Sunday, March 12, 2023

ভারত


সংস্কৃতে '√ভা' ধাতু দীপ্তিসূচক। তাই যিনি দীপ্তি দান করেন অর্থাৎ সূর্যদেব, তাঁর অপর নাম ভানু বা ভানুমান বা ভাস্কর বা ভাস্বান। আবার সংস্কৃতে 'ত' (ক্ত) হলো কৃৎ প্রত্যয়। এই প্রত্যয় যুক্ত হয়ে শব্দ তৈরি হওয়ার সময় ক্রিয়ামূলের বানানের পরিবর্তন ঘটায়। ক্রিয়ামূলের শেষ বর্ণ 'ন' বা 'ম' থাকলে, তা 'ত' বর্ণে পরিণত হয়। যেমন ম>ত - √রম্ (আনন্দ লাভ) >রত। তাহলে ভারতের অর্থ কি দাঁড়ায়? যে দেশ আলোর ভুবনে নিজের অস্তিত্বের আনন্দ খোঁজে - যার ঋষি প্রার্থনা করেন 'তমসো মা জ্যোতির্গময়', আমায় অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে চলো। এই প্রাচীন ভূমিকে ইন্ডিয়া বলে গালাগাল দিয়ে কি লাভ? আমি সত্যি সত্যিই চাই কেউ না কেউ উদ্যোগী হয়ে সংবিধান থেকে India that is Bharat নামক নষ্টামিটিকে দূর করে দিন আর Preamble থেকেও secular আর socialist শব্দগুলিকে বাদ দিয়ে আবার শুরুতে যেমন ছিল তেমনটি করে দিন। আমি চাই যে আমার জীবদ্দশাতেই ভারতের মাটি থেকে ইন্ডিয়ার সমস্ত চিহ্ন চিরতরে মুছে যাক। ভারত ইন্ডিয়া নয়। কোনোদিন ছিল না, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও কোনোদিন থাকবে না। ভোগবাদীদের দেওয়া একটি নাম কখনো একটি আদ্যন্ত আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলযুক্ত পুণ্যভূমির অন্তরাত্মার প্রকাশক হতে পারে না। এ যেন পদ্মলোচনের নাম কানাছেলে। যেদিন আমাদের মানসিকতা থেকেও ইন্ডিয়া সরে যাবে সেদিন ভারত সত্যিকারের দীপ্তঃমান হয়ে ক্ষতবিক্ষত পৃথিবীকে নতুন করে আঁধারের পারে আশার আলো দেখাবে, বলবে:
শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা
আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূ॥
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ, ২ . ৫)
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্‌
আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
তমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতি
নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়॥
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ, ৩ . ৮)
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,
শোনো বিশ্বজন,
শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ
দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে
মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে
জ্যোতির্ময়। তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পারো, অন্য পথ নাহি।

Friday, March 10, 2023

সন্তান, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি

আমরা যারা পরজন্মে বিশ্বাস করি আমাদের জীবনকে দেখার ধরণ আর যাঁরা মনে করেন একটাই জীবন, যাপনের বিষয়ে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটা মূল পার্থক্য হলো সংরক্ষণ এবং সর্বভুখের মধ্যে যে পার্থক্য - তাই। আমাদের বোধে আত্মাই প্রাধান আর শরীর তাঁর একটি বাহন মাত্র আর উল্টোদিকে শরীরই প্ৰধান, soul incidental, যাকে মৃত্যুর পর শেষ বিচারের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। যেহেতু সামাজিক বিশ্বাসের সাথে অর্থনীতি সরাসরি জড়িত, তাই যে সমাজ পরজন্মে বিশ্বাসী তার ভোগস্পৃহা আর যে সমাজ শরীরভিত্তিক individualismএ বিশ্বাসী, তার ভোগস্পৃহা এক হতে পারে না। এই যে দুই চিন্তাধারার মধ্যে gap, এটা ভারতের সনাতন সংস্কৃতির অনুসারী মূলত গ্রাম্য নাগরিক এবং Western consumerism এর শিকার শহুরে এবং আধা-শহুরে নাগরিকদের মধ্যে দিনকেদিন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। ভারত কোন রাস্তায় হাঁটবে সেই নির্ণয় এবার তাকে নিতেই হবে। হয় আমরা স্বধর্মরক্ষার্থে কাজ করবো নয় কেবল শরীররূপী 'আমার' ফুর্তির জন্য কাজ করবো, আর এই দুই approach এর ফল সম্পূর্ণভাবে আলাদা হতে বাধ্য।

যে ভাবধারা rank consumerismএর জন্ম দেয়, সেই ভাবধারাই জন্মের হার কমাতে কমাতে জাপান বা স্ক্যান্ডেনেভীয় দেশগুলিকে বিলুপ্তির দিকেও ঠেলে দেয়। আবার এই ভাবধারাই অন্য এক রূপে one child policy রূপে একনায়কতন্ত্রের অভিশাপ হয়ে চিনের মতন দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে দেয়, যেখানে একজন যুবকের ওপর এক জোড়া বাবা মা এবং দুই জোড়া দাদু দিদা ভরণপোষণের জন্য নির্ভর করতে বাধ্য হন। আমাদের দেশেও শহুরে শিক্ষিত elite সেই দিকেই এগোচ্ছেন আর তাঁদের দেখাদেখি একদিকে যেমন গ্রামের দিকেও বাচ্চার জন্মহার প্রতিনিয়ত কমছে, তেমন অন্যদিকে দেশে longivity বেড়ে যাওয়ায় ফলে আর ষাট সত্তর বছরের মধ্যে আমাদের সমাজের দশাও আজ থেকে ত্রিশ বছর পরের চিনের মতন বৃদ্ধপ্রধান হয়ে যাবে।

আমাদের একটাই জীবন, ফলে যা কিছু উপভোগ করার তা এই একটাই জীবনে সেরে ফেলতে হবে। যে যে কারণে আমাদের lifestyleকে compromise করতে হতে পারে, তা সে গার্হস্থ্য জীবন শুরু করার বয়স হোক, বিয়ের পর সন্তান ধরণের বয়স হোক, সন্তানের সংখ্যা হোক, একান্নবর্তী পরিবারে মানিয়ে চলাকে অস্বীকার করা হোক, মানুষকে সাহায্য করা হোক, সামাজিক কাজে সময় ব্যয় করা হোক বা মা হিসেবে যথাযতভাবে নারীর ভূমিকাপালনই হোক, সেসব কি আর আমরা করতে ইচ্ছুক? আমার মনে আছে আমাদের যখন প্রথম সন্তান এলো আমার স্ত্রীর কাছে option ছিল একজন আয়ার কাছে সন্তানকে গচ্ছিত রেখে চাকরি চালিয়ে যাওয়ার, কিন্তু তিনি তা করেননি। সেই যে তিনি নিজের আর্থিক আত্মনির্ভরতাকে তাকে তুলে রেখে মায়ের ভূমিকা পালন করতে নামলেন, সোজা আমাদের দ্বিতীয় সন্তান প্রাইমারি স্কুলে না যাওয়া পর্য্যন্ত আর চাকরিতে ফিরে গেলেন না। তাতে ওঁর seniority loss তো হলোই, বিস্তর আর্থিক ক্ষতিও হলো কিন্তু তাঁর কাছে মাতৃত্বের দায়িত্বপালন priority ছিল। তাঁর সেই ত্যাগের ফল আজ সুস্পষ্ট - যাঁরা আমাদের দুই পুত্রকে জানেন তাঁরা বুঝতে পারবেন।

মূল বিষয় হলো এই পাকা বিশ্বাস যে আমাদের কখনোই ধর্মপথ থেকে সরলে চলবে না। সনাতন সংস্কৃতিতে সংসারে যে চারটি আশ্রম আছে, তার প্রত্যেকটির নিজস্ব ধর্ম আছে এবং আমাদের যদি আখেরে কোনো এক জন্মে মোক্ষলাভ করতে হয় তাহলে প্রতিটি আশ্রমে ধর্মত আমাদের যা ভূমিকা, তা পালন করতেই হবে। আমাদের তো আর একটা জন্ম নয় যে লালায়িত হয়ে আমরা ধর্মভ্রষ্ট হলাম তবু তার কর্মফল পরের জন্মে আর আমাদের ভুগতে হবে না - ভুগতেই হবে। সন্তান হলে তার পেছনে খরচ বাড়বেই, তাকে সময়ও দিতে হবে - দুটোই বাপ-মায়ের ভাগ থেকে যাবে কিন্তু এটাই গৃহস্থ হিসেবে আমাদের কর্তব্য। এটা না হলে সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে, আমাদের পুনর্বার জন্ম দেওয়ারও কেউ থাকবে না। কেন আবার জন্মাতে হবে? কারণ আমাদের জীবনের লক্ষ্য ক্যাবারে দেখে হাততালি দেওয়া নয়, জীবনের লক্ষ্য হলো স্বরূপদর্শন। একমাত্র সেটি হলেই এই জন্ম মৃত্যুর cycle থেকে আমরা চিরতরে মুক্তি পাবো।

মাঝেমাঝেই আক্ষেপ শুনি যে আমাদের দেশেই একশ্রেণীর মানুষ পিলপিল করে বাড়ছে, না আছে তাদের পরিবার প্রতিপালন করার সামর্থ, না আছে আধুনিক শিক্ষাদীক্ষার ভাবনা আর না আছে পূর্বপুরুষের সনাতন সংস্কৃতিবোধ। নেহাত পাশবিক নিয়মে এবং অন্ধবিশ্বাসের ওপর ভর করে তারা সংখ্যায় বেড়ে চলেছে, একমাত্র destructive ছাড়া বেশিরভাগই সমাজে কোনো সদর্থক ভূমিকা পালন করতে অক্ষম। এইখানে ধর্মবোধহীনতা এবং ব্যক্তিগত অর্থনীতি জড়িয়ে পড়ে। ব্রহ্মচর্য শেষ না করে, উপার্জনক্ষম না হয়ে, গার্হস্থ্য জীবনের দায়িত্ব নেওয়া চরম অধর্ম। আর নিজের সন্তানদের আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে তাদের দুটি কচি হাতকে বড়দের গ্রাচ্ছাসাধনের স্বার্থে ব্যবহার করা হলো মহাপাপ। ভারতীয় পরম্পরায় গরিব কৃষকের ছেলেমেয়ে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও গ্রামের পাঠশালায় পন্ডিত মশাইয়ের কাছে পড়তে যেত, বাপ যত গরিবই হোক সন্তানকে অর্থের বিনিময়ে child labour হিসেবে ব্যবহার করার কথা ভাবতেও পারতেন না। এই খেতে দেওয়ার ক্ষমতা নেই কিন্তু ফৌজ খাড়া হয়ে যাচ্ছে - এ সনাতন সংস্কৃতি নয়, পরজন্মহীনতার বেপরোয়া মনোভাব থেকে উদ্ভূত এক অধর্ম। এর প্রতিকার এবং productive population growthকে encourage করার উপায় ভারতকে খুঁজে বের করতেই হবে।

Thursday, March 9, 2023

সন্তান, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি

আমরা যারা পরজন্মে বিশ্বাস করি আমাদের জীবনকে দেখার ধরণ আর যাঁরা মনে করেন একটাই জীবন, যাপনের বিষয়ে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটা মূল পার্থক্য হলো সংরক্ষণ এবং সর্বভুখের মধ্যে যে পার্থক্য - তাই। আমাদের বোধে আত্মাই প্রাধান আর শরীর তাঁর একটি বাহন মাত্র আর উল্টোদিকে শরীরই প্ৰধান, soul incidental, যাকে মৃত্যুর পর শেষ বিচারের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। যেহেতু সামাজিক বিশ্বাসের সাথে অর্থনীতি সরাসরি জড়িত, তাই যে সমাজ পরজন্মে বিশ্বাসী তার ভোগস্পৃহা আর যে সমাজ শরীরভিত্তিক individualismএ বিশ্বাসী, তার ভোগস্পৃহা এক হতে পারে না। এই যে দুই চিন্তাধারার মধ্যে gap, এটা ভারতের সনাতন সংস্কৃতির অনুসারী মূলত গ্রাম্য নাগরিক এবং Western consumerism এর শিকার শহুরে এবং আধা-শহুরে নাগরিকদের মধ্যে দিনকেদিন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। ভারত কোন রাস্তায় হাঁটবে সেই নির্ণয় এবার তাকে নিতেই হবে। হয় আমরা স্বধর্মরক্ষার্থে কাজ করবো নয় কেবল শরীররূপী 'আমার' ফুর্তির জন্য কাজ করবো, আর এই দুই approach এর ফল সম্পূর্ণভাবে আলাদা হতে বাধ্য।

যে ভাবধারা rank consumerismএর জন্ম দেয়, সেই ভাবধারাই জন্মের হার কমাতে কমাতে জাপান বা স্ক্যান্ডেনেভীয় দেশগুলিকে বিলুপ্তির দিকেও ঠেলে দেয়। আবার এই ভাবধারাই অন্য এক রূপে one child policy রূপে একনায়কতন্ত্রের অভিশাপ হয়ে চিনের মতন দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে দেয়, যেখানে একজন যুবকের ওপর এক জোড়া বাবা মা এবং দুই জোড়া দাদু দিদা ভরণপোষণের জন্য নির্ভর করতে বাধ্য হবেন। আমাদের দেশেও শহুরে শিক্ষিত elite সেই দিকেই এগোচ্ছেন আর তাঁদের দেখাদেখি একদিকে যেমন গ্রামের দিকেও বাচ্চার জন্মহার প্রতিনিয়ত কমছে, তেমন অন্যদিকে দেশে longivity বেড়ে যাওয়ায় ফলে আর ষাট সত্তর বছরের মধ্যে আমাদের সমাজের দশাও আজ থেকে ত্রিশ বছর পরের চিনের মতন বুড়ো হয়ে যাবে।

আমাদের একটাই জীবন, ফলে যা কিছু উপভোগ করার তা এই একটাই জীবনে সেরে ফেলতে হবে। যে যে কারণে আমাদের lifestyleকে compromise করতে হতে পারে, তা সে গার্হস্থ্য জীবন শুরু করার বয়স হোক, বিয়ের পর সন্তান ধরণের বয়স হোক, সন্তানের সংখ্যা হোক, একান্নবর্তী পরিবারে মানিয়ে চলাকে অস্বীকার করা হোক, মানুষকে সাহায্য করা হোক, সামাজিক কাজে সময় ব্যয় করা হোক বা মা হিসেবে যথাযতভাবে নারীর ভূমিকাপালনই হোক, সেসব কি আর আমরা করতে ইচ্ছুক? আমার মনে আছে আমাদের যখন প্রথম সন্তান এলো আমার স্ত্রীর কাছে option ছিল একজন আয়ার কাছে সন্তানকে গচ্ছিত রেখে চাকরি চালিয়ে যাওয়ার, কিন্তু তিনি তা করেননি। সেই যে তিনি নিজের আর্থিক আত্মনির্ভরতাকে তাকে তুলে রেখে মায়ের ভূমিকা পালন করতে নামলেন, সোজা আমাদের দ্বিতীয় সন্তান প্রাইমারি স্কুলে না যাওয়া পর্য্যন্ত আর চাকরিতে ফিরে গেলেন না। তাতে ওঁর seniority loss তো হলোই, বিস্তর আর্থিক ক্ষতিও হলো কিন্তু তাঁর কাছে মাতৃত্বের দায়িত্বপালন priority ছিল। তাঁর সেই ত্যাগের ফল আজ সুস্পষ্ট - যাঁরা আমাদের দুই পুত্রকে জানেন তাঁরা বুঝতে পারবেন।

মূল বিষয় হলো এই পাকা বিশ্বাস যে আমাদের কখনোই ধর্মপথ থেকে সরলে চলবে না। সনাতন সংস্কৃতিতে সংসারে যে চারটি আশ্রম আছে, তার প্রত্যেকটির নিজস্ব ধর্ম আছে এবং আমাদের যদি আখেরে কোনো এক জন্মে মোক্ষলাভ করতে হয় তাহলে প্রতিটি আশ্রমে ধর্মত আমাদের যা ভূমিকা, তা পালন করতেই হবে। আমাদের তো আর একটা জন্ম নয় যে লালায়িত হয়ে আমরা ধর্মভ্রষ্ট হলাম তবু তার কর্মফল পরের জন্মে আর আমাদের ভুগতে হবে না - ভুগতেই হবে। সন্তান হলে তার পেছনে খরচ বাড়বেই, তাকে সময়ও দিতে হবে - দুটোই বাপ-মায়ের ভাগ থেকে যাবে কিন্তু এটাই গৃহস্থ হিসেবে আমাদের কর্তব্য। এটা না হলে সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে, আমাদের পুনর্বার জন্ম দেওয়ারও কেউ থাকবে না। কেন আবার জন্মাতে হবে? কারণ আমাদের জীবনের লক্ষ্য ক্যাবারে দেখে হাততালি দেওয়া নয়, জীবনের লক্ষ্য হলো স্বরূপদর্শন। একমাত্র সেটি হলেই এই জন্ম মৃত্যুর cycle থেকে আমরা চিরতরে মুক্ত পাবো।

মাঝেমাঝেই আক্ষেপ শুনি যে আমাদের দেশেই একশ্রেণীর মানুষ পিলপিল করে বাড়ছে, না আছে তাদের পরিবার প্রতিপালন করার সামর্থ, না আছে আধুনিক শিক্ষাদীক্ষার ভাবনা আর না আছে পূর্বপুরুষের সনাতন সংস্কৃতিবোধ। নেহাত পাশবিক নিয়মে এবং অন্ধবিশ্বাসের ওপর ভর করে তারা সংখ্যায় বেড়ে চলেছে, একমাত্র destructive ছাড়া বেশিরভাগই সমাজে কোনো সদর্থক ভূমিকা পালন করতে অক্ষম। এইখানে ধর্মবোধহীনতা এবং ব্যক্তিগত অর্থনীতি জড়িয়ে পড়ে। ব্রহ্মচর্য শেষ না করে, উপার্জনক্ষম না হয়ে, গার্হস্থ্য জীবনের দায়িত্ব নেওয়া চরম অধর্ম। আর নিজের সন্তানদের আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে তাদের দুটি কচি হাতকে বড়দের গ্রাচ্ছাসাধনের স্বার্থে ব্যবহার করা হলো মহাপাপ। ভারতীয় পরম্পরায় গরিব কৃষকের ছেলেমেয়ে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও গ্রামের পাঠশালায় পন্ডিত মশাইয়ের কাছে পড়তে যেত, বাপ যত গরিবই হোক সন্তানকে অর্থের বিনিময়ে child labour হিসেবে ব্যবহার করার কথা ভাবতেও পারতেন না। এই খেতে দেওয়ার ক্ষমতা নেই কিন্তু ফৌজ খাড়া হয়ে যাচ্ছে - এ সনাতন সংস্কৃতি নয়, পরজন্মহীনতার বেপরোয়া মনোভাব থেকে উদ্ভূত এক অধর্ম, যার প্রতিকার ভারতকে খুঁজে বের করতেই হবে।

বর্তমান ভারত

ভারত রুশ থেকে কাঁচা তেল আর সার কিনে সারা বিশ্বকে চিনের ত্রাস থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, নইলে শি শিং পিং একজন আধুনিক হিটলার হওয়ার জন্য একেবারে পা বাড়িয়েই ছিলেন। চুক্তি ভেঙে নিজেদের দোরগোড়ায় কড়া নাড়া ন্যাটোকে আটকানোর জন্য মিলিটারি একশন রুশকে নিতেই হতো, আর এগোলেই যে আমেরিকা এবং তার উপনিবেশের তরফ থেকে তাগড়া প্রতিবন্ধন নেমে আসবে, সেটাও পুতিনসাহেব খুব ভালোভাবেই জানতেন। অলিমপিক্সকে উপলক্ষ করে বেজিংয়ে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সময় শি শিন পিং পুতিনসাহেবকে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলেন কারণ তিনি এক ঢিলে তিন পাখি শিকার করার ধান্দা করেছিলেন - এক, রুশের ঘাড়ে বন্ধুক রেখে আমেরিকা ও গুষ্ঠীর বিরুদ্ধে তোপ দাগা, দুই, রুশকে সম্পূর্ণভাবে চিনের ওপর নির্ভরশীল করে তুলে তাকে একটা ভ্যাসেল স্টেট বানিয়ে ফেলা আর তিন, রুশকে নিউট্রালাইজ করে আফগানিস্তানকে কব্জা করে পাকিস্তানের মাধ্যমে ভারতের প্রগতিকে ব্যাহত করা।

কিন্তু একটি ছোট্ট ছয়ঘন্টার ঝটিকা সফর এবং একজন সাদা দাঁড়ি সাদা চুলওলা বৃদ্ধের পরামর্শ ও নির্ণয় চিনের সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে দিয়ে বিশ্বের ইতিহাসে চারটি আমূল পরিবর্তন সূচিত করেছে:
১. এই যুদ্ধের বাজারেও সস্তায় ভারতের জ্বালানি এবং সারের প্রয়োজন মেটানো সুনিশ্চিত করে বিশ্বের অর্থনীতিকে অপেক্ষাকৃতভাবে স্থিতিশীল রেখেছে;
২. রুশকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে ভবিষ্যতে রুশি জমি ব্যবহার করে ইউরোপের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে চিনের তান্ডবনৃত্যের সম্ভাবনা বন্ধ করে দিয়েছে;
৩. সুইফট ইত্যাদি ব্যবস্থাকে আটকে দিয়ে এবং অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধনকে হাতিয়ার করে আমেরিকার গুষ্টি এতদিন অন্য দেশের অর্থনীতির ব্যান্ড বাজানোর যে ক্ষমতা উপভোগ করে এসেছে, উন্নয়নশীল বিশ্বের বিরুদ্ধে তা যেন জীবনে কোনোদিন কেউ প্রয়োগ করেও সফল না হতে পারে, ভারত ডিজিটাল ইকোনমি এবং ডি-ডলারাইসেশনের মাধ্যমে সেটা সুনিশ্চিত করছে;
৪. নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে এবং নিউক্লিয়ার স্টাইক আটকে দিয়ে ভারত নিজের ধকে গ্লোবাল সাউথকে সঠিক পথ দেখিয়ে তাদের অবিসংবাদী নেতা হিসেবে উঠে এসেছে।

ভারতের ভূমিকায় ভূরাজনীতিতে কতকিছু বদলে যাচ্ছে, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
১. ইউরোপ, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া স্পষ্ট করে ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছে এবং ভারতের সাথে engagement ক্রমশ বাড়াচ্ছে;
২. তেল এবং গ্যাস নির্ভর দেশগুলিও বুঝতে পারছে যে ভবিষ্যতে বিশ্ব যত renewable energyর দিকে এগোবে তত পেট্রোডলারের প্রয়োজন কমবে এবং এক্ষুনি ভারতের হাত ধরে না ফেলতে পারলে পরে ব্যাথা আছে;
৩. আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ব্যালেন্স করার জন্য একসময় জাপানকে তুলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি বানিয়েছিল, তারপর জাপানকে ছেড়ে চিনকে তুলে ওই জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল, এবার চিনের debt trap থিওরি এবং aggression দেখে ভবিষ্যতে নিজেদেরই অবস্থা ঢিলে হয়ে যাবে বলে counter balance হিসেবে ভারতের উত্থান মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। মুস্কিল একটাই - এই পাকাচুল বৃদ্ধের ভারত কারো জো হুজুরি করেনা, ফলে আমেরিকাকে reluctantly এমন অনেককিছুই আজ গিলতে হচ্ছে, যা তার মোটেও পছন্দ নয়;
৪. রুশ ধীরে ধীরে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, ফলে রুশের circle of influenceএ থাকা Central Asian দেশগুলিও এখন ভারতের অনেক বেশি কাছাকাছি এসে গেছে, যা ভবিষ্যতে সরাসরি ইউরোপের সাথে বাণিজ্যের জন্য ল্যান্ডরুট তৈরি করাতে সহায়ক হবে;
৫. পাকিস্তান একেবারে তামাদি হয়ে গেছে কারণ ওদের তোল্লা দেওয়ার সমস্ত রাস্তা ভারত নিজের নতুন ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বন্ধ করে দিয়েছে, এবং সেই সাথে CPECতেও তালা পড়ে গিয়ে চিনের এদিক্কার জমি দখলের প্ল্যানও চৌপট হয়ে গেছে;
৬. সাপ্লাই চেনকে কারো সঙ্গে চেন দিয়ে বেঁধে রাখলে তার disruption কি যে ব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে, সেটা বিশ্বজুড়ে চিন এবং ইউক্রেনের গ্রাহকরা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছেন। প্রথমে ভ্যাক্সিন নিয়ে ছুঁচ হয়ে ঢুকে ধীরে ধীরে মিশরকে আটা সাপ্লাই করার রাস্তা ধরে আপাতত ফক্সকন অবধি এসে পৌঁছানো গেছে, ভবিষ্যতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে ওঠাটা এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। 
৭. ভারত যে কেবল economic superpower বা military superpower হয়েই সন্তুষ্ট থাকবে না, বিশ্বজুড়ে সে তার softpower এবং moralityকে হাতিয়ার করে যে একটি সত্যিকারের superpower হয়ে উঠবে, G20র উপস্থাপনায় তার ইঙ্গিত ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ভারত এমন এক মহাশক্তি হবে যে জোর করে কারো ঘাড়ে কোনকিছু চাপিয়ে দেবে না, যে নমনীয় হবে, মানবিক হবে, ভরসার পাত্র হবে। এটাই স্বামীজী আর শ্রীঅরবিন্দের স্বপ্নের ভারত, যা আমাদের জীবদ্দশাতেই সত্যি হতে চলেছে।

Tuesday, March 7, 2023

হিন্দু

আমরা মিশরীয় সভ্যতার কথা বলি, ব্যাবিলনীয় সভ্যতার কথা বলি, পারশিক সভ্যতার কথা বলি, রোমান সভ্যতার কথা বলি কিন্তু ভারতীয় সভ্যতার বদলে হিন্দু সভ্যতা কেন বলি? ঠিক যে কারণে মেক্সিকানীয় বা এল সালভাদরীয় সভ্যতা না বলে মায়া সভ্যতার কথা বলা হয়, যা মেক্সিকো, গুয়েতেমালা, বেলিজ, হন্ডুরাস আর এল সালভাদর জুড়ে ছড়িয়ে ছিল, যাকে এককথায় মেসো-আমেরিকা বলা হয়ে থাকে, সেই কারণে। যখন কোনো সভ্যতার ব্যাপ্তি একটি বিশেষ ভৌগোলিক সীমারেখাকে অতিক্রম করে যায় তখন তার একটি নিজস্ব বিশেষ্য গড়ে ওঠে বৈকি।

ব্যক্তিগতভাবে ভারতীয় সভ্যতা বলতে আমার আপত্তি আরো একটি কারণে - আমাদের সংবিধান। এই যে ইংরেজের শিক্ষায় শিক্ষিত আমাদের সংবিধান প্রণেতারা লিখে গেছেন 'India, also known as Bharat, is a Union of States', এটার ভিত্তি কি? যে মুহূর্তে ইন্ডিয়া আর ভারতকে সমার্থক করে দেওয়া হলো অমনি ভারতীয় সভ্যতাকে কৃত্তিমভাবে তার ডানদিক এবং বাঁদিক, দুদিক থেকেই কেটে দেওয়া হলো পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মাধ্যমে। 

ডানদিকে, ব্রিটিশদের তৈরি করে যাওয়া পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশ পেরিয়ে ওই যে সিএম রিয়েপে অঙ্কর ওয়াটের মন্দির এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বা আরো এগিয়ে ওই যে বালিতে উলুওয়াতুর মন্দিরে পূর্ব জাভা থেকে সাধনা করতে যাওয়া ঋষি ডাং হায়াং নিরার্থর মোক্ষলাভ করার পুণ্যস্থানে ওঁ আঁকা বেদী আজও রোজ পূজিত হচ্ছে, ও গুলোর সাথে ইন্ডিয়ার কি যোগ? 

আর বাঁ দিকে, পাকিস্তান পেরিয়ে, মধ্য এশিয়ার তাজাকিস্তানের দুশনবের জাদুঘরে বিশাল প্রাচীন শিবমূর্তি এখনো সংরক্ষিত, যার মাথা মুসলমান আক্রান্তারা কেটে দিয়েছিল। বস্তুতঃ কুষানরা ভারতে আক্রমণকারী হয়ে এসে শেষে শিবভক্ত হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন আর সারা মধ্য এশিয়া জুড়ে শিব আরাধনার প্রবর্তন করেছিলেন, ফলে মধ্য এশিয়ার প্রাচীন টাকায় শিবমূর্তি ছাড়া আর কিছু নেই। পরে ওই গোটা অঞ্চল জুড়ে কত বৌদ্ধবিহার গড়ে উঠেছিল, বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি তো এই সেদিন তালিবানরা তোপ দেগে ধ্বংস করলো।

আবার উত্তরদিকে চিন পেরিয়ে সেই জাপান পর্য্যন্ত বৌদ্ধতত্বের প্রসার, দক্ষিণদিকে শ্রীলঙ্কা থেকে মলদ্বীপ পেরিয়ে সেই সুদূর ফিজি পর্য্যন্ত ভারতীয় সংস্কৃতি আজও বিদ্যমান। সুতরাং, যেহেতু সংবিধানে বলে দেওয়া হয়েছে যে ইন্ডিয়াই ভারত, ভারতীয় সভ্যতা বললে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব আর পশ্চিমের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সমস্তটাই অস্বীকার করতে হয়। তাই ভারতীয় না বলে হিন্দু সভ্যতা বললে এর ব্যাপ্তি এবং গভীরতাকে ঠিক ঠিক ধরা যায় এবং সেটা যে বর্তমান ভারত বা ইন্ডিয়ার ভৌগোলিক সীমাকে অতিক্রম করে বহুদূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত, তাও বোঝানো যায়।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে নামটা হিন্দু কেন, বৈদিক বা সনাতন নয় কেন? প্রথমেই বুঝে নেওয়া দরকার যে ভারতীয়রা নিজেরা কোনোদিন নিজেদের হিন্দু বলতেন না, আমাদের আশেপাশের সভ্যতার মানুষরা আমাদের ওই নামে ডাকতেন, ফলে এর একটা আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা আছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের মতন নদীমাতৃক দেশে যেহেতু নদীর তীর ধরে ধরেই জনবসতি গড়ে উঠেছিল, ফলে 'গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতি নর্মদে সিন্ধু কাবেরি' ইত্যাদি সেই প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের composite culture এর অঙ্গ। মধ্যপ্রাচ্য বা পারস্য থেকে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশদ্বারেই যেহেতু সিন্ধু নদী, তার অপভ্রংশরূপ হলো হিন্দু। ফলে নিজেদের হিন্দু বলা মানে এক অর্থে দ্বারদেশ থেকে অন্দর অবধি বিস্তৃত এই প্রাচীন ভূমিতে লালিত পালিত সভ্যতার বিমিশ্র সংস্কৃতিকেও স্বীকার করে নেওয়া।

আরো একটি অর্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, পরম পূজনীয় গুরুজী গোলওয়ালকার যার ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং তার আগে মহামতি সভারকার যার সঙ্গায়ন করেছিলেন - হিমালয়ের 'হি' থেকে নিয়ে সিন্ধু মহাসাগরের 'ইন্দু' পর্য্যন্ত বিস্তৃত যে ভুমি, সেটাই হিন্দুস্তান বা হিন্দুভূমি। সেই ভূমিতে হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা মানুষের জীবনবোধ, sense of right and wrong, খাদ্যাভাস, পোশাক, সমাজ, সংস্কার, ধর্মবোধ, দর্শন, ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, তর্ক-বিতর্ক, পূজাপদ্ধতি, যুদ্ধ, রাজনীতি ইত্যাদি সব মিলিয়ে যে বিমিশ্র সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, সেটাই হলো হিন্দু সংস্কৃতি, এবং এর পরিণাম হিসেবে যে বিবর্তিত সভ্যতার উঠে আসা, তারই নাম হিন্দু সভ্যতা। যে সভ্যতা সারা বিশ্বের কাছে তার সাধনালব্ধ সত্যকে তুলে ধরেছিল - মানুষ অমৃতের পুত্র, স্রষ্টা আর সৃষ্টি এক। 

বেশ কিছুদিন অন্তরালে থাকার পর হিন্দু সভ্যতার সদর্থক প্রভাব আবার ছড়াতে শুরু করেছে বিশ্বময়। এক শতাব্দীরও আগে স্বামী বিবেকানন্দজী মহারাজ লাহোরে তাঁর একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, "শত শত বৎসর ধরিয়া ‘আল্লা হো আকবর’ রবে ভারতগগন মুখরিত হইয়াছে, এবং এমন হিন্দু কেহ ছিল না, যে প্রতিমুহূর্তে নিজের বিনাশ আশঙ্কা না করিয়াছে। জগতের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ দেশগুলির মধ্যে ভারতবর্ষ সর্বাপেক্ষা বেশী অত্যাচার ও নিগ্রহ সহ্য করিয়াছে। তথাপি আমরা পূর্বে যেরূপ ছিলাম, এখনও সেইরূপই আছি, এখনও আমরা নূতন বিপদের সম্মুখীন হইতে প্রস্তুত; শুধু তাহাই নহে, আমরা শুধু যে নিজেরাই অক্ষত তাহা নহে, সম্প্রতি আমরা বাহিরে যাইয়াও অপরকে আমাদের ভাব দিতে প্রস্তুত—তাহার চিহ্ন দেখিতে পাইতেছি। 

"বিস্তারই জীবনের চিহ্ন। আজ আমরা দেখিতেছি, আমাদের চিন্তা ও ভাবসমূহ শুধু ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নহে, কিন্তু আমরা ইচ্ছা করি বা না করি, ঐগুলি বাহিরে যাইয়া অপর জাতির সাহিত্যের মধ্যে প্রবেশ করিতেছে, অন্যান্য জাতির মধ্যে স্থানলাভ করিতেছে, শুধু তাই নয়, কোন কোন স্থলে ভারতীয় ভাবধারা স্বীয় প্রভাব বিস্তার করিতেছে। ইহার কারণ এই—মানবজাতির মন যে-সকল বিষয় লইয়া ব্যাপৃত থাকিতে পারে, তাহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও মহত্তম বিষয়—দর্শন ও ধর্মই জগতের জ্ঞানের ভাণ্ডারে ভারতের মহৎ দান।" (হিন্দুধর্মের সাধারণ ভিত্তি)

Monday, March 6, 2023

দোল

আমরা বাইরের জগৎটাকেও মনের রং দিয়েই রাঙাই। মন যখন মেঘাচ্ছন্ন তখন কেউ মুখের সামনে সুগন্ধি পায়েস ধরলেও খেতে ইচ্ছে করে না আর মনে যখন বসন্ত তখন এক ঠোঙা সুখনো মুড়িকেও মনে হয় যেন অমৃত। আনন্দময় যাপনের secret হলো মনটাকে কেবল পুরো সাদা বা পুরো কালো করে না রেখে লাল নীল সবুজ হলুদ নানান রঙে ছুপিয়ে 'যখন যেমন তখন তেমন' অবস্থাকে উপভোগসমর্থ করে তোলায় - এটাই আসল আর্ট, দ্য আর্ট অফ লিভিং। ঠাকুর বলতেন 'আমায় রসে-বশে রাখিস মা' - কথাটির অর্থ কিন্তু প্রচলিত অর্থে ফূর্তি করা নয় - আমার যেন 'রস' থাকে আবার সেই 'রস' যেন 'বশে'ও থাকে। অবশ্যই সঠিক উপভোগ্যকে বেছে নেওয়াটাও একটা আর্ট, আর তার জন্য নির্দিষ্ট একটা training programme এর মাধ্যমে মনটিকে train করতে হয়। আজ দোল - জীবনের রংকে ধারণ, আত্তীকরণ ও উজ্জাপন করার মহোৎসব। রঙের উৎস যেহেতু মনে তাই "রং যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে" - মায়ের কাছে সকলের হয়ে এই প্রার্থনা জানাই। দোলযাত্রা শুভ হোক আপনার।

Saturday, March 4, 2023

শিশুপাল

শিশুপাল এক মায়াশরীর। মায়ার বশবর্তী হলে যে ভুলগুলো হয়, শিশুপাল সেই ভুলগুলোই করতেন। সেই ভুল কি? নিজের স্বরূপ বিস্মৃত হয়ে natural spiritual progression এর বিরুদ্ধাচারণ করা এবং নিজের আত্মাকেই অপমান করা। 

শ্রীকৃষ্ণ কি আর শিশুপালের চেয়ে আলাদা? তিনিই তো পরমাত্মা, তিনি Omnipresent, Omnipotent and Omniscient, অর্থাৎ তিনি সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ, তাই তিনি সকলের মধ্যেই আছেন, শিশুপালের মধ্যেও আছেন। 

শ্রীকৃষ্ণ যখন সুদর্শনচক্র ধারণ করে শিশুপালের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন তখন তিনি আসলে শিশুপালকে কৃপা করে তাঁকে তাঁর মায়ার বন্ধন ত্যাগ করতে সাহায্য করলেন, যা মোহজালে আবদ্ধ শিশুপালের পক্ষে নিজে থেকে করে ওঠা সম্ভবপর হচ্ছিল না।

আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটি করে শিশুপাল লুকিয়ে আছেন, আমরাও মায়ার বশে নিজেদের স্বরূপকে ভুলে এমন সব আজেবাজে কাজ করে চলেছি যাতে নিজেরা নিজেদের হাতেই অপমানিত হচ্ছি অথচ blame করছি অন্যকে। এমত অবস্থায় আমাদের উপায় কি? 

উপায় হলো সকাল সন্ধ্যা নিয়ম করে জপ আর মনটা একটু বশে আসলে ধ্যান করা। মন শান্ত হলে ধ্যান হয়, ধ্যান করে মন শান্ত হয়না। তাই মা বলতেন কলিতে জপাৎ সিদ্ধি। জপের সময় আমরা যখন ইষ্টমূর্তিকে নিজেদের হৃদয়ে ধারণ করি তখন এক-দু-মুহূর্তের জন্য হলেও আমরা পরমাত্মার বাসস্থান হয়ে উঠি, তাই না? 

তিনি তো সর্বদাই সকলের হৃদয়ে বিদ্যমান, আমরা কেবল সেই সময়টুকুতে নিজেদের মধ্যে তাঁর presence feel করি। অর্থাৎ সেই কয়েক মুহূর্ত বা কয়েক মিনিট বা কয়েক ঘন্টা, যাঁর যেমন অভ্যেস হয়েছে, তিনি তাঁর মায়াশরীরটিকে অতিক্রম করে একটি গর্ভগৃহ হয়ে ওঠেন আর এটাই স্বাভাবিক আধ্যাত্মিক উত্তরণ। 

গুরু আর পরমাত্মা এক। যে মুহূর্তে গুরুদেব কৃপা করে কানে বীজমন্ত্র দিলেন, অমনি সুদর্শন তাঁর কাজ করে ফেললেন। সেইদিনই আমাদের ভেতরের শিশুপালবধ হয়ে গেল। তারপর কেবল ধীরে ধীরে স্বরূপের দিকে এগিয়ে যাওয়া একটা process, যা প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ আর আত্মার শান্তি জোগায়। মজার ব্যাপার হলো বাকি সবকিছু বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, কেবল এই তিনটি জিনিস ছাড়া।

মায়ার temporary ভালোলাগাকে ছেড়ে অনন্ত স্বরূপের দিকে মুখ ফেরানোর উপায় হলো internalisation of the external being through definite spiritual practices taught by the Guru এবং তাতে যে মানসিক স্থিরতার আবহ সৃষ্টি হয় সেটা permanent ভালোলাগার, আর কিছু না। শান্তম-শিবম-অদ্বৈতম।

জয় মা।