আমরা মিশরীয় সভ্যতার কথা বলি, ব্যাবিলনীয় সভ্যতার কথা বলি, পারশিক সভ্যতার কথা বলি, রোমান সভ্যতার কথা বলি কিন্তু ভারতীয় সভ্যতার বদলে হিন্দু সভ্যতা কেন বলি? ঠিক যে কারণে মেক্সিকানীয় বা এল সালভাদরীয় সভ্যতা না বলে মায়া সভ্যতার কথা বলা হয়, যা মেক্সিকো, গুয়েতেমালা, বেলিজ, হন্ডুরাস আর এল সালভাদর জুড়ে ছড়িয়ে ছিল, যাকে এককথায় মেসো-আমেরিকা বলা হয়ে থাকে, সেই কারণে। যখন কোনো সভ্যতার ব্যাপ্তি একটি বিশেষ ভৌগোলিক সীমারেখাকে অতিক্রম করে যায় তখন তার একটি নিজস্ব বিশেষ্য গড়ে ওঠে বৈকি।
ব্যক্তিগতভাবে ভারতীয় সভ্যতা বলতে আমার আপত্তি আরো একটি কারণে - আমাদের সংবিধান। এই যে ইংরেজের শিক্ষায় শিক্ষিত আমাদের সংবিধান প্রণেতারা লিখে গেছেন 'India, also known as Bharat, is a Union of States', এটার ভিত্তি কি? যে মুহূর্তে ইন্ডিয়া আর ভারতকে সমার্থক করে দেওয়া হলো অমনি ভারতীয় সভ্যতাকে কৃত্তিমভাবে তার ডানদিক এবং বাঁদিক, দুদিক থেকেই কেটে দেওয়া হলো পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মাধ্যমে।
ডানদিকে, ব্রিটিশদের তৈরি করে যাওয়া পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশ পেরিয়ে ওই যে সিএম রিয়েপে অঙ্কর ওয়াটের মন্দির এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বা আরো এগিয়ে ওই যে বালিতে উলুওয়াতুর মন্দিরে পূর্ব জাভা থেকে সাধনা করতে যাওয়া ঋষি ডাং হায়াং নিরার্থর মোক্ষলাভ করার পুণ্যস্থানে ওঁ আঁকা বেদী আজও রোজ পূজিত হচ্ছে, ও গুলোর সাথে ইন্ডিয়ার কি যোগ?
আর বাঁ দিকে, পাকিস্তান পেরিয়ে, মধ্য এশিয়ার তাজাকিস্তানের দুশনবের জাদুঘরে বিশাল প্রাচীন শিবমূর্তি এখনো সংরক্ষিত, যার মাথা মুসলমান আক্রান্তারা কেটে দিয়েছিল। বস্তুতঃ কুষানরা ভারতে আক্রমণকারী হয়ে এসে শেষে শিবভক্ত হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন আর সারা মধ্য এশিয়া জুড়ে শিব আরাধনার প্রবর্তন করেছিলেন, ফলে মধ্য এশিয়ার প্রাচীন টাকায় শিবমূর্তি ছাড়া আর কিছু নেই। পরে ওই গোটা অঞ্চল জুড়ে কত বৌদ্ধবিহার গড়ে উঠেছিল, বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি তো এই সেদিন তালিবানরা তোপ দেগে ধ্বংস করলো।
আবার উত্তরদিকে চিন পেরিয়ে সেই জাপান পর্য্যন্ত বৌদ্ধতত্বের প্রসার, দক্ষিণদিকে শ্রীলঙ্কা থেকে মলদ্বীপ পেরিয়ে সেই সুদূর ফিজি পর্য্যন্ত ভারতীয় সংস্কৃতি আজও বিদ্যমান। সুতরাং, যেহেতু সংবিধানে বলে দেওয়া হয়েছে যে ইন্ডিয়াই ভারত, ভারতীয় সভ্যতা বললে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব আর পশ্চিমের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সমস্তটাই অস্বীকার করতে হয়। তাই ভারতীয় না বলে হিন্দু সভ্যতা বললে এর ব্যাপ্তি এবং গভীরতাকে ঠিক ঠিক ধরা যায় এবং সেটা যে বর্তমান ভারত বা ইন্ডিয়ার ভৌগোলিক সীমাকে অতিক্রম করে বহুদূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত, তাও বোঝানো যায়।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে নামটা হিন্দু কেন, বৈদিক বা সনাতন নয় কেন? প্রথমেই বুঝে নেওয়া দরকার যে ভারতীয়রা নিজেরা কোনোদিন নিজেদের হিন্দু বলতেন না, আমাদের আশেপাশের সভ্যতার মানুষরা আমাদের ওই নামে ডাকতেন, ফলে এর একটা আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা আছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের মতন নদীমাতৃক দেশে যেহেতু নদীর তীর ধরে ধরেই জনবসতি গড়ে উঠেছিল, ফলে 'গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতি নর্মদে সিন্ধু কাবেরি' ইত্যাদি সেই প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের composite culture এর অঙ্গ। মধ্যপ্রাচ্য বা পারস্য থেকে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশদ্বারেই যেহেতু সিন্ধু নদী, তার অপভ্রংশরূপ হলো হিন্দু। ফলে নিজেদের হিন্দু বলা মানে এক অর্থে দ্বারদেশ থেকে অন্দর অবধি বিস্তৃত এই প্রাচীন ভূমিতে লালিত পালিত সভ্যতার বিমিশ্র সংস্কৃতিকেও স্বীকার করে নেওয়া।
আরো একটি অর্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, পরম পূজনীয় গুরুজী গোলওয়ালকার যার ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং তার আগে মহামতি সভারকার যার সঙ্গায়ন করেছিলেন - হিমালয়ের 'হি' থেকে নিয়ে সিন্ধু মহাসাগরের 'ইন্দু' পর্য্যন্ত বিস্তৃত যে ভুমি, সেটাই হিন্দুস্তান বা হিন্দুভূমি। সেই ভূমিতে হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা মানুষের জীবনবোধ, sense of right and wrong, খাদ্যাভাস, পোশাক, সমাজ, সংস্কার, ধর্মবোধ, দর্শন, ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, তর্ক-বিতর্ক, পূজাপদ্ধতি, যুদ্ধ, রাজনীতি ইত্যাদি সব মিলিয়ে যে বিমিশ্র সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, সেটাই হলো হিন্দু সংস্কৃতি, এবং এর পরিণাম হিসেবে যে বিবর্তিত সভ্যতার উঠে আসা, তারই নাম হিন্দু সভ্যতা। যে সভ্যতা সারা বিশ্বের কাছে তার সাধনালব্ধ সত্যকে তুলে ধরেছিল - মানুষ অমৃতের পুত্র, স্রষ্টা আর সৃষ্টি এক।
বেশ কিছুদিন অন্তরালে থাকার পর হিন্দু সভ্যতার সদর্থক প্রভাব আবার ছড়াতে শুরু করেছে বিশ্বময়। এক শতাব্দীরও আগে স্বামী বিবেকানন্দজী মহারাজ লাহোরে তাঁর একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, "শত শত বৎসর ধরিয়া ‘আল্লা হো আকবর’ রবে ভারতগগন মুখরিত হইয়াছে, এবং এমন হিন্দু কেহ ছিল না, যে প্রতিমুহূর্তে নিজের বিনাশ আশঙ্কা না করিয়াছে। জগতের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ দেশগুলির মধ্যে ভারতবর্ষ সর্বাপেক্ষা বেশী অত্যাচার ও নিগ্রহ সহ্য করিয়াছে। তথাপি আমরা পূর্বে যেরূপ ছিলাম, এখনও সেইরূপই আছি, এখনও আমরা নূতন বিপদের সম্মুখীন হইতে প্রস্তুত; শুধু তাহাই নহে, আমরা শুধু যে নিজেরাই অক্ষত তাহা নহে, সম্প্রতি আমরা বাহিরে যাইয়াও অপরকে আমাদের ভাব দিতে প্রস্তুত—তাহার চিহ্ন দেখিতে পাইতেছি।
"বিস্তারই জীবনের চিহ্ন। আজ আমরা দেখিতেছি, আমাদের চিন্তা ও ভাবসমূহ শুধু ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নহে, কিন্তু আমরা ইচ্ছা করি বা না করি, ঐগুলি বাহিরে যাইয়া অপর জাতির সাহিত্যের মধ্যে প্রবেশ করিতেছে, অন্যান্য জাতির মধ্যে স্থানলাভ করিতেছে, শুধু তাই নয়, কোন কোন স্থলে ভারতীয় ভাবধারা স্বীয় প্রভাব বিস্তার করিতেছে। ইহার কারণ এই—মানবজাতির মন যে-সকল বিষয় লইয়া ব্যাপৃত থাকিতে পারে, তাহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও মহত্তম বিষয়—দর্শন ও ধর্মই জগতের জ্ঞানের ভাণ্ডারে ভারতের মহৎ দান।" (হিন্দুধর্মের সাধারণ ভিত্তি)
No comments:
Post a Comment