্কর স্বয়ং কেশরী নন্দন, তেজ প্রতাপ মহাজগবন্দন', যা পরে সাধারণ মানুষের মুখে 'সুবন' হয়ে যায়। আসলে, কেশরী নন্দন মহাদেবের অবতারই হন বা মহাদেব স্বয়ং, তাতে সত্যিই কিই বা আসে যায়?  

দেখি কখনো তিনি রামেশ্বররূপে শ্রীরামচন্দ্রের আরাধ্য, আবার কখনো হনুমানরূপে শ্রীরামচন্দ্রই তাঁর আরাধ্য, এখানে কে ভক্ত আর কেই বা ভগবান, সবই তো এক! ওখানে প্রদক্ষিণ করতে করতে এই কথাটাই ভাবছিলাম আর মনে পড়ে যাচ্ছিল ঠাকুর বলতেন 'ভাগবত ভক্ত ভগবান, তিন এক'। শিব, মহাবীর, রাম, মানস, কাশী - সব এক, সব এক। 

সঙ্কটমোচনে কাশীপতি আর অযোধ্যাপতি দুজনে যেন মিলেমিশে যাচ্ছেন, আবার মন চাইলে আলাদা আলাদা হয়েই চোখের সামনে এখন ভেসেও উঠছেন। এঁদের মধ্যে কে যে কার ভক্ত আর কে যে কার আরাধ্য, তাঁরাই জানেন। মা বলতেন না, 'যখন যেমন তখন তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমন' - ওটাই সার কথা। সঙ্গে একটি ছবি দিলাম রাম-জানকি মন্দিরের গর্ভগৃহের, অত সুন্দর রামমূর্তি আমি খুবই কম দেখেছি। পরেরবার যখন কাশী যাবো তখন ঐ মন্দিরে দীর্ঘক্ষণ কাটানোর ইচ্ছা প্রবল।